যাবে, তবে রাতের মতো অতো উজ্জ্বল হবে না চিহ্নগুলো, স্পষ্ট হবে না। এতে বরং সুবিধেই। আশপাশে কেউ থাকলে তার চোখ এড়ানো সহজ হবে। রবিন, মেজরের গাড়িতে যন্ত্রটা লাগিয়ে দেবে। তারপর সাইকেল নিয়ে অনুসরণ করবে চিহ্ন। যন্ত্রের কনটেইনারে লিকুইড কেমিক্যাল যা ভরা আছে, তাতে অন্তত দুঘন্টা চলবে। তার মানে বহুদূর পর্যন্ত অনুসরণ করতে পারবে গাড়িটাকে।
বসে আছি কেন তাহলে?
হ্যাঁ, চলো।
যন্ত্র আর টর্চ একটা ব্যাকপ্যাকে ভরে ব্যাগটা পিঠে বেঁধে নিলো রবিন। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলো তিনজনে। সাইকেল রাখা আছে ওয়ার্কশপে। নিয়ে। বেরিয়ে পড়লো ওরা। রবিন রওনা হয়ে গেল শহরের দিকে। কিশোর আর মুসা চললো উত্তরে, শহরের প্রান্তসীমার দিকে, সাগরের সীমানাও শুরু হয়েছে ওখান থেকেই।
মনের ভাবনাটা মুসার কাছে প্রকাশ করে ফেললো কিশোর, ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে হচ্ছে আমার কাছে, বুঝলে। শহরের ভেতরের কারো গল্প শুনতে চাইলেন না মেজর, শুধু শহর এলাকার বাইরে…
আরেকটা সেটআপ। চালাকি। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে ধরার জন্যে। ঠিক না?
হতে পারে।
.
রকি বীচের কয়েক মাইল উত্তরে উপকূলরেখা বরাবর একটা ছোট খাড়ির নাম। পাইরেটস কোভ। ছোট্ট একটা গ্রাম আছে ওখানে, অল্প কয়েকটা ঘর আর দোকানপাট আছে। কিছু মাছধরা নৌকা আর জাহাজ আছে। আর আছে একটা এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিস। সাইকেল চালিয়ে সাগরের তীরে চলে এলো কিশোর আর মুসা। খাড়ির কাছাকাছি আসতে চোখে পড়লো কাঁচাহাতে আঁকা একটা সাইনবোর্ডঃ
বেগুনী জলদস্যুর আড্ডা
ছোট-বড় সবার জন্যেই চমৎকার অ্যাডভেঞ্চার।
একটা কারখানা বাড়ির পরেই এই টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। আড্ডাটা গড়ে তোলা হয়েছে খাড়ির মাঝের একটা ছোট উপদ্বীপে। মূল ভূখণ্ডের দিকটায় কাঠের পুরনো বেড়া। বেড়ার বাইরে দুটো জায়গায় গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে পথ ধরে চলেছে কিশোররা, তার ডানে ঘন গাছের একটুকরো জঙ্গল, তার ওপাশেও বেড়া।
দুটো পার্কিং লটেই প্রচুর ধুলো। অল্প কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এই সকাল বেলা। গেটের বাইরে টিকেট বুদের কাছাকাছি বসে সোডা খাচ্ছে কয়েক জোড়া দম্পতি। তাদের বেয়াড়া বাচ্চাগুলো চেঁচামেচি করছে,মারামারি করছে। দুটো ছেলে একে অন্যকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বুদের ওপরে একটা কাঠের সাইনবোর্ডে পাইরেট শো-এর সময় লেখা রয়েছেঃ
ব্লাক ভালচার-এর যাত্রার সময়
প্রতিদিন ১২টা, ১টা, ২টা, ৩টা, ৪টা।
