একই ভঙ্গিতে, একই হাসি দিয়ে লোকটাকে স্বাগত জানালেন মেজর। টেপ রিওয়াইও করেছে টনি। লোকটাও বেশিক্ষণ গল্প বলতে পারলো না, ছেলেদের মতোই বের করে দেয়া হলো তাকেও।
আসলে, মেজর যে মিছে কথা বলছেন কেউই বুঝতে পারছে না, বিড়বিড় করে বললো কিশোর। সবাই ভাবছে, আবার ডাকা হবে তাদেরকে।
তার মানে ফাঁকিবাজি, রবিন বললো। কিন্তু কেন?
মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। বিজ্ঞাপন করে ডেকে নিয়ে আসা হলো সবাইকে। টেপে কথা তুলে আবার মুছে ফেলছে! অবাক কাণ্ড! নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে লাগলো সে।
একসাথে দুজন ঢুকলো মেজরের ঘরে। একজন লম্বা, রোগা, দাড়ি আছে। পরনে জাহাজ ক্যাপ্টেনের ইউনিফর্ম। ছোট একটা ছেলের হাত ধরে ঢুকেছেন। হতিনি। ওঁদেরকে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠলেন মেজর, হঠাৎ যেন বড় বেশি আগ্রহী। মনে হলো তাকে। ক্যাপ্টেনের সাথে হাত মেলালেন তিনি, বাচ্চাটার গাল টিপে আদর করলেন। দুজনকেই আদর করে এনে বসালেন চেয়ারে। মাইক্রোফোন মুখের কাছে এনে যখন কথা বলতে লাগলেন ক্যাপ্টেন, উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন মেজর।
নবাগতদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিন বলে উঠলো, ছেলেটাকে চিনতে পেরেছো? আমাদের ইস্কুলে পড়ে, নিচের ক্লাসে। ক্যাপ্টেন নিশ্চয় তার বাবা।
জাহাজের ক্যাপ্টেন মনে হচ্ছে? মুসা বললো।
অনেকটা তা-ই। পাইরেটস কোভে বেগুনী জলদস্যুর আড্ডার নাম শুনেছো?
শুনেছি, ডিজনিল্যাণ্ডের মতোই অনেকটা। তবে খুব সামান্য ব্যাপার। জাহাজে করে যেতে হয়, জলদস্যুদের কি কি সব দেখায়, ব্যস।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আমিও শুনেছি। কবছর হলো খুলেছে। এখনও। তেমন পরিচিত হয়নি।
ব্যবসাও হচ্ছে না, রবিন বললো। বেগুনী জলদস্যুর বিশেষজ্ঞ বলা হয়। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে। একবার আমাদের ইস্কুলে লাইব্রেরীতে একটা ছোটখাট লেকচার দিয়েছিলেন তার ওপরে, তোমরা সেদিন ছিল না।
আরে, মেজর বেরিয়ে যাচ্ছে! মুসা বললো।
মাইক্রোফোনের সামনে বসে তখনও গল্প বলে যাচ্ছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। পাশে বসে আছে তার ছেলে পিটার। মিনিটখানেক পরে রাস্তার দিক থেকে শোনা গেল সম্মিলিত চিৎকার। আবার কোনো কারণে রেগেছে গল্প বলিয়েরা। দেয়াল। থেকে নেমে পড়লো মুসা। ঝোঁপের আড়ালে থেকে দেয়াল ঘেঁষে এগোলো কি হয়েছে দেখে আসার জন্যে। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলো উত্তেজিত হয়ে।
সবাইকে ভাগিয়ে দিচ্ছেন মেজর। গেটের ওপর নো মোর ইন্টারভিউ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে রিগো। আজ আর কোনো সাক্ষাৎকার নেয়া হবে না। আবার ফাঁকি দেয়া হলো গল্প বলিয়েদের। ফিরে এলেন মেজর। পেছন পেছন এলো হাতির বাচ্চা রিগো–অন্তত মুসার কাছে লোকটাকে সেরকমই লাগছে। ইশারায় তাকে কথা বলতে মানা করলেন। নিরেক।
খাইছে! ক্যাপ্টেনের গল্প ঠিকই রেকর্ড করা হচ্ছে! পুরোপুরি!
