বিমানটা কোন দিকে গেছে? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
মেইন চ্যানেল ধরে সোজা চলে যাবে সাগরের দিকে, পিটার জানালো। ওই লাল আর কালো বয়াগুলোর মাঝ দিয়ে। সাগরের দিক থেকে আসা বাতাসকে কাজে লাগাবে।
ক্রো-নেস্ট থেকে চেঁচিয়ে উঠলো নোনতা জেসন, ডক ছেড়েছে, ক্যাপ্টেন! গতি বাড়িয়েছে!
দূরে দেখা যাচ্ছে সী-প্লেনটা। দমে গেল ছেলেরা। ধরার আশা কম।
পারবো না! নিরাশ হয়ে বললো মুসা। আমরা যাওয়ার আগেই উড়ে যাবে।
পারবো! রবিন বললো। এঞ্জিনের শক্তি বাড়াতে সময় লাগবে।
ধরা কঠিন হবে।
গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। ধরতে না পারলে আমাদের ওপর দিয়েই উড়ে যাবে, বুড়ো আঙুল দেখিয়ে!
এঞ্জিনের সমস্ত শক্তি নিংড়ে ছুটেছে জাহাজ। বয়ার লম্বা সারির মুখে চলে গেছে বিমানটা। একমাত্র প্রপেলারটা ঘুরতে আরম্ভ করেছে।
পাইলটকে দেখতে পাচ্ছি, কিশোর বললো। পাশের লোকটা::-ভিকটর, কোনো সন্দেহ নেই…।
প্রতি মুহূর্তে বিমানটার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে জাহাজ।
লাল বয়াগুলোর ভেতরে বিমান প্রবেশের মানে হচ্ছে ওড়ার জন্যে অর্ধেক। প্রস্তুত ওটা।
লাল বয়ার সারি পেরিয়ে কালোগুলোতে যখন ঢুকলো বিমান, জাহাজ ডুকে পড়লো চ্যানেলের মধ্যে।
জাহাজে সবাই দম বন্ধ করে ফেলেছে।
পাইলটের শাদা মুখ হাঁ হয়ে গেছে। জানালার কাছে ঝুঁকে রয়েছে ভিকটর, হাতে পিস্তল। জাহাজটা আরো এগিয়ে যেতেই এদিকে সই করে পিস্তল তুললো সে।
শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো সবাই! চিৎকার করে বললেন ক্যাপ্টেন।
গুলি করলো ভিকটর…একবার-দুবার
একটা মুহূর্তের জন্যে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সময়। কিন্তু জাহাজ থেমে নে এগিয়ে যাচ্ছে বিমানটার দিকে, যেন মুখোমুখি ধাক্কা লাগানোর ইচ্ছে।
হঠাৎ শাই করে একপাশে ঘুরে গেল বিমান, একটা কালো বয়ায় লেগে। ছিঁড়ে গেল একটা ডানা। কাত হয়ে গেল একপাশে।
পানিতে লাফিয়ে পড়েছে পাইলট। সাঁতরে সরে যেতে চায় যতো দ্রুত সম্ভব।
পানি ঢুকছে বিমানে। কাত হয়ে ভাসছে এখন। এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। ওটার কাছাকাছি এসে গতি কমালো জাহাজ। দড়ি ছুঁড়ে দিলো পিটার। ওটা ধরলো পাইলট।
ভিকটরকে দেখা গেল আরেক দিকে সাঁতরাচ্ছে। দুটো লাইফ বেল্ট বেঁধে নিয়েছে। কালো বাক্সটা ঠেলে নিয়ে সাঁতরাচ্ছে।
দড়ি বেয়ে ডেকে উঠে ধপাস করে গড়িয়ে পড়লো পাইলট। পানি গড়াচ্ছে কাপড় থেকে। কয়েকবার জোরে জোরে দম নিয়ে বললো, তোমরা আমার প্রাণ বাঁচালে! ওই পাগলটার কাছে পিস্তল আছে। প্লেন চালাতে বাধ্য করেছে ও আমাকে। ধাক্কা লেগে কাত হয়ে না পড়লে কি হতো জানি না! জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিমান চুরমার হয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করে শিউরে উঠলো সে। কে লোকটা? ডাকাত-টাকাত?
