সামনের দরজাটা খুলতে আরম্ভ করলো। কিন্তু কেউ বেরোলো না। চোখ মিটমিট করতে লাগলো মুসা। তাহলে আপনাআপনিই খুলেছে, বাতাসে? না, বাতাস নয়। দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে আসছে কালো একটা বেড়াল। বেরিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসতে লাগলো। রবিন আর কিশোর বেরোলো না।
মরিয়া হয়ে উঠলো মুসা। প্রায় চেঁচাতে শুরু করলো, রবিন! কিশোর! ভিকটর…
এই, কি করেছে ভিকটর!
মুখ ফেরাতেই একেবারে লোকটার মুখোমুখি হয়ে গেল মুসা।
আবার ঢুকেছো চুরি করে! কার সঙ্গে কথা বলছো? ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।
ঢোক গিললো মুসা। কোথায় খোঁড়া হয়েছে, বের করার চেষ্টা করছি আমরা, স্যার। আমাদের ধারণা, এখানে কোথাও গুপ্তধন লুকানো রয়েছে। রবিন আর কিশোর গেছে আপনার টাওয়ারের ভেতরে খুঁজতে। আমি…আমি…
চট করে খোলা দরজার দিকে তাকালো ভিকটর। কে খুঁড়ছে?
ওরা!
ওরা কারা?
যারা গুপ্তধন খুঁজছে।
কারা খুঁজছে, সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি! রেগে গেল ভিকটর।
মেজর নিরেক আর তার চেলারা। টনি, রিগো, গুন–সেই টাকমাথা লোকটা।
বিস্ময় ফুটলো ভিকটরের চোখে। আবার তাকালো টাওয়ারের দরজার দিকে। কোথায় খুঁড়ছে, দেখেছো?
না। সব জায়গায় খুঁজেছি আমরা, শুধু…
হঠাৎ যেন হাঁপাতে শুরু করলো মুসার ওয়াকি-টকি। এটা এক ধরনের সংকেত, কিশোর পাঠাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলো, কি, কিশোর?
নিচু গলায় জবাব এলো, টাওয়ারে একটা লোক ঢুকেছে, মুসা। আমাদের হামলা করেছে। সেলার থেকে উঠে এসেছি আমরা, কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে পারছি না। পেছনের দরজায় তালা। সামনে দিয়ে বেরোতে গেলে ভিকটর দেখে ফেলবে। একটা কাজই করার আছে আমাদের, ওপরে চলে যাওয়া… থেমে গেল হঠাৎ কিশোর। পরক্ষণেই শোনা গেল তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, আসছে লোকটা! আমরা চলে যাই…
নীরব হয়ে গেল ওয়াকি-টকি।
.
টাওয়ারের দোতলায় উঠে গেছে কিশোর আর রবিন। রান্নাঘর থেকে মই বেয়ে ওঠার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ওরা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে লোকটা।
জলদি, কিশোর বললো।
ছোট একটা জানালা দিয়ে ম্লান আলো আসছে। সেই আলোয় দেখে দেখে মই বেয়ে নিঃশব্দে তেতলায় উঠে এলো দুজনে। আলো এখানেও খুব কম। পুরনো কয়েকটা পিপা আর কাঠের বাক্স পড়ে আছে, ধুলোয় মাখামাখি। দেখে মনে হয় বেগুনী জলদস্যু। শত বছর ধরে ওভাবেই আছে ওগুলো ওখানে। দুটো বাক্সের ওপর বসলো ওরা। নিচে, দোতলায় ভারি পায়ের শব্দ হচ্ছে, নিশ্চয় ওদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকটা।
ও কে, কিশোর? ফিসফিসিয়ে বললো রবিন। নোনতা জেসন?
নোনতা জেসন আমাদের আক্রমণ করবে কেন?
তা-ও তো কথা।
কান পেতে শুনতে শুনতে হঠাৎ কিশোর বলে উঠলো, রবিন, আমার মনে হয় আমাদেরকে খুঁজছে ও! আমাদের পিছুও নেয়নি। অন্য কিছু খুঁজছে সে।
কিন্তু সেলারে তো হামলা চালালো?
