তাতে কি? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
তাতে? লোকটা রান্নাঘর থেকে সিঁড়ি বেয়ে সেলারে নামেনি। টাওয়ারের সামনে-পেছনের কোনো দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকেনি।
কিন্তু সেলারে ঢোকার তো আর কোনো পথও নেই, রবিন বললো।
থাকতে বাধ্য, দৃঢ়কণ্ঠে যেন ঘোষণা করলো কিশোর। অন্তত এখন। ছিলো না বলেই মাটি খুঁড়তে হয়েছে মেজরের চেলাদেরকে।
সুড়ঙ্গ কেটে ঢুকেছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।
না, সম্ভবত কাটেনি, পরিষ্কার করেছে, শুধরে দিলো কিশোর। অনেক বছর। আগে দুর্গ থেকে বার বার পালিয়েছে বেগুনী জলদস্যু, মনে নেই? কেউ টাওয়ার থেকে তাকে বেরোতে দেখেনি, নিশ্চয় গোপন কোনো পথে পালিয়েছে। এবং সেটা সুড়ঙ্গ ছাড়া আর কিছু না।
এতোক্ষণে মুখ খুললো ভিকটর, কিশোর ঠিকই বলেছে। পুরনো একটা সুড়ঙ্গ আছে টাওয়ার থেকে বেরোনোর। অনেক আগেই ধসে পড়েছিলো, হয়তো নতুন করে খুঁড়ে নেয়া হয়েছে। আমি শুনেছি, আছে, কিন্তু ঠিক কোথায়, জানি না।
খুঁজে বের করে ফেলা যাক, চঞ্চল হয়ে উঠলো মুসা। তাহলেই জেনে যাবো।
সেলারের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে আরম্ভ করলো চারজনে। স্টোররুমে পাইপ আর শিক পাওয়া গেল। ওগুলো দিয়ে দেয়ালে, মেঝেতে বাড়ি মেরে আর খুঁচিয়ে দেখতে লাগলো ওরা। আলগা পাথর কিংবা যা-ই পড়ে থাকতে দেখছে, সরিয়ে ফেলছে।
মেঝেতে পায়ের ছাপ খোজো, পরামর্শ দিলো কিশোর।
কিন্তু মেঝের মাটি এতো শক্ত, পায়ের ছাপ পড়েই না।
এই যে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ভিকটর।
হুড়াহুড়ি করে এলো ছেলেরা। শিক দিয়ে বাড়ি মারলো আবার সে। ফাপা। আওয়াজ বেরোলো দেয়ালের গা থেকে। কিছু পাথর পড়ে আছে জায়গাটার নিচে। সেলারের ম্লান আলোয় পরীক্ষা করে দেখলো কিশোর। কিন্তু দেয়ালে কোনো দরজা কিংবা আলগা পাথর বসানো দেখলো না।
সুড়ঙ্গটা গোপন রাখা হয়েছে, বললো সে, তারমানে মুখটাও গোপন। দরজা-টরজা যদি থাকে, এপাশ থেকে খোলার ব্যবস্থা থাকবে। এবং সেটা খুব : দ্রুত আর সহজে খুলবে, নইলে বেরোতে পারতো না বেগুনী জলদস্যু। রান্নাঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে দ্রুত খুলেছে। সিঁড়িটার কাছে দেখা দরকার।
সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ, ওপর-নিচের জায়গা ভালো করে দেখা হলো। জিনিসটা প্রথমে চোখে পড়লো মুসার। অর্ধেক সিঁড়ি নিচে একটা ধাপের তলায় ছোট একটা লোহার আঙটা। ওটা ধরে টান দিতেই দেয়ালের গা থেকে খুলে এলো একটা চ্যাপ্টা পাথর। তার পেছনে দেখা গেল একটা লোহার লিভার, ভালোমতো তেল দেয়া। চাপ দিলো সে। নিঃশব্দে ফাঁক হয়ে গেল সিঁড়ির কাছে দেয়ালের একাংশ।
বাহ, চমৎকার, কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো ভিকটর। এখানে একেবারে। আমার নাকের ডগায় আলি-বাবার সিসেম ফাঁক রয়েছে, আর আমি গর্দভ কিছু জানি না!