বুদের ভেতরে বসে আছে একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক। অনবরত বাতাসের মধ্যে কাটিয়ে মুখের চামড়ার এমন অবস্থা হয়েছে, দেখে আর এখন বোঝার উপায়। নেই বয়েস কতো। ডোরাকাটা একটা নাবিকদের শার্ট পরেছে সে। চোখে লাগিয়েছে কালো কাপড়, অন্ধরা যেমন লাগায়। মাথায় লাল রুমাল বাঁধা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে চলেছে, ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়, দর্শকবৃন্দ। কল্পনাই করতে পারবেন না কতোখানি রোমাঞ্চকর এই অভিযান। নিশ্চয় লিখে মুখস্থ করে নিয়েছে এই বক্তৃতা, ভাবলো কিশোর। লোকটা বলছে, বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় এসে একদিনের জন্যে জলদস্যু হয়ে যান সবাই। জাহাজে পাল তুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ুন পাইরেটস কোভে। মাথার ওপর দুলবে কালো পতাকা, তাতে মড়ার খুলির নিচে হাড়ের ক্রস আঁকা। অদ্ভুত দেখতে একটা স্কোয়ার-রিগার টাইপের জাহাজ। জলদস্যুরা যেরকম পছন্দ করতো। আবার তার নামেরই বা কি বাহার দেখুন, ব্ল্যাক ভালচার। কালো শকুন। কেমন গা ছমছম করে না? দ্বীপে দ্বীপে দেখবেন লড়াই চলছে। বারুদের গন্ধ ভাসে বাতাসে, আপনিও পাবেন সেই গন্ধ। নিজের চোখে দেখবেন কি করে আক্রমণ করে জলদস্যুরা। আর মাত্র কয়েকটা টিকেট বাকি। বিশ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে ব্ল্যাক ভালচার। পেছনে পড়ে থাকবেন না। হেলায় সুবর্ণ সুযোগ হারাবেন না। আসুন, জলদি আসুন।
অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকালো দম্পতিরা, এতো টিকেট কারা কিনে ফেললো যে মাত্র অল্প কয়েকটা বাকি আছে? কাউকেই চোখে পড়লো না, শুধু ওর ছাড়া। তবে দেরিও করলো না। উঠে গিয়ে লাইন দিলো টিকেট কাউন্টারে সামনে। দলে গিয়ে দাঁড়ালো কিশোর আর মুসা। যখন কিশোরের পালা এলো। জানালার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো সে, ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গে দেখা করতে চাই, ভাই, খুব জরুরী।
লোকটার একটামাত্র চোখ তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে। শো-এর সম ক্যাপ্টেন কারো সঙ্গে দেখা করেন না।
কিন্তু, তর্ক শুরু করলো কিশোর, শো তো এখনও…
ক্যাপ্টেন এখন জাহাজে। মারিয়া!
উঠে পড়লো কানা নাবিক। চলে গেল বুদের পেছনের ঘরে। প্রায় দৌড় এসে তার জায়গায় বসলো আঠারো-উনিশ বছরের একটা মেয়ে। জলপাই রঙের চামড়া মুখের। কালো চুল, বেণি করেছে।
কটা? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো মারিয়া। কথায় স্প্যানিশ টান।
ক্যাপ্টেন ফিলিপকে দরকার, মিস। এখুনি।
বুঝলাম না। কটা টিকেট? দুটো? কেমন যেন অনিশ্চিত শোনালো মেয়েটার কণ্ঠ।
ওভাবে বলে হবে না, কিশোর, পেছন থেকে বললো মুসা। কি করবে?
আর কি করবো? টিকেটই কাটতে হবে। জাহাজে উঠে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে আরকি।
.
টিকেট কেটে, চওড়া একটা গেটের দিকে এগোলো দুজনে। কাঠের ফ্রেমে কাঁটাতারের বুনন দিয়ে তৈরি হয়েছে পাল্লা। দুটো পাকা নিচু বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পথ, একেবারে ডক পর্যন্ত। ডকে বাঁধা রয়েছে জাহাজটা, ব্ল্যাক ভালচার। কাঠের সিঁড়ি নামিয়ে দেয়া হয়েছে যাত্রীদের জন্যে। দুই মাস্তুলের। পালতোলা প্রাচীন স্কোয়ার-রিগার জাহাজের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। কালো রঙ। প্রধান মাস্তুলে উড়ছে কালো জলি রোজার পতাকা, তাতে জলদস্যুদের কুখ্যাত চিহ্ন আঁকা রয়েছেঃ মড়ার খুলি আর হাড়ের ক্রস।