কিশোরের মাথায় তো মারতে পারল না, টেবিলেই থ্রম করে সসপ্যান আছড়ে ফেলল মিসেস টোড।
আচমকা এই শব্দে ভাঁড়কে গিয়ে গোওও করে উঠল ডারবি।
হাল্লো, ডার্টি! তীব্র ব্যঙ্গ ঝরল কিশোরের কণ্ঠে, আছিস কেমন? গোসল করানো হয়েছে তোকে? মনে তো হচ্ছে না…
ওর নাম ডার্টি নয়! ঝাঁঝিয়ে উঠল মিসেস টোড।
ধুয়েমুছে গন্ধ দূর করুন, ডারবিই বলব। যতক্ষণ গন্ধে বমি আসবে, ততক্ষণ ডাটি…যাকগে, ফালতু কথা বলার সময় নেই। আপনি ব্যস্ত, বুঝতে পারছি। ঠিক আছে, স্যান্ডউইচই তো কটা, লাগবে না। বাইরে থেকেই কিনে খেয়ে নেব। তবে রাতের খাওয়াটা যেন ভাল হয়, বলে দিলাম।
বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘুরল কিশোর। শিস দিতে দিতে এগোল দরজার দিকে। বেরিয়ে যাবে, ঠিক এই সময় আবার বলে উঠল টেরি, কিশোর, বিশোর…
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল কিশোর, কি বললে!
কুঁকুড়ে গেল টেরি। গোওও করে উঠল ডারবি।
বরফের মত শীতল কণ্ঠে বলল কিশোর, বলো তো আবার শুনি?
কিন্তু আর বলার সাহস করল না টেরি। কুকুরটাও ভয় পাচ্ছে। কিশোরকে। মিসেস টোড চুপ। মিস্টার টোড স্তব্ধ।
সবার ওপর একবার করে কড়া নজর বোলাল কিশোর। মিস্টার পারকার থাকার অনুমতি দিয়েছেন বলেই সাত খুন মাপ হয়ে যায়নি; ওদের সঙ্গে খারাপ। আচরণ করলে ওরাও ছাড়বে না, বুঝিয়ে দিল এটা। তারপর যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে আবার শিস দিতে দিতে বেরিয়ে এল।
বন্ধুদেরকে সব জানাল সে।
জিনা বলল, কিন্তু এভাবে মুখ কালাকালি করে বাড়িতে বাস করা যায়!
সারাটা দিন চুপচাপ রইল সে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তার মুখে। হাসি ফোঁটাতে পারল না তিন গোয়েন্দা।
কিশোর বলল, জিনা, চলো, তোমার দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।
মাথা নাড়ল জিনা। ভাল লাগছে না। বাড়ির কাছাকাছি থাকতে চাই। আব্বা আবার ফোন করতে পারে। বুড়িটাকে ধরতে দেব না। ধরলেই সাতখান করে লাগাবে আব্বার কাছে।
চায়ের সময় বাড়ি ফিরল ওরা। রুটি, মাখন আর জ্যাম দিল ওদেরকে মিসেস টোড, কেকটেক কিচ্ছু না। রুটিও এত কম, শুধু ওদের চারজনেরই হবে, রাফির জন্যে নেই। দুধ টক হয়ে গেছে, খাওয়া গেল না। চায়ে যে মিশিয়ে খাবে, তারও উপায় নেই। বাধ্য হয়ে দুধ ছাড়াই চা খেল ওরা।
জানালায় দেখা দিল টেরি। হাতে একটা বাসন। বলল, এই যে, কুত্তাটার খাবার।
জানালার নিচে ঘাসের ওপর ওটা নামিয়ে রেখে পালাল সে।
মাংসের গন্ধ পেয়ে ছুটে বেরোল রাফি।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল জিনা। যাসনে, রাফি, যাসনে!
বেরিয়ে দেখল বাসনের মাংস শুকছে কুকুরটা।
খেয়ে ফেলিসনি তো!
