ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে আবার আগের জায়গায় চলে এলো তিন গোয়েন্দা। দেখলো, টেবিলে কি যেন রেখে ঝুঁকে দেখছেন মেজর আর রিগো।
দলিল, না ছবি? মুসার প্রশ্ন।
নকশা-টকশা হতে পারে, রবিন বললো।
আরো কাছে থেকে দেখতে যাবে ছেলেরা, এই সময় চত্বরে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ হলো। নতুন আরেকজন লোক এসে ঢুকলো দোকানে। খাটো, মোটা, মাথায় একটা রোয়াও নেই, পুরোপুরি টাক। নাকের নিচে মস্ত, বেমানান গোফ। উত্তেজিত ভঙ্গিতে মেজরের পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে টেবিলে রাখা জিনিসটা দেখাতে লাগলো। খানিক পরেই হাসতে শুরু করলো। তাতে যোগ দিলেন মেজর। রিগোকেও খুশি দেখাচ্ছে।
বন্ধ জানালার কারণে এবারেও ভেতরের কথা শুনতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। এগিয়ে গিয়ে বোতাম টিপে টেপ রেকর্ডারে লাগানো ক্যাসেটের ফিতা রিওয়াইও করতে লাগলেন মেজর।
কিশোর? মুসা বললো। এটাতেই রেকর্ড করেছিলো না ক্যাপ্টেনের কথা?
মুসার মুখের দিকে তাকালো একবার কিশোর আর রবিন, পরক্ষণেই মাথা ঘোরালো টেপ রেকর্ডারের দিকে। রিওয়াইণ্ডিং চলছে এখনো।
ওটাই হবে! রবিন বললো উত্তেজিত কণ্ঠে। টনি ক্যাসেটটা বের করেনি, আমি খেয়াল রেখেছি। ক্যাপ্টেনের সাথে সাথে তিনজনেই বেরিয়ে গিয়েছিলো, ঘরে আর কেউ ছিলো না। মেজর আর রিগো ফিরে এসেও মেশিনটার কাছে যায়নি। চোখ মিটমিট করলো বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে। ক্যাপ্টেনের কথাও মুছে ফেলছে!
তারমানে, গম্ভীর হয়ে বললো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর কাহিনীও চায় না ওরা।
কিন্তু ক্যাপ্টেনের গল্প তো শুনলো, মুসা বললো।
তার কথা শোনার জন্যে ভাগিয়ে দিলো সবাইকে, বললো রবিন।
এমনকি টাকাও দিলো, কিশোর বললো। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, সেটার সঙ্গে ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারের সম্পর্ক আছে।
কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী?
ঘটছেই বা কী? রবিনের সুরে সুর মেলালো মুসা।
সেটাই, কিশোর বললো, জানার চেষ্টা করবো আমরা। চলো, বাড়ি যাই। খিদে পেয়েছে। বিকেলে আবার আসবো, নজর রাখবো মেজর আর তার। লোকজনের ওপর। ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গেও কথা বলবো। হাসি ফুটলো তার মুখে। মনে হচ্ছে, নতুন আরেকটা কেস পেয়ে গেল তিন গোয়েন্দা!
.
০৪.