চালিয়েছে। তবে আমাদের পিছু নিয়ে যায়নি। এখনও আমাদের পেছনে লাগেনি সে। ও হয়তো ভাবছেই না আমরা আছি এখানে। ভেবেছে, বেরিয়ে চলে গেছি।
মেজর নিরেক নয় তো?
মাথা নাড়লো কিশোর। না, মেজরের শরীর আরও ছোট। আর রিগো অনেক বড়। তবে অন্য দুজনের একজন হতে পারে, টনি কিংবা গুন আর ভিকটর ইভানস যে নয়, সে তো জানিই। কারণ সে বাইরে রয়েছে।
কিশোর! ওপরে আসছে!
মই বেয়ে চারতলায় উঠতে শুরু করলো দুজনে। মইটা শেষ হয়েছে একটা ট্র্যাপডোরের কাছে। ঠেলা দিতেই ওপরে উঠে গেল ওটা। ওরা বেরিয়ে এলো উজ্জ্বল রোদে। চারতলার এই ঘরটা ছোট, চারপাশে অসংখ্য জানালা। তাড়াতাড়ি ট্র্যাপডোর বন্ধ করে দিয়ে জানালার কাছে চলে এলো ওরা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খাড়িটা। ঘাটে বাঁধা রয়েছে ব্ল্যাক ভালচার। প্রথম শো শুরু হতে বেশি দেরি নেই।
কিশোর, এখানেও যদি আসে?
জানালার অনেক নিচে মাটি। টাওয়ার থেকে নেমে যাওয়ার আর কোনো পথও নেই। ঘরটায় আসবাব নেই, লুকানোর কোনো জায়গাই নেই।
কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। ভয় ফুটলো কিশোরের কণ্ঠে।
আসছে! ও আসছে!
.
বনের মধ্যে বসে টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা আর ভিকটর। ওয়াকি টকিতে কিশোরের মেসেজের অপেক্ষা করছে।
গিয়ে দেখা দরকার, মুসা বললো।
নাম কি তোমার? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ভিকটর।
মুসা। মুসা আমান।
মুসা, আমরা জানি না টাওয়ারে কে ঢুকেছে। কজন ঢুকেছে। গিয়ে হয়তো তোমার বন্ধুদেরকে আরও বিপদে ফেলে দেবো।
আ-আপনি বোধহয় ঠিকই বলেছেন। কিন্তু…
মুসা, টাওয়ারের দিকে হাত তুললো ভিকটর, ওই দেখো!
দেখলো মুসাও। টাওয়ারের ওপরতলার জানালা দিয়ে মুখ বের করেছে। কিশোর আর রবিন। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিতে গেল সে। খপ করে হাত চেপে ধরলো ভিকটর, টেনে থামালো। থামো! বিপদে ফেলে দেবে, ওদেরকে। তোমাকে দেখলেই বেস কিছু করে বসতে পারে ওরা।
বুঝলো মুসা। মাথা ঝাঁকালো। ঢোক গিললো। জানালা থেকে সরে গেছে। কিশোর আর রবিন। আবার জানালার দিকে হাত তুলে দেখালো ভিকটর, মুসাকে ছাড়েনি। মুসা দেখলো, জানালায় দেখা যাচ্ছে এখন বেগুনী জলদস্যুর মুখ। বেগুনী মুখোশ, কালো গোঁফ, পালক লাগানো বেগুনী হ্যাট, সোনালি কাজ করা বেগুনী কোট।
কো-কোথায় লুকালো ওরা! জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে যেন মুসা।
মাথা নাড়লো ভিকটর। কোথাও না, মুসা! ওখানে আলমারি-টালমারি কিচ্ছু নেই, লুকানোর কোনো জায়গাই নেই! আটকা পড়েছে ছেলে দুটো!
১৬.
নীরব টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে। জানালা থেকে অদৃশ্য হয়েছে। বেগুনী জলদস্যুর মুখ। রোদ চমকাচ্ছে কাঁচের পাল্লায়।