ডাকাতই, পানির দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো কিশোর। ভিকটরের দিকে এগোচ্ছে জাহাজ।
এখনও পালানোর চেষ্টা করছে ভিকটর। কিন্তু বাক্সটা বেশি ভারি। ওটা নিয়ে এগোতে পারছে না তেমন। জ্বলন্ত চোখে ফিরে তাকালো একবার জাহাজের দিকে। বুঝলো, বাক্সটা নিয়ে পালানো অসম্ভব। শেষে ওটা ছেড়ে দিয়ে সাঁতরাতে শুরু করলো।
কিন্তু জাহাজের সঙ্গে সাঁতরে আর কতক্ষণ? হাল তাকে ছাড়তেই হলো। ক্রো-নেস্ট থেকে নেমে এসেছে নোনতা জেসন। পানিতে ঝাঁপ দিতে তৈরি হচ্ছে। তার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লো মুসা। তারপর জেসন। শেষে একে একে রবিন, পিটার আর পাইলট। সবাই মিলে ধরে ফেললো ভিকটরকে।
দড়ি নামিয়ে দেয়া হলো। তাতে বাক্সটা বেঁধে দিলো মুসা। কিশোর আর ক্যাপ্টেন মিলে টেনে তুললেন ওটা ডেকে।
ভিকটরকেও তোলা হলো।
দেখাবো, মজা দেখাবো সব কটাকে! নিষ্ফল হুমকি দেয়া শুরু করলো সে।
পাত্তাই দিলো না তাকে কেউ। তবে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখলো, যাতে আবার গিয়ে পানিতে পড়তে না পারে।
জাহাজের মুখ ঘোরালেন ক্যাপ্টেন। বললেন, কিশোর, বলে ফেলো তো এবার সব। এই ভিকটর লোকটা আসলে কে?
আমার ধারণা, চোর, গম্ভীর হয়ে বললো কিশোর। মেজর নিরেকের দলের। লোক।
কি করে বুঝলে? পিটার অবাক।
গুপ্তধনগুলো জলদস্যুদের লুটের মাল নয়। আধুনিক চোরের চোরাই মাল।
কি বলছো? বিশ্বাস করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন।
ঠিকই বলছি। একটা ব্যাপার প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, আপনাকে আর পিটারকে সরিয়ে দেয়ার পরেও চব্বিশ ঘন্টা কেন আড়ার ওপর নজর রাখছিলো মেজরের লোক। এখন জানি। ভিকটরের ওপর নজর রাখা হচ্ছিলো।
ভিকটর! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। ভিকটরকে পাহারা দিচ্ছিলো?
হ্যাঁ, তাই। তবে ভিকটর আমাদেরকে মালগুলো দেখানোর আগে পর্যন্ত সেটা বুঝতে পারিনি।
পরে কি করে বুঝলে? জানতে চাইলো মুসা।
খুব সহজ। বাক্সটা দেখেই বুঝে ফেলেছি। ওটার ওপরে তামা দিয়ে লেখা রয়েছে নাম। অনেক পুরনো হলে ময়লা হয়ে যায় তামা, রঙ বদলে যায়, সবুজ দাগ পড়ে। অথচ এটা একেবারে নতুন, চকচক করছে। আর বাক্সটাও তৈরি হয়েছে প্লাইউড দিয়ে, আগের দিনের মতো ভারি কাঠ নয়। তার ওপর রঙ করেছে। বেশি কাঁচা কাজ করে বসেছে ভিকটর।
বাক্সটা নতুন বলেই যে মালও নতুন, তা কি করে বুঝলে? ক্যাপ্টেনের প্রশ্ন। নতুন বাক্সে কি পুরনো মাল রাখা যায় না?
যায়। তবে এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আমাকে একটা আঙটি দিয়েছিলো ভিকটর। সেটা আমি জুয়েলারির দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি। নতুন। মাত্র কয়েক বছর আগে বানানো হয়েছে। তাতেই বুঝলাম, ভেতরের সব মালই নতুন। জলদস্যুর গুপ্তধন নয়।