সেদিন আর মেজরের ওখানে যেতে পারলো না তিন গোয়েন্দা। ইয়ার্ডে ফিরতেই রাশেদ পাশা বললেন, তাঁর সঙ্গে যেতে হবে কিশোরকে। স্যান লুইস। অবিসপোতে অনেক পুরনো মাল দেখে রেখে এসেছেন। সেগুলো কিনবেন। রবিনকেও আটকে দিলেন লাইব্রেরিয়ান, যেখানে সে পার্টটাইম চাকরি করে। একজন কর্মচারি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়তি কাজ করতে হলো রবিনকে। মুসাকে আটকালেন তার মা। গ্যারেজ আর তার আশপাশটা পরিষ্কার করা হয় না অনেকদিন। লাগিয়ে দিলেন সেই কাজে। দুই দিন পর রেহাই পেলো তিনজনেই ওরা। সকাল এগারোটায় এসে মিলিত হলো হেডকোয়ার্টারে। মেজর নিরেকের বেঅদ্ভুত আচরণের ব্যাপারে আলোচনার জন্যে।
কাল রাতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিশোর জানালো। গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারের কথা রেকর্ড করছেন মেজর।
দ্রুত আলোচনায় ঠিক হলো, সাইকেল নিয়ে পাইরেটস কোভে যাবে কিশোর আর মুসা। আর তিন গোয়েন্দার নতুন, আজব আবিষ্কারটা বয়ে নেবে রবিন।
এটা একটা অদৃশ্য অনুসরণের যন্ত্র, বললো কিশোর। যাকে চাই, সে চোখের আড়ালে থাকলেও খুঁজে বের করে ফেলতে পারবো।
ছোট্ট যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো মুসা। একটা পকেট রেডিওর সমান। ভেতরে একটা ধাতব পাত্র রয়েছে, তাতে ঘন এক ধরনের তরল পদার্থ ভরা। নিচের দিকে একটা সরু টিউব, চোখে ওষুধ দেয়ার ড্রপারের মতো জিনিস। ড্রপারের ভেতরে একটা খুদে ভালভ আছে। বাক্সের একপাশে একটা শক্তিশালী। চুম্বক লাগানো।
কি করে কাজ করে এটা, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করলো।
অদৃশ্য চিহ্ন রেখে যাবে এটা, বুঝিয়ে বললো কিশোর। আমাদের ছাড়া আর কারও চোখে পড়বে না। যে কোনো যানবাহনের ধাতব বডিতে চুম্বকের সাহায্যে আটকে দিতে পারবো যন্ত্রটা। ভেতরের তরল কেমিক্যাল সাধারণ ভাবে দেখা যায় না, অতিবেগুনী আলো ফেলতে হয়। আলট্রাভায়োলেট লাইট যাকে বলে। ড্রপারের মাথার কাছে লাগানো ভালভটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সরে গিয়ে একফোঁটা করে কেমিক্যাল ছেড়ে দেবে বাইরে। মাটিতে পড়বে জিনিসটা, আর সুন্দর একসারি চিহ্ন রেখে যাবে। হাতে আলট্রাভায়োলেট টর্চ থাকলে ওই চিহ্ন ধরে অনুসরণ করে যাওয়া খুবই সহজ।
তারমানে আলট্রাভায়োলেট টর্চও আছে আমাদের কাছে?
নিশ্চয়ই, হেসে বললো কিশোর। ছোট একটা টর্চ বের করে দিলো রবিনের হাতে। সাধারণ টর্চের মতোই দেখতে, শুধু বা অদ্ভুত।
এটা থেকেই বেরোবে আলট্রাভায়োলেট লাইট? উসখুস করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো মুসা, ওটা কি ধরনের আলো, কিশোর? ক্লাসে নিশ্চয় পড়িয়েছে, আমি বোধহয় অ্যাবসেন্ট ছিলাম।
সাধারণ আলোর চেয়ে এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খাটো, ব্যাখ্যা করলো রবিন। ব্ল্যাক লাইট বা কৃষ্ণ আলোকও বলা হয় একে। অন্ধকারে কোনো কিছুর ওপর এই আলো ফেললে একধরনের বিচিত্র আভা দেখা যায়, নামটা হয়েছে সে-কারণেই। আরেকটা ব্যাপার, যে জিনিসের ওপর ফেলবে, সেই জিনিসটা দেখা যাবে, কিন্তু আলোক রশ্মি দেখা যাবে না।
ইনফ্রারেড লাইটের মতো, তাই না? তবে ওটা শুধু রাতে কাজ করে। আলট্রাভায়োলেট কি দিনেও কাজ করবে, মানে দেখা যাবে এটা দিয়ে?