.
আড্ডার বাইরে খুঁটিতে ওই একটামাত্র আলোই জ্বলছে।
টিকেট বুদ আর তালা দেয়া গেটটা দেখা যাচ্ছে সেই আলোয়। খুব সামান্যই গিয়ে পড়েছে পার্কিং লটে, তবে ওই ম্লান আলোতেই নড়াচড়াটা চোখ এড়ালো না। মুসার। ট্রাকের ভেতরে জ্বলছে সিগারেটের আগুন, একবার উজ্জ্বল হচ্ছে, টান। দেয়ার সময়। টান ছেড়ে দিলেই আবার কমে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পেছনের পথ। দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি। মুসা আসার পর এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের একটা বিমানও। উড়ে গেছে।
তারপর, রকি বীচের দিক থেকে এলো একটা ভ্যান। পাকিং লটে ঢুকলো। হেডলাইট নিভালো। গিয়ে থামলো বন্ধ গেটের সামনে। দরজা খুলে নেমে এলেন। মেজর নিরেক আর রিগো।
রবিন! নিচু গলায় মেসেজ পাঠালো মুসা, মেজর আর রিগো ব্যাটা এসে গেছে!
জানালার নিচে বসে মেসেজটা শুনলো কিশোর। উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললো, এটাই আশা করেছিলাম, নথি। ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারকে সরিয়ে দেয়া। হয়েছে আড্ডা থেকে, যাতে নিরাপদে খোঁড়ার কাজ চালিয়ে যেতে পারে মেজরের। চেলারা। ওরা জানে কিংবা অনুমান করেছে কিছু একটা লুকানো রয়েছে ওখানে।
ওয়াকি-টকির খুদে মাইক্রোফোনে কড়কড় করে উঠলো রবিনের কণ্ঠ, মুসা বলেছে, মেজর আর রিগো গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলো। টনি নেমে গেছে। ওদের কাছে। গেটের তালা খুলে দিয়েছে। ভ্যান নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে মেজর আর রিগো। যতোটা সম্ভব আস্তে আর নীরবে করেছে কাজটা। আলো জ্বালেনি। ওরা। ঢুকে যেতেই আবার তালা লাগিয়ে ট্রাকে ফিরে এসেছে টনি। ভ্যানটা আর দেখতে পাচ্ছে না মুসা।
নিচের ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। রবিন, মুসাকে বললো ভ্যানের পিছু নিতে। মেজর আর রিগো কি করছে জানা দরকার।
অন্ধকারে নিজে নিজেই মাথা নাড়লো মুসা। গেটের ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। এখন ট্রাকের হাইড্রলিক লিফটে চড়ে বসেছে টনি। আমি বেরোলেই আমাকে দেখে ফেলবে। বেড়ার কাছেও যেতে পারবো না, দেখে ফেলবে। আর গিয়ে লাভও নেই। এতো উঁচু বেড়া, ডিঙাতে পারবো না।
কিশোর বলেছে, যে ভাবেই হোক, ঢুকতে হবে তোমাকে। ওরা কি করছে, জানা দরকার। কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয় আছে। খোঁজো। ..
আরেকবার চোখ বোলালো মুসা। বললো, কারখানার ওদিক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে পারি। বেড়া ওখানেও আছে। ডিঙানোর চেষ্টা করবো। না পারলে আরও এগিয়ে চলে যাবো। পিয়ারের কাছে। পিয়ার পার হয়ে পানিতে নেমে সাঁতরে ঢুকবো আড্ডার ভেতরে। তাহলেই আর টনি দেখতে পাবে না।
রবিনের জবাবের অপেক্ষায় রইলো মুসা। কিশোরের সঙ্গে কথা বলবে রবিন, তারপর জবাব দেবে।
বেড়ার অন্যপাশে পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুসা। কোনো শব্দ নেই ওখানে। আলো নেই।
অবশেষে জবাব দিলো রবিন, ঠিক আছে, মুসা, যাও। তবে খুব সাবধান!
.
১২.
কয়েকশো মিটার দূরে দৈত্যাকার ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রি-সার্ভিসট্রাকটা। সিগারেটের আগুন জানিয়ে দিচ্ছে এখনও হাইড্রলিক লিফটের ওপরে রয়েছে টনি।
পথটা দেখলো মুসা। পার্কিং লটের দিকে তাকালো। নির্জন। টনির দিকে আরেক বার তাকিয়ে সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে উঠে পড়লো সে। ছায়ায় ছায়ায় দৌড়ে চলে এলো কারখানার কাছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেণ্ড। বোঝার চেষ্টা করলো, কারো চোখে পড়ে গেল কিনা। বোধহয় পড়েনি। দেয়ালের ধার ধরে ধরে চলে এলো শেষ মাথায়, যেখানে খাড়ির সঙ্গে মিশেছে ওটা। দেয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা ইট আর কড়িকাঠ ধরে ওপরে উঠে পড়লো সে, তারপর দম বন্ধ করে লাফ দিলো। কাঠের পিয়ারে নিঃশব্দে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। থ্যাপ করে একটা শব্দ হলো। অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো আরও কিছুক্ষণ। কারো সাড়া নেই দেখে হাঁটতে আরম্ভ করলো। এগোলো কিছুদূর। খানিক দূরে চকচক করছে খুঁড়ির কালো পানি। মিটার দশেক দূরে আবছাভাবে চোখে পড়ছে ঘরবাড়ি।
পানিতে না নেমে ওখানে পৌঁছানোর আর কোনো উপায় নেই। পিয়ারের ওপর হাতড়ে হাতড়ে একটা নৌকা বাঁধার দড়ি পেয়ে গেল। টেনে দেখলো, একটা মাথা এখনও পিয়ারের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। ওটা ধরে ঝুলে পড়লো সে। নেমে এলো পানির কাছে। পা দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো। কনকনে ঠাণ্ডা পানি। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলো সে। তারপর হাত ছেড়ে দিলো।
পানি একেবারেই কম ওখানে, মাত্র গোড়ালি ডুবলো। দ্রুত একবার তাকালো। এদিক ওদিক, কেউ দেখছে কিনা দেখলো। তারপর হেঁটে চললো পানির মধ্যে দিয়ে। সাঁতরাতে হলো না বলে খুশি।
ট্রেলারটার কাছে উঠে এলো সে। জীবনের কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। সব কিছু চুপচাপ।
ডকে ভাসছে জাহাজটা, মাঝে মাঝে ঘষা লাগছে জেটির সঙ্গে, কচমচ আওয়াজ করছে। প্রমিনাডের দুপাশের ঘরগুলো সব বন্ধ। কফি স্ট্যাণ্ড, মিউজিয়ম, সব। মেজরের গাড়িটা চোখে পড়লো না।
ঘুরে মিউজিয়মের পেছনে চলে এলো সে। অন্ধকার আকাশের পটভূমিকায়। অনেক উঁচু লাগছে জাহাজের গলুইটা। সেদিকে একবার তাকিয়ে ওয়াকি-টকি তুলে আনলো মুখের কাছে। রবিন, ভেতরে ঢুকেছি। ট্রেলার, বাড়ি, জাহাজ, সব জায়গায় দেখলাম। মানুষজন চোখে পড়ছে না। মেজরের ভ্যানটাও না। কোথায় যে গায়েব হয়ে গেল, আল্লাহ মালুম!
কিছুক্ষণ পর রবিনের কথা শোনা গেল, কিশোর বলছে, ওরা ওখানেই। কোথাও আছে। খুঁজতে বলেছে।