স্টোররুম থেকে একটা টর্চ নিয়ে এলো সে। আগে আগে ঢুকে পড়লো। সুড়ঙ্গে। পেছনে চললো তিন গোয়েন্দা। যেমন সরু দেয়াল, তেমনি নিচু ছাত। ওদের মধ্যে মুসাই সব চেয়ে লম্বা, সে কোনোমতে সোজা হতে পারে। দুজন মানুষ। পাশাপাশি চলতে পারে না, শুধু একজনের জায়গা হয়। সুড়ঙ্গমুখের সামান্য ভেতরেই আরেকটা লিভার।
ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার জন্যে নিশ্চয়, কিশোর বললো।
সুড়ঙ্গর ছাত আর দেয়াল পাথরের, তবে পায়ের তলায় মাটি। সর্বত্র ছড়িয়ে। রয়েছে দেয়াল আর ছাত থেকে খসে পড়া পাথর। মিটার বিশেক পরেই ধসে পড়েছে সুড়ঙ্গটা।
বাবার কাছে শুনেছি, ভিকটর বললো, আমার জন্মের আগেই নাকি ভেঙেছে। ওটা। ভূমিকম্পে।
তবে ধসে পড়লেও এখন আর বন্ধ নয়, পথ করা হয়েছে। মোটা একজন। মানুষও ওই ফোকর গলে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে পারে। মাটি আর পাথর সরিয়ে পথটা করা হয়েছে। তাতে ঢুকে পড়লো চারজনেই, একজনের পেছনে একজন। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো অন্যপাশে। তারপর আবার উঠে দাঁড়ালো। পায়ের বেহলায় পাথরের ছড়াছড়ি। আরও মিটার বিশেক পরে শেষ হলো সুড়ঙ্গ। চারটে ভারি তক্তার ওপর লোহার দণ্ড আড়াআড়ি লাগিয়ে পাল্লামতো তৈরি করা হয়েছে। কজা লাগানো রয়েছে। ঠেলা দিতেই ঝটকা দিয়ে নেমে গেল পাল্লাটা। পুরোটা নামলো না, ঝুলে থাকলো মাঝপথে, দুপাশের দুটো শেকলের ওপর। হেঁটে ওটার ওপর উঠে এলো ওরা। নিচে দেখা যাচ্ছে কালো পানি। সামনে কাঠের দেয়াল, কাঠের ছাত।
বোটহাউসে ঢুকেছি আমরা! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। পিয়ারের নিচে!
ঠিকই বলেছো! ঘাড় নাড়লো ভিকটর।
ওপাশে যেতে হলে সাঁতরাতে হবে, রবিন আন্দাজ করলো।
না-ও লাগতে পারে, বললো মুসা। পিয়ারের নিচে রাতের বেলা পানিতে নামার কথা মনে পড়েছে তার। হয়তো খুব কম। তাহলে হেঁটেই যাওয়া যাবে।
মুসার কথাই ঠিক। নিচে পানি খুব কম। পাল্লাটা আবার আগের মতো করে সুড়ঙ্গের মুখে লাগিয়ে দুপাশের ফাঁকে দুটো কাঠের গোঁজ লাগিয়ে দেয়া হলো। লাগানো ছিলো ওভাবেই।
পানি মাড়িয়ে হেঁটে এসে পিয়ারের ওপর উঠলো ওরা। আলো বেশি নেই। একমাত্র ছোট জানালাটা আর তক্তার ফাঁক দিয়ে যা আলো আসছে। তাতে এতোবড় বোটহাউসের অন্ধকার কাটছে না।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো কিশোর। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, জানা না থাকলে বোটহাউসে ঢুকে ওই সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করা কঠিন। বোঝাই যায় না। মেজর নিরেকের নিশ্চয় জানা ছিলো।