বুঝেছি! আচমকা চেঁচিয়ে উঠেই কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেললো রবিন। কেউ শুনে ফেললো কিনা তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে। ক্যাপ্টেন ফিলিপ বেগুনী জলদস্যুর বিশেষজ্ঞ। নিরেক শুধু বেগুনী জলদস্যুর গল্পই চান, সেজন্যে আর সবাইকে ভাগিয়ে দিয়েছেন।
না। মনে করিয়ে দিলো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর গল্প আমিও বলতে চেয়েছিলাম। শোনেননি।
হয়তো খেয়ালই করেননি, মুসা যুক্তি দেখালো।
কিংবা গুরুত্ব দেননি, বললো রবিন। কারণ মেজর জানেন, ক্যাপ্টেন ফিলিপ বললে অনেক বেশি বলতে পারবেন। তাকেই তার দরকার ছিলো।
তাহলে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কেন বললেন না, যে গল্প শুনতে চাই? কিশোরের জিজ্ঞাসা। কেন এতোসব ঝামেলা করতে গেলেন?
কি জানি…, গাল চুলকালো রবিন।
টাকা বাঁচানোর জন্যে, কিশোর, মুসা বললো। বাবা বলে, যদি শস্তায় কিছু। পেতে চাও, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দাও। অনেকে হাজির হবে, দামদর করার সুযোগ পাবে। রবিনের কথাই ঠিক, ক্যাপ্টেনের মুখেই গল্পটা শুনতে চেয়েছেন নিরেক। কায়দা করে ডেকে এনেছেন পুরো গল্পটা শোনার জন্যে, কম পয়সায়।
এটা অবশ্য হতে পারে। এই যুক্তিটাও তেমন জোরালো মনে হলো না কিশোরের।
সাক্ষাৎকার ওদিকে চলছে। সাড়ে এগারোটায় ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। চেয়ার থেকে উঠতে গেলেন। তাকে আবার বসিয়ে দিলেন নিরেক। পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন। নিতে আপত্তি করলেন ফিলিপ। জোর করেই তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে দিলেন মেজর। বার বার হাত ধরে ঝাঁকালেন। পিটারের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এগিয়ে দিতে গেলেন দুজনকে।
টপাটপ লাফিয়ে দেয়াল থেকে নেমে পড়লো তিন গোয়েন্দা। ঝোঁপের। আড়ালে আড়ালে ছুটলো চত্বরের সামনের দিকে।
গেটের ফাঁক দিয়ে দেখলো, রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা পুরনো একটা পিকআপ ট্রাকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ফিলিপ আর পিটার। গাড়িটার রঙ বেগুনী। পাশে সোনালি অক্ষরে বড় করে লেখা রয়েছেঃ
বেগুনী জলদস্যুর আড়া
একদিনের জন্যে জলদস্যু হোন!
গেটের কাছে দাঁড়ানো মেজরের দিকে ফিরে বললেন ফিলিপ, তাহলে রাতে। দেখা হচ্ছে। নটায়।
বেগুনী পিকআপে করে চলে গেলেন ফিলিপ আর পিটার।
আজ রাতে? ফিসফিস করে বললো মুসা।
নিশ্চয় বেগুনী জলদস্যুর সমস্ত গল্পটা শুনতে চান মেজর, অনুমান করলো রবিন।
কিন্তু…, থেমে গেল কিশোর।
চত্বরে দাঁড়ানো একটা ছোট ট্রাকের এঞ্জিন গর্জে উঠেছে। চালিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল উনি। গেটটা লাগিয়ে দিয়ে দোকানের পেছনের ঘরে ফিরে এলেন মেজর আর রিগো।