জ্যাকেটের পকেট থেকে লাল একটা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন মেজর। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। পুলিসও চলে এসেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে এখন গারদে ভরবে ব্যাটাদের।
হাসলো মুসা। পুলিস আসেনি, স্যার। ফাঁকি দিয়েছি ওদের। ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্যে।
তাই নাকি? সাংঘাতিক চালাক ছেলে তো তুমি! ভালো। তোমার গল্পই আগে শুনি। যেখানেই থাকো না কেন। রিগো! গেল কোথায় গাধাটা! এই রিগো, শুনে যাও!
ওদের গল্প শুনতে রাজি হওয়ায় তাকে ধন্যবাদ দিলো রবিন আর মুসা।
কিন্তু কিশোর তেমন খুশি হতে পারলো না। ভুরু কুঁচকে বললো, বাইরের ওরা খুশি হবে না একথা শুনলে।
না হলে না হোক। কয়েকটা বাচ্চার ভয়ে কাবু হয়ে যাবে? অসম্ভব! রিগো! বলদটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! কোথায় গেল?
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা দোকানের দরজা। বেরিয়ে এলো বিশালদেহী এক লোক, যেন একটা ছোটখাটো হাতির বাচ্চা। বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে এলো মেজরের দিকে। শোফারের পোশাক পরনে, লাগেনি ঠিকমতো, ছোট হয়েছে। গোল মুখটা দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। লালচে ঘন চুলের ওপর। বসানো শোফারের টুপিটাও ঠিকমতো লাগেনি, যেন অসহায় ভঙ্গিতে আঁকড়ে ধরে আছে চুল, পড়ে যাওয়ার ভয়ে। নীল চোখে ভয়। স-স-সরি, মে-মে-মেজর!
এই গরু, ছিলে কোথায়? আরেকটু হলেই তো মেরে ফেলেছিলো আমাকে!
ছিলাম না…মানে এখানে ছিলাম না! কাজ করছিলাম! টেপ রেকর্ডারটা ঠিক করে রাখছিলাম। অযথা গালাগাল করছিলো টনি। আপনার ডাক শুনতে পাইনি…
তা শুনবে কেন! খেঁকিয়ে উঠলেন মেজর। এখন যাও। গিয়ে বলো ওদেরকে, দশ মিনিটের মধ্যেই গেট খুলছি। লাইন দিয়ে দাঁড়াতে বলো। ভালো করে বুঝিয়ে বলে দেবে, শহর এলাকার মধ্যে থাকে এমন কারো ইন্টারভিউ নেয়া হবে না আজ। শুধু শহরের সীমানার বাইরের…
বাধ্য ছেলের মতো হেলেদুলে গেটের দিকে এগোলো রিগো। দরজা খুলতেই হৈ হৈ করে উঠলো জনতা। মেজর আবার বেরোচ্ছেন ভেবে ছুটে আসতে যাচ্ছিলো, কিন্তু রিগোকে দেখে থমকে গেল। হাসলেন নিরেক। ওকে দেখলেই অনেক গোলমাল থেমে যায়।
থামবেই, বললো রবিন।
আমার তো মনে হয়, ট্যাংক থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, মুসা বললো।
তা বোধহয় পারে, নাক দিয়ে খোতখোত করলেন মেজর। এসো আমার সঙ্গে।
মাঝখানের একটা দোকানের কাছে ওদেরকে নিয়ে এলেন তিনি। বাইরের। খালি ঘরের পেছনে ছোট আরেকটা ঘর। জানালা দিয়ে পেছনের চত্বর চোখে পড়ে, জংলা হয়ে আছে, তার ওপাশে উঁচু দেয়াল। সব কটা জানালাই বন্ধ, কাঁচ লাগানো। একটা জানালার নিচে বসানো এয়ার কনডিশনার মৃদু ঝিরঝির করছে। একটা ডেস্ক,আর কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই ঘরে। ডেস্কের ওপর রাখা একটা টেলিফোন। একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে ব্যস্ত একজন লোক। মাথায় কালো চুল। পরনে শ্রমিকের পোশাক।