জানালা দিয়ে রবিন বলল, না, খায়নি। কেবল এঁকেছে। আমি দেখেছি।
জিনার পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে কিশোর। বাসনটা তুলে নিয়ে শুকল। কাঁচা মাংসের গন্ধ। আর কোন গন্ধ পাওয়া গেল না।
রবিন আর মুসাও বেরোল।
খাইছে! মুসা জিজ্ঞেস করল, বিষটিষ দেয়নি তো?
দাঁড়াও, দেখি। গলা চড়িয়ে ডাক দিল কিশোর, ডারবি! ডারবি!
লেজ নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এল ছোট্ট কুকুরটা। মাংস দেখাতেই দৌড়ে আসতে লাগল।
আরেক দরজা দিয়ে ছুটে বেরোল টেরি। ডারবি, যাবি না, ডারবি! খবরদার, ওই মাংস খেতে দেবে না ওকে!
কেন দেব না? বলো, কেন দেব না?
ও মাংস খায় না। কেবল কুকুরের বিস্কুট।
মিথ্যে কথা! চেঁচিয়ে উঠল জিনা, কালও ওকে মাংস খেতে দেখেছি। এখনও তো মাংস দেখে ছুটে এল!
হঠাৎ একটান দিয়ে কিশোরের হাত থেকে বাসনটা কেড়ে নিয়ে দৌড় দিল টেরি। রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
পেছনে দৌড় দিতে গেল মুসা, হাত ধরে তাকে থামাল কিশোর। যেয়ো না। গিয়ে দেখবে আগুনে ফেলে দিয়েছে। ওই মাংস আর পাবে না।
নিশ্চয় বিষ দিয়েছিল। শিউরে উঠল জিনা।
ইঁদুরের বিষটিষ হবে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। যাকগে, ভয় পেয়ো না। মুখে তো আর দেয়নি রাফি।
কিন্তু দিতে তো পারত..আবার খাওয়ানোর চেষ্টা করবে ওরা..
আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। শুধু হুমকি দিয়েছে ভেবেছিলাম। কিন্তু সত্যিই যে দেবে ভাবিনি।
আমাদেরও খাইয়ে দেবে না তো! শঙ্কিত হয়ে পড়েছে রবিন।
কুকুরকে যখন দিয়েছে, মানুষকেও দিতে পারে:
অত সাহস করবে না। চার-চারজন মানুষকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে, অতই সোজা!
.
০৬.
রাত হলো।
অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ল মুসা। বলল, রাতে খেতে দেবে বলে তো মনে হয় না। কিশোর, আজও কি চুরি করতে হবেনাকি?
যতই কঠোরতা দেখাক, গালাগাল করুক, আরেকবার টোডের মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। ভয় পেয়েছে, তা নয়, আসলে বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ করেই রাগ হতে লাগল নিজের ওপর। জিনাদের বাড়ি মানে ওদেরও বাড়ি, টোডদের চেয়ে এখানে তাদের অধিকার অনেক অনেক বেশি, ওদের ভয়ে চুরি করতে যায় কেন সে? খাবারের জন্যে অনুরোধই বা করতে যায় কেন?
উঠে দাঁড়াল সে, রাফি, আয় তো আমার সঙ্গে।
আমি আসব? জিজ্ঞেস করল মুসা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আজ বেঙের বাচ্চার নাক ফাটিয়ে দেব।
না, তুমি থাকো। নাক ফাটানোর সময় এখনও হয়নি।
প্যাসেজ ধরে রান্নাঘরের দিকে এগোল কিশোর। রেডিও বাজছে। তাই ঘরের কেউ কিশোরের পায়ের আওয়াজ শুনল না। সে দরজায় গিয়ে দাঁড়ানোর আগে জানতে পারল না কিছু। সবার আগে চোখ পড়ল টেরির। দেখে দরজায় কিশোর, তার পেছনে রাফি।
এ বিশাল কুকুরটাকে বাঘের মত ভয় পায় সে। তাকে দেখে রাফি ঘাউ ঘাউ করে উঠতেই লাফ দিয়ে নেমে গিয়ে সোফার পেছনে লুকাল।