থুতনি নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল রাফি। তবে একটা কান খাড়াই রইল ঘুমের মধ্যেও। টোড পরিবারকে একবিন্দু বিশ্বাস করে না সে।
রাতে তাড়াতাড়ি শুয়েছে, পরদিন খুব সকালে বিছানা ছাড়ল। ছেলেমেয়েরা। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। সুন্দর দিন। আকাশের রঙ ফ্যাকাসে নীল, মাঝে মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে গোলাপি মেঘ। সাগর শান্ত, আকাশের মতই নীল। মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ধোপাখানা থেকে ধুয়ে এনে বিছানো হয়েছে বিশাল এক নীল চাদর।
নাস্তার আগে সাগরে গোসল করতে গেল ওরা। বাড়ি ফিরে এল সাড়ে আটটার মধ্যে। আগের দিনের মত যদি নটার আগেই ফোন করেন মিস্টার পারকার, তাহলে যাতে ধরতে পারে। আজ আর মিসেস টোডকে ফোন ধরার সুযোগ দিতে চায় না।
মহিলাকে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল কিশোর, আংকেল ফোন করেছেন?
না, মেজাজ দেখিয়ে বলল.মিসেস টোড। সে আশা করেছিল, আজও আগেই ফোন ধরে ফেলবে। পারল না বলেই এই রাগ।
নাস্তা দিতে হবে। ভাল জিনিস। আংকেলকে যাতে বলতে পারি ভাল খাবারই খাওয়ানো হচ্ছে আমাদের।
ছেলেটাকে বিশ্বাস নেই। খারাপ কিছু দিলে সত্যি বলে দিতে পারে। বানিয়েও বলতে পারে অনেক কিছু। তাই শুকনো রুটি আর মাখন দেয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করতে হলো মিসেস টোডকে।
খানিক পরেই রান্নাঘর থেকে মাংস ভাজার গন্ধ পেল কিশোর।
মাংস, ডিম ভাজা, টমেটোর সালাদ আর রুটির ট্রে ধাম করে টেবিলে নামিয়ে রাখল মিসেস টোড। মুচকি হাসল শুধু কিশোর, কিছু বলল না। যত খুশি মেজাজ দেখাক, খাবার না দিয়ে তো পারল না।
টেরি ঢুকল আরেকটা ট্রে হাতে। তাতে চায়ের সরঞ্জাম।
বাহ, এইতো লক্ষ্মী ছেলে, হেসে বলল কিশোর।
বিড়বিড় করে কি যেন বলল টেরি, বোঝা গেল না। মায়ের মতই আছাড় দিয়ে ট্রে রাখল টেবিলে। ঝনঝন করে উঠল কাপ-পিরিচ। এই শব্দ সহ্য করল না রাফি, হউক! করে ধমক লাগাল।
প্রায় উড়ে পালাল টেরি।
খবর শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছে জিনা। খাবারের দিকে নজর নেই। তার প্লেটে মাংস, ডিম বেড়ে দিল কিশোর।
খাওয়ার মাঝপথে বাজল টেলিফোন। হাতের চামচটা প্লেটে ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে গেল জিনা। দ্বিতীয়বার রিঙ হওয়ার আগেই ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার। আব্বা?…আম্মার খবর কি?
শুনল ওপাশের কথা।
তিন গোয়েন্দাও খাওয়া থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
তাই নাকি? জিনা বলল, উফ, বাঁচলাম। আম্মাকে বোলো, তাকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে আছি আমি! তুমি তো আবার ভুলে যাবে, বলবে না কিছু! বলবে কিন্তু বলে দিলাম! আব্বা, আমি আসতে চাই, কিছু হবে?
আবার ওপাশের কথা শুনতে লাগল সে।
শোনার পর আস্তে নামিয়ে রাখল রিসিভার।
রবিন বলল, নিশ্চয় যেতে মানা করেছেন?
মাথা ঝাঁকাল জিনা। আবার টেবিলে এসে বসল। আম্মার অপারেশন হয়েছে। ব্যথা নেই। ডাক্তাররা বলছে, দিন দশেকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। আব্বা আম্মাকে নিয়েই একবারে আসবে।
যাক, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর, এতদিনে একটা সুখবর পাওয়া গেল।
কিন্তু কুখবর যে ঘাড়েই চেপে আছে এখনও, মুখ বাঁকাল মুসা। বেঙ পরিবার। দশটা দিন ওদের সহ্য করব কি ভাবে?
.
০৭.
জিনা ফোন ধরার সময় কাছেই ছিল মিসেস টোড। সব শুনল। মিসেস পারকার আসতে আসতে আরও দিন দশেক লাগবে। এ কদিন নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে এ-বাড়িতে।
হঠাৎ করেই যেন রাক্ষুসে খিদে পেয়ে বসল জিনাকে। এতক্ষণ কেবল চামচ নাড়াচাড়া করছিল, এখন গপ গপ করে গিলতে শুরু করল।
আমার যে কি ভাল লাগছে। আবার হাসি ফুটেছে তার মুখে।
এরপর যে কথাটা বলল জিনা, সেটা আর ভাল লাগল না কিশোরের।
জিনা বলল, আম্মা ভাল হয়ে যাচ্ছে, টোডের গোষ্ঠীকে আর ভয় পাই না আমি। তোমরা রকি বীচে ফিরে যাও, খামাকা ছুটিটা নষ্ট কোরো না। আমি আর রাফিই সামলাতে পারব ওদের।
গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর, দেখো, জিনা, এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। একবার কিছু ঠিক করলে তুমি যেমন না করে ছাড়ো না, আমিও ছাড়ি না, ভাল করেই জানা আছে তোমার। আমাকে কিন্তু রাগিয়ে দিচ্ছ।
বেশ, জিনা বলল, তাহলে আমি যা ঠিক করেছি তাই করব। বাড়ি না যেতে চাইলে এখানেই থাকো, আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমি যে প্ল্যান করেছি, সেটা আমার একার। তোমরা এতে থাকছ না।
কি প্ল্যান তোমার? বলতে অসুবিধে কি? আমাদের বিশ্বাস করো না?
করি। কিন্তু বললে আমাকে করতে দেবে না, ঠেকাতে চাইবে।
তাহলে তো আরও বেশি করে শোনা-দরকার, শঙ্কিত হয়ে উঠল কিশোর। জিনাকে বিশ্বাস নেই, কারও ওপর রেগে গেলে যা খুশি করে বসতে পারে।
কিন্তু কোনভাবেই জিনার মুখ থেকে তার প্ল্যান সম্পর্কে একটা কথা আদায় করা গেল না।
গোপনে তার ওপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।
জিনাও কম চালাক নয়। অস্বাভাবিক কিছুই করল না। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে সৈকতে বেড়াল, সাঁতার কাটল, খেলল। তার মায়ের শরীর ভাল হওয়ার খবর শুনেছে, আজ তার মন ভাল। দ্বীপে যাওয়ার কথা বলল একবার মুসা, এড়িয়ে গেল জিনা। তাকে আর চাপাচাপি করা হলো না এ-ব্যাপারে।
দিনটা ভালই কাটতে লাগল। বাড়ি গিয়ে খাবারের জন্যে মিসেস টোডের সঙ্গে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হলো না কারও, তাই বেকারি থেকে স্যান্ডউইচ কিনে খেল।
বিকেলে জিনা বলল, বাজারে যেতে হবে। আমি কয়েকটা জিনিস কিনব। চায়ের সময় হয়েছে, তোমরা বাড়ি যাও। আমি যাব আর আসব।