গেটের অন্যপাশে চলে এলো দুই গোয়েন্দা। নিচু বাড়িগুলো বোধহয় আস্তাবল ছিলো একসময়, পরে গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বাঁয়ের বাড়িটায় এখন তিনটে দোকান। একটাতে আইস ক্রীম আর কোল্ড ড্রিংকস বিক্রি হয়। আরেকটায় ভনির। আর তৃতীয়টাতে বিক্রি হয় কফি আর হট ডগ। ডানের বাড়ির সামনেটা পুরো খোলা। মিউজিয়ম করা হয়েছে। তাতে জাহাজী আর জলদস্যুদের ব্যবহৃত নানা জিনিসের প্রদর্শনী চলছে। দুটো বাড়ির মাথায়ই জলি। রোজার পতাকা উড়ছে। তৃতীয় আরেকটা উড়ছে গেটের ওপর। সব কিছুই কেমন। মলিন। ঠিকমতো রঙ করা হয়নি। পুরনো, ক্ষয়া চেহারা।
ডানে, মিউজিয়মের পেছনে অনেকগুলো ওকগাছের পেছনে দেখা গেল বোটহাউস। তারও পরে পাথরের একটা টাওয়ার। ওদিকে পানির একটু পর থেকেই শুরু হয়েছে একসারি দ্বীপ, মোট চারটে। এতোই ছোট, ঘর বানিয়ে মানুষ বাসেরও অনুপযুক্ত। দ্বীপ ছাড়িয়ে, খাড়ির অপর পারে দেখা গেল এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের একটা প্লেন উঠে গেল রানওয়ে থেকে।
আহামরি কোনো জায়গা নয়, আনমনে বললো কিশোর। দেখার তেমন কিছু নেই।
রবিন তো বললোই, ব্যবসায় সুবিধে করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন ফিলিপ, মুসা বললো। হয়তো এই দুর্বলতাটাকেই কাজে লাগিয়ে কিছু করতে চাইছেন মেজর নিরেক।
তা হতে পারে।
দুটো বিল্ডিঙের মাঝের চওড়া প্রমেনাড় ধরে হেঁটে চললো ওরা। ডানের মিউজিয়মের দিকে তাকালো। ধুলোয় ঢাকা তলোয়ার, মরচে পরা কামান-বন্দুক, মোমে তৈরি জলদস্যু আর নাবিকদের মূর্তি, আর জাহাজীদের নানা-রকমের পোশাক সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোও তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করে না দর্শকদের, বুঝতে পারলো কিশোর। ডকের কাছে পৌঁছে একটা ছেলেকে দেখতে পেলো। ঢলঢলে শার্ট গায়ে, পরনে ঢেলা, ফোলা প্যান্ট, জলদস্যুরা যেরকম পরতো।
পিটার ফিলিপ! বলে উঠলো মুসা।
বেশ জোরেই বলেছে সে, কিন্তু ছেলেটা শুনলো বলে মনে হলো না। দ্রুত এগিয়ে গেল ব্ল্যাক ভালচারের সিঁড়ির দিকে। জাহাজের পেছনের কোয়ার্টারডেকে পায়চারি করছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। কালো, লম্বা ঝুলওয়ালা কোট গায়ে। গোড়ালি ঢাকা উঁচু বুট পরেছেন। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট, তাতে ঝুলছে ভোজালি। ছেলের মতোই তিনিও একটা ট্রাইকর্ন হ্যাট মাথায় দিয়েছেন, তাতে লাল পালক গোঁজা। বাঁ হাতের তালু আর আঙুল যেখানে থাকার কথা, সেখানে দেখা গেল বাঁকা একটা স্টীলের হুক। লাগিয়ে নিয়েছেন জলদস্যুর ভয়ংকরতা বোঝানোর জন্যে। টুরিস্টদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, ইয়ো হো হো, অ্যাণ্ড আ বটল অভ রাম! জলদি করো, জলদি করো, উঠে এসো! ব্যবসায়ীদের একটা জাহাজ দেখতে পাচ্ছি! স্রোতও চমৎকার! এখুনি নোঙর তুলে তাড়া করবো ওটাকে!
এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন ক্যাপ্টেন, মুসার মনে হলো এটা অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি। রোমাঞ্চিত হলো সে। নীরবে জাহাজে উঠে গেল দুই গোয়েন্দা। হঠাৎ গান গেয়ে উঠলো একদল জলদস্যু, বুনো চিৎকারে ঝালাপালা করে দিলো কান। চমকে ওপর দিকে তাকালো মুসা। লাউডস্পীকারে বাজছে ওসব। ঝট করে ডেকের দুই পাশে লাফিয়ে উঠলো অনেক জলদস্যু, কানা চোখে কালো পট্টি লাগানো, দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেছে ছুরি, যেন অন্য জাহাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। কার্ডবোর্ডে তৈরি ওগুলো। সামনের মাস্তুলে পতপত করছে একটা পাল। ঢিলে ভাবে। চলতে আরম্ভ করলো ব্ল্যাক ভালচার। বাতাসের সঙ্গে ওটার যাত্রাপথের কোনো সম্পর্ক নেই। এঞ্জিনে চলছে।
দূর, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লো মুসা, মজাটাই নষ্ট করে দিলো ওই লাউডস্পীকার আর এই এঞ্জিন! বেশি মেকি হয়ে গেল।
দর্শক বেশি না। বিষণ্ণ চোখে দেখছে ওরা পাল আর হার্ডবোর্ডের মানুষগুলোকে। হঠাৎ ঝড়ো বাতাস আর উত্তাল ঢেউয়ের ভারি শব্দ যেন ছিটকে বেরিয়ে এলো লাউডস্পীকার থেকে। জলদস্যুদের গান আর চেঁচামেচি বন্ধ হয়নি। এরই মাঝে এঞ্জিনের ভটভট-ভটভট আওয়াজটা ভারি বেমানান। পাইরেটস কোভের দিকে এগিয়ে চলেছে জাহাজ।
বাজে। আবার বিরক্তি প্রকাশ করলো মুসা। একেবারেই বাজে! কিন্তু এ জিনিসের ওপর এতো আগ্রহ কেন মেজর নিরেকের?
জানি না, কিশোর বললো। দেখে যাও।
.
০৫.
ডি লা ভিনা স্ট্রীটের দেয়ালে ঘেরা চত্বরের কাছে এসে পৌঁছলো রবিন। কাঠের উঁচু গেট বন্ধ। ঘুরে পেছন দিকে চলে এলো সে, আগের বার যেখানে উঠে বসেছিলো তিন গোয়েন্দা, সেখানে উঠলো। দোকানের পেছনের ঘরটার দিকে তাকালো। কেউ নেই। অপেক্ষা করতে লাগলো সে।
পনেরো মিনিট পর কিচকিচ করে খুলে গেল গেটের ভারি পাল্লা। চত্বরে ঢুকলো একটা গাড়ি। দোকানের পেছনের ঘরটায় এসে ঢুকলেন মেজর। হাতে একটা প্রাস্টিকের ব্যাগ। মনে হয় একাই এসেছেন। ব্যাগ থকে কফির সরঞ্জাম বের করে খেতে বসলেন তিনি। খাওয়া শেষ করে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে খুলে বিছালেন টেবিলের ওপর।
ছোট একটা রুলার বের করে কাগজটার ওপর রেখে মাপজোক করলেন। সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। ছোট একটা নোটবুকে কিছু লিখলেন। উঠে দাঁড়িয়ে কিছু শোনার জন্যে কান পাতলেন। রবিনও শুনতে পেলো শব্দটা। আরেকটা গাড়ি ঢুকলো চত্বরে। দোকানের সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর। ডালপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দেখছে রবিন। গেট দিয়ে ঢুকছে আরও একটা মোটরযান, বড় ট্রাক।