খানিক পরে শোনা গেল এঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন। স্নায়ু টানটান হয়ে গেল রবিন। আর মুসার। দম বন্ধ করে ফেললো ওরা। বোটহাউসের বাইরে থামলো গাড়িটা। দরজা খুলে দেয়া হলো, বোটহাউসের ভেতরে ঢুকে পড়লো ওটা। ওপরে নিথর হয়ে আছে তিনজনে। ওয়াকি-টকি নাকের কাছে এনে জোরে জোরে তিনবার। নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। কিশোরের জন্যে মেসেজ।
জবাবে তিনবার টোকার শব্দ হলো। নিজের ওয়াকি-টকির গায়ে টোকা দিয়েছে কিশোর।
দরজা খুলে ভ্যান থেকে নামলেন মেজর নিরেক আর রিগো। টর্চ জ্বেলে নেমে পড়লেন পানিতে। হেঁটে চললেন সুড়ঙ্গের দিকে।
হঠাৎ দড়াম করে গড়িয়ে পড়লো একটা মাস্তুল। এতো জোরে চমকে উঠলো। মুসা আর রবিন, মনে হলো ওদের কানের কাছে বোমা ফেটেছে। মুখ খিস্তি করে গাল দিয়ে উঠলো জেসন। বোধহয় সরতে গিয়েছিলো, নাড়া লেগে পড়ে গেছে মাস্তুলটা।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে টনি, তার টর্চের আলো এসে পড়লো সোজা রবিন আর মুসার ওপর। মেজর আর রিগোর টর্চও ঘুরে গেল এদিকে। একমুহূর্ত থেমে দাঁড়িয়ে দেখলো দুজনে চুপচাপ। তারপর আবার এসে উঠলো পিয়ারে।
নামো! টর্চের আলো নাচিয়ে আদেশ দিলো টনি।
নেমে এলো মুসা আর রবিন।
এই, কোথায় যেন দেখেছি তোমাদের? মেজর বললেন। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তোমরাই সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলে। গল্প শোনাতে এসেছিলে। এখানে কি করছো? আরেকটা ছেলে কই? তিনজন এসেছিলে, মনে আছে।
আ-আ-আমরা… তোতলাতে লাগলো রবিন।
ওপরে আর কেউ আছে কিনা দেখার জন্যে উঠে গিয়েছিলো রিগো, চেঁচিয়ে বললো, আর কেউ নেই, বস।
অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। জেসন গেল কোথায়?
গাধা কোথাকার! ধমক দিয়ে বললেন মেজর, ভালো করে দেখো। নিশ্চয়। আছে আরেকজন। মুসা আর রবিনের দিকে ফিরে বললেন, এবার বলো, এখানে কি করছো।
এমনি, জবাব দিলো রবিন। শো দেখতে এসেছিলাম। বোটহাউসটা চোখে পড়লো। কৌতূহল হওয়ায় দেখতে এসেছিলাম। ওই তাকে উঠেছি দেখার জন্যে। টায়ার্ড লাগছিলো। বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।
ঠিক, তাড়াতাড়ি বললো মুসা, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মই বেয়ে নেমে আসছে রিগো। শেষ কয়েকটা ধাপ নামার আগেই হাত পিছলালো। পুরো বোটহাউসটা কাঁপিয়ে দিয়ে ধুড়ুম করে পড়লো হাত-পা ছড়িয়ে ধাক্কা লেগে চিত হয়ে পড়ে গেল মুসা।
এতোবড় অপদার্থ জীবনে দেখিনি! রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন মেজর।
হাস্যকর ভঙ্গিতে উঠে বসলো রিগো। ঘাড় ফিরিয়ে মুসার দিকে তাকালো। সে এখনও উঠতে পারেনি। তাকে টেনে তুলে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। তারপর চিৎকার করে বললো, বঅস, চিনেছি! বলেছিলাম না কাল। রাতে চোখ রেখেছিলো? এই ছেলেটাই!