দেরি আছে? জিজ্ঞেস করলেন মেজর।
মুখ না তুলেই মাথা ঝাঁকালো শুধু লোকটা।
ও ওটা ঠিক করুক, নিরেক বললেন, এসো ততোক্ষণ গল্প করি আমরা। আমাদের পাইরেটস সোসাইটির কথা শুনবে? বেশ। ডেস্কের এক কোণে উঠে বসলেন তিনি। টেবিলে বুকলেন বেতটা। এই সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার এক দাদা, আমার আপন দাদার ভাই। মস্ত ধনী ছিলেন তিনি। মূল লক্ষ্য, জলদস্যুদের নিয়ে গবেষণা করা, তাদেরকে সাহায্য করা, তাদের পরিবারের উন্নতি করা। আমাদের এক পূর্ব পুরুষ হামফ্রে নিরেকের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়েই এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে জাগে তাঁর মনে। হামফ্রের নাম দিয়েছিলো লোকে টাইগার নিরেক। প্রাইভেটিয়ার ছিলেন তিনি। ঔপনিবেশিক আমলে জাহাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। প্রাইভেটিয়ার কাদেরকে বলে জানো তো?
জানি, মাথা ঝাঁকালো রবিন। বেসরকারী লোক, তবে সরকারী ভাবে অনুমতি দেয়া হতো যাদেরকে, শত্রু জাহাজ লুট করার জন্যে। তা, টাইগার নিরেকের নাম কিন্তু কখনও শুনিনি।
আমিও না, বিড়বিড় করলো কিশোর। কোনো কিছু জানে না বলতে খুব। খারাপ লাগে তার। ওই এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত একজনের নামই জানি আমি, জেনারেল জঁ ল্যাফিটি।
টাইগার নিরেকও তারচেয়ে কম বিখ্যাত নন। মেজর নিরেক বললেন, ল্যাফিটির মতোই দেশপ্রেমিক। আঠারোশো বারো সালে রেভলুশনারি ওঅরে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস মনে রাখেনি তার কথা। দুজনেই প্রাইভেটিয়ার ছিলেন। নিরেক ইংরেজ জাহাজকে আক্রমণ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র, রসদ কেড়ে নিয়ে গিয়ে জমা করতেন বিদ্রোহীদের ভাঁড়ারে। আর জেনারেল হামলা চালাতেন স্প্যানিশ জাহাজের ওপর। অ্যানড্র জ্যাকসনের দলে থেকে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন তিনি। নিরেক বা ল্যাফিটি, কেউই কম ছিলেন না, অথচ একজনের কথা লোকে মনে রাখলো, আরেকজনের কথা বেমালুম ভুলে গেল। ইতিহাস যে কেন এই গোলমালটা করে, বুঝি না! এই ব্যাপারটাই খারাপ লেগেছিলো আমার দাদার। লাখ লাখ ডলার খরচ করে এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠা। করলেন। বই, পুস্তিকা প্রকাশ করলেন। সেসব বইতে লেখালেন সেই সব লোকদের কথা, যাদেরকে এড়িয়ে গেছে ইতিহাস।
কিন্তু… শুরু করতে যাচ্ছিলো কিশোর। তার কণ্ঠে সন্দেহের সুর।
থামিয়ে দিয়ে মেজর বললেন, শুনলে অবাক হবে, ইয়াং ম্যান, বছরের পর। বছর আমার দাদা সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন ওরকম মানুষের খোঁজে। তাদেরকে অনেক বড় করে তুলে ধরেছেন। তার সেই অসমাপ্ত কাজটাই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। আমি বুঝেছি, ক্যালিফোর্নিয়ায় ওরকম হিরো অনেক আছে, দেশের জন্যে যারা ডাকাত হয়েছে।…এই টনি, হলো? মাথা। ঝাঁকালো লোকটা। মেজর বললেন, কে আগে শোনাবে?