গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তবে তর্ক করলো না। ঘুরে রওনা হলো ওকের জঙ্গলের দিকে। ঘন গাছপালার মধ্যে ঢুকে দাঁড়ালো। কান পাতলো শব্দ শোনার আশায়। কিছুই কানে এলো না, শুধু তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছলাৎছল ছাড়া। আর আছে বাতাসের ফিসফাস কানাকানি। আড়র দিকে মুখ করে থাকা, টাওয়ারের একটা জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।
নিচু গলায় ওয়াকি-টকিতে কথা বললো মুসা, ভিকটর ইভানসের টাওয়ারে আলো দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখতে যাচ্ছি আমি।
বনের ভেতর থেকে সরাসরি না বেরিয়ে বেড়ার কাছে চলে এলো মুসা। বেড়ার ধার ঘেঁষে এগোলো, যাতে সহজে কারো চোখে না পড়ে। টাওয়ারের কাছাকাছি এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো মাটিতে। বুকে হেঁটে এগোলো। আলো কিত জানালাটার কাছে এসে থেমে দম নিলো, তারপর আস্তে মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালো।
ঘরের ভেতর ভিকটর একা। ইজি চেয়ারে শুয়ে পড়ছে। হঠাৎ কি মনে করে মাথা উঁচু করে কান পাতলো। যেন কোনো শব্দ কানে গেছে। সতর্ক হলো মুসা। সে কোনো আওয়াজ করে ফেললো না তো?
তাড়াতাড়ি জানালার কাছ থেকে সরে আসতে গেল সে। ফেলে দেয়া একটা খাবারের খালি টিনে পা বেধে ঠনঠন করে গড়িয়ে গেল ওটা। নীরব অন্ধকারে মুসার মনে হলো টিনের শব্দ তো না, যেন বোমা ফেটেছে।
চোখের পলকে মাটিতে শুয়ে স্থির হয়ে গেল সে।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ঘরের দরজা। এক ফালি আলো এসে পড়লো বাইরে। আলোর দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে ভিকটর। হাতে পিস্তল।
কেঁপে উঠলো মুসা। নেমে এলেই লোকটা তাকে দেখে ফেলবে…
মিআঁউউউ!।
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ভিকটরের পায়ে গা ঘষতে আরম্ভ করলো একটা। কালো বেড়াল। হেসে পিস্তলটা নামিয়ে ফেললো সে। তুই। আমি ভেবেছিলাম না। জানি কে। আয়, ভেতরে আয়। _
বেড়ালটাকে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ভিকটর।
কপালের ঘাম মুছলো মুসা। বেড়ালটা সময়মতো না বেরোলে…আর ভাবতে পারলো না সে। বুকে হেঁটে যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এলো আবার বেড়ার কাছে। উঠে একছুটে ঢুকে পড়লো ওকের জঙ্গলে।
জোরে জোরে দম নিলো কয়েকবার। তারপর ওয়াকি-টকি বের করে বললো, রবিন, কিশোরকে বলো, ঘরে রয়েছে ভিকটর। পড়ছে। মেজর নিরেক আর রিগোর চিহ্নও দেখলাম না। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে!
.
দোকানের পেছনে ঝোঁপের মধ্যে বসে অন্ধকারেই ভুরু কোঁচকালো কিশোর। বললো, ভ্যানটা ওখানেই কোথাও আছে।
ঘড়ি দেখলো সে। এগারোটা প্রায় বাজে। রবিনের জবাব শোনা গেল, মুসা। বলছে, পুরনো আস্তাবলগুলোর সব কটার ডবল দরজা। সহজেই ভ্যান ঢোকানো যাবে। তবে ভেতরে ঢুকতে চাইছে না, মুসা, মেজরের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
এখনও আমরা কিছু জানতে পারিনি। ওরকম ঝুঁকি না নেয়াই ভালো। জিজ্ঞেস করো, আর কি করতে পারে সে?
দোকানের ভেতরে একটা প্যাকেট খুলে কেক বের করে ক্যাপ্টেন আর পিটারকে দিলো গুন। মুসার কাছ থেকে রবিনের মুখে জবাব এলো ওয়াকি টকিতে, একটা কাজই করতে পারে বলছে। গেটের কাছে লুকিয়ে থেকে দেখতে পারে, কোত্থেকে বেরোয় ভ্যানটা। _ আপনমনেই মাথা ঝাঁকালো কিশোর। এটাই একমাত্র বুদ্ধি..এই শোনো, ধরো, দেখি। মাথা আরেকটু তুললো সে। রেকর্ডিং শেষ হয়েছে মনে হচ্ছে।…হা, উঠে দাঁড়িয়েছেন ক্যাপ্টেন আর পিটার। এগারোটা বাজে। বেরিয়ে যাবেন।
সামনের গেটের কাছে, মিউজিয়মের কোনায় মাটিতে পেট দিয়ে শুয়ে আছে মসা। তাকিয়ে রয়েছে প্রমিনাডের দিকে। ব্ল্যাক ভালচারের দানবীয় ছায়া ছায়া শরীরটা চোখে পড়ছে। কানে আসছে শুধু বাতাসের ফিসফাস, ঢেউয়ের ছলছল, আর কাঠের জেটিতে জাহাজের ধাতব শরীর ঘষা লাগার বিচিত্র ক্যাচকোচ।
একভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে গেল মুসার। দুই চিবুকের ওপর। থুতনি রেখে চোখ মিটমিট করে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো ওটা। ভ্যান! হেডলাইট নেভানো। এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনতে পায়নি সে। কোনদিক থেকে এলো, তা-ও বুঝতে পারেনি। ঘড়ি দেখলো সে। ঠিক ১১টা।
মাটিতে শরীর চেপে ধরলো মুসা, একেবারে মিশিয়ে ফেলতে চায় যেন। প্রায় নিঃশব্দে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গেল ভ্যান। গেট খোলার জন্যে নামলো রিগো। খুলে দিতে বেরিয়ে গেল গাড়িটা।
খানিকটা এগিয়ে আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়ালো ভ্যান। ঝাঁকুনি লেগে হাঁ হয়ে খুলে গেল পেছনের দরজা। খুঁটির আলো গিয়ে পড়েছে ওটার গায়ে, ভেতরে কি আছে স্পষ্ট দেখতে পেলো মুসা। গাদা গাদা বস্তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে, বোঝাই।
গাল দিয়ে উঠলেন ড্রাইভিং সীটে বসা মেজর, গাধা কোথাকার! তালা লাগায়নি! লাগিয়ে জলদি এসে ওঠো!
মেজরের নির্দেশ পালন করতে ছুটলো রিগো। দরজাটা লাগিয়েই থেমে গেল। ফিরে তাকালো মুসা যেখানটায় শুয়ে আছে সেদিকে। দেখে ফেললো নাকি! জমে গেল মুসা।
এই, কি হলো, বলদ! এতো দেরি কেন? ধমক দিলেন মেজর।
মাথা চুলকালো রিগো। দ্বিধা করলো একবার। তারপর গিয়ে উঠলো সামনের। সীটে। হেডলাইট জ্বালানো হলো এবার ভ্যানের। চলে গেল ওটা।
ওয়াকি-টকির ওপর কুঁকলো মুসা। রবিন, এইমাত্র বেরিয়ে গেল মেজর আর রিগো। কোথায় ছিলো ওরা, কোত্থেকে এলো, কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে ভ্যানের পেছনে কি আছে দেখেছি। অনেক বস্তা বোঝাই করা!