তাই নাকি? চিন্তিত মনে হলো মেজরকে। পকেট-টকেট ঘেঁটে দেখো কি আছে?
বেরোলে তিন গোয়েন্দার কার্ড, টর্চ আর ওয়াকি-টকি। টনি বের করলো বেগুনী জলদস্যু ওগুলো।
কার্ডটা পড়লেন মেজর। গোয়েন্দা! হুমম! এ-জন্যেই আমাদের পেছনে লেগেছো। তোমাদের আরেক সঙ্গী কাছাকাছিই আছে, তোমাদের মেসেজের অপেক্ষায়। একটা ওয়াকি-টকি তুলে নিলো সে। মুখের কাছে এনে কিশোরের উদ্দেশ্যে বললো, যেখানেই থাকো, মন দিয়ে শোনো। তোমার দুই দোস্তকে ধরেছি। কোনো চালাকির চেষ্টা করবে না। আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটাবে না। তাহলে তোমার বন্ধুরা মরবে, বিশ্বাস করো কথাটা-মরবে।
.
১৯.
লিভিং রুমে বসে ওয়াকি-টকিতে বোটহাউসের সমস্ত কথাই শুনলো কিশোর আর ভিকটর। পরিষ্কার দেখতে পেলো যেন দৃশ্যটা।
ওয়াকি-টকির সুইচ অফ করে দিয়ে কিশোর বললো, ধরে ফেললো!
শান্ত হও, ভিকটর বললো।
কিছু একটা করা দরকার।
কি করবো? হয়তো…
ঘন ঘন করাঘাতের শব্দ হলো সামনের দরজায়। একটানে পকেট থেকে পিস্তল বের করে সেদিকে এগোলো ভিকটর। হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে ফেললো পাল্লা।
জেসন দাঁড়িয়ে রয়েছে। পা ভেজা। দ্রুত এসে ঘরে ঢুকলো সে। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে বন্ধ করে দিলো দরজাটা। বললো, মেজরের লোকেরা ধরে ফেলেছে ছেলেদুটোকে!
জানি। তুমি পালিয়ে এলে কি করে?
জানালার কাছে বসেছিলাম। তাক থেকে ওটা গলে বেরিয়ে পড়েছি, ব্যাটাদের চোখ এড়িয়ে। পানি ভেঙে পাড়ে উঠেছি।
কপাল ভালো তোমার। যাক, তুমি আসায় ভালোই হলো। একটা উপায় বোধহয় করতে পারবো।
কি করতে চাইছেন, স্যার? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
চলো, জলদি সেলারে চলো!
তাড়াহুড়ো করে সেলারে নেমে এলো ওরা। সিঁড়ির আড়ালে জেসনকে লুকিয়ে থাকতে বললো-ভিকটর।
আপনার প্ল্যানটা কি? জানতে চাইলো জেসন।
হ্যাঁ, কি করতে চান? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
একটা কথা বলা দরকার, ভিকটর বললো। স্বীকারই করে ফেলি। আমি…
গুপ্তধন পেয়ে গেছেন! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর।পাইরেটস কোভে এসেছেনই আপনি সেজন্যে! জানেন, আছে!
হ্যাঁ, কিশোর, জানতাম। ঠিকই বুঝেছো। সাতদিন আগেই বের করে ফেলেছি আমি।
তার মানে টাওয়ারেই ছিলো?
মাথা ঝাঁকালো ভিকটর। ছিলো। এই স্টোররুমেই। পুরনো একটা চীনা আলমারিতে। অনেক আগে বাবার মুখে শুনেছিলাম গল্পটা। বেগুনী জলদস্যু লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলো। এতোদিন নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম বিদেশে, এশিয়ায়। ওখান থেকে ফিরেই চলে এসেছি টাওয়ারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গত হপ্তায় পেয়েছি ওগুলো।
তাহলে কাউকে বললেন না কেন?