বাইরে ধূসর হয়ে আছে সকালটা। বিষণ। কুয়াশার জন্যে সূর্য উঠতে পারেনি। দেখলো, লম্বা একটা লাঠিতে ডালটা বেঁধে জানালার কাঁচে ঘষছে কিশোর। রবিন দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশে। বুঝলো, এরকম কেন করছে। তাকে যেতে বলছে। তার আম্মা দেখে যদি কাজ করার জন্যে আবার তাকে আটকে দেন, সে-জন্যে ঘরে ঢোকেনি ওরা। টেলিফোন করারও সাহস পায়নি।
চুলোয় যাক কাজ! নাস্তা খাওয়ারও দরকার নেই বাড়িতে। বাইরে কোনোখানে খেয়ে নিলেই হবে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে জানালা খুললো মুসা। সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে মায়ের চোখে পড়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। জানালা গলে। বেরিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে এলো মাটিতে।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলো সে।
কিশোর বলছে, ভিকটর ইভানসের কিছু হয়েছে, রবিন জবাব দিলো।
খাইছে! কি হয়েছে?
সাইকেল বের করে নিয়ে এসো, কিশোর বললো। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে ধরা পড়বে। চলো, ভাগি।
হাইওয়েতে ওঠার আগে কথা বললো না কিশোর। তারপর বললো, সকালে পিটার ফোন করলো। ভোরে উঠেই নাকি চলে গিয়েছিলো টাওয়ারে, ভিকটরের মালের তালিকা করতে। উত্তেজনায় সারারাত ঘুমায়নি সে। গিয়ে দেখে ভিকটর নেই। বাক্সটাও নেই। তার পর আমিও চেষ্টা করেছি, ফোনের জবাবই দিলো না কেউ টাওয়ার থেকে।
পালালো নাকি?
না গিয়ে বলতে পারবো না।
বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় পৌঁছে সাইকেল গেটের বাইরে রাখলো ওরা। পিটার ওদের অপেক্ষাতেই ছিলো। দেখেই দৌড়ে এলো। চারজনে মিলে চলে এলো টাওয়ারে। সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকলো কিশোর, মিস্টার ইভানস! মিস্টার ইভানস!
সাড়া এলো না।
এরপর মুসা ডাক দিলো। ঠেলা দিলো দরজায়। পাল্লা ফাঁক হতেই মিয়াও করে বেরিয়ে এলো কালো বেড়ালটা।
ভিকটর নেই ভেতরে, বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো। কিশোর। চলো, ঢুকে দেখি।
সারা টাওয়ারে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না। গুপ্তধনের বাক্সটাও উধাও।
পালিয়েছে! পিটার বললো।
কাল রাতেই সন্দেহ হয়েছিলো আমার, আনমনে বললো কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার। ভিকটরের স্টাডিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মাঝারি আকারের একটা ঘর। চারপাশে সাজানো বুককেসে অসংখ্য বই। ঘরের মাঝখানে বড় একটা কাউচ, বসে আরাম করে পড়ার জন্যে। একপাশের দেয়াল ঘেঁষে একটা লেখার টেবিল। তাতে টেলিফোন আছে। এগিয়ে গেল। কিশোর। টেলিফোন সেটটার পাশেই পড়ে আছে একটা প্যাড। তাতে একটা বিচিত্র নকশা। সেটার দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো সে। হঠাৎ বলে উঠলো, সী-প্লেন!
কি বললে! মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার! মুসা কিছু বুঝতে পারছে না।
এটা কি? প্যাডে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
মনে তো হচ্ছে একটা সী-প্লেনের ছবি, পিটার বললো। নামার জন্যে পনটুন খুঁজছে, এরকম আঁকতে পারলে ভালো হতো।
ভালো আর্টিস্ট হলে সেটা পারতো। ভিকটর তা নয়।
কি বলতে চাইছো? রবিনও বুঝতে পারছে না কিশোরের কথা।
আমি শিওর, যাবার আগে টেলিফোন করেছিলো ভিকটর, কিশোর বুঝিয়ে দিলো। লাইন পেতে দেরি হয়েছিলো হয়তো, কিংবা অন্য কোনো কারণ ছিলো। যাই হোক, আঁকার যথেষ্ট সময় পেয়েছে সে।
এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিস! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। ফোন করেছিলো ওখানেই! সে জন্যেই প্লেনের ছবি।
হ্যাঁ, নিশ্চয় প্লেনে করে পালিয়েছে ভিকটর। পিটার, তোমার আব্বা কোথায়?
ঘরেই।
জলদি চলো। কুইক!
এতো সকালে গোয়েন্দাদের দেখে অবাক হলেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। ভিকটরের নিখোঁজ হওয়ার কথা পিটার তাকে কিছু বলেনি। নেই দেখেই সোজা কিশোরকে বে ফোন করেছে।
সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি।
এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিস কটায় খোলে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
আটটা তিরিশে। কেন?
আটটা পঁয়তাল্লিশ বাজে! এখনও হয়তো সময় আছে। জলদি একটা ফোন করুন ওদেরকে। বলুন, ডেঞ্জারাস একটা ক্রিমিন্যাল ওদের প্লেনে করে পালাচ্ছে!
টেলিফোন বুক খুললেন ক্যাপ্টেন। নম্বর বের করে ফোন করলেন। বললেন, একটা সাংঘাতিক অপরাধী পালাচ্ছে। ভিকটরের চেহারার বর্ণনাও দিলেন।
লোকটা জানালো, হ্যাঁ, ওরকম চেহারার একজন লোক বিমান ভাড়া করেছে। নাম, ভিকটর ইভানস। প্লেনে উঠে পড়েছে।
জলদি ঠেকান ওকে! থামান! টেলিফোনেই চেঁচিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন। পাইলটকে বলুন, যাতে না ওড়ে।
দাঁড়ান দেখছি, জবাব এলো অন্যপাশ থেকে। কিছুক্ষণ পর লোকটা জানালো, জবাব দিচ্ছে না পাইলট। বোধহয় পিস্তল দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছে ভিকটর।
পুলিসকে ফোন করবে বলে লাইন কেটে দিলো ট্যাক্সি সার্ভিসের কর্মচারি।
একটা বিমানের শব্দ শেনা গেল। ডক থেকে ওড়ার পাঁয়তারা করছে বিমানটা। ট্রেলার থেকে ছুটে বেরোলো তিন গোয়েন্দা আর পিটার। পেছনে বেরোলেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ।
ওড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে ছোট একটা সী-প্লেন।
আহহা, দেরি হয়ে গেল! হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর। আর ঠেকানো গেল না ওকে!
সেদিকে তাকিয়ে থেকে কি ভাবছেন ক্যাপ্টেন। তারপর বলে উঠলেন, পারবো! এসো! বলেই দৌড় দিলেন জেটির দিকে।
.
২২.
ব্ল্যাক ভালচারের হুইল ধরেছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। এগিয়ে চলেছে জাহাজ। জোর বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেছে পাতলা কুয়াশা। মাস্তুলের ওপরের ক্রো-নেস্টে উঠে বসেছে নোনতা জেসন। ওখান থেকে যা যা দেখবে, চেঁচিয়ে জানাবে। ক্যাপ্টেনকে। জাহাজের গলুইয়ের কাছে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়েছে তিন গোয়েন্দা আর। পিটার।