নাটকীয় ভঙ্গিতে শেষ দ্বীপটার দিকে হাত তুললেন ক্যাপ্টেন। সিমেন্টের একটা বেদির ওপর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি, হাতের ভোজালিটা কোপ মারার ভঙ্গিতে তুলে রেখেছে। মোটা, খাটো এক লোকের মূর্তি। হ্যাট থেকে শুরু করে পায়ের জুতো পর্যন্ত, সব কিছুর রঙ বেগুনী। ঢোলা বেগুনী আলখেল্লার কিনারে সোনালি কাজ করা। ঢোলা প্যান্টের রঙ বেগুনী। মুখের নাক-ঢাকা বেগুনী মুখোশের নিচে ইয়াবড় পাকানো গোঁফ। বিকট করে তুলেছে চেহারাটাকে। কোমরের বেগুনী বেল্টে ঝুলছে পুরনো ধাচের পিস্তলের খাপ। গোড়ালি ঢাকা উঁচু বুটের ভেতরে ঢোকানো বড় ছুরি।
লেফেটেন্যান্ট উইলিয়াম ইভানস, বলে চলেছেন ক্যাপ্টেন, সান্তা রোসার। সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। ডা বুচার্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদ্রোহ করেছিলো, খুন করেছিলো পেড্রো কোনডেকে। জাহাজে করে চলে এসেছিলো পাইরেটস কোভে। এখানে জলদস্যুদের একটা ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলো সে, নিজের জাহাজ করেছিলো, নাম দিয়েছিলো ব্ল্যাক ভালচার। উপকূলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিলো। বহু বছর ধরে। সব সময় বেগুনী রঙের পোশাক পরে থাকতো সে, যাতে নাম হয়ে যায়। বিখ্যাত হতে পারেনি, সত্যি, তবে ভীষণ কুখ্যাত যে হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জলে, স্থলে, সবখানে ছিলো তার জয় জয়কার। তার বিরুদ্ধে পাঠানো কোনো সেনাবাহিনীই জিততে পারেনি বহু বছর ধরে। তবে মাঝে মাঝে কোণঠাসা যে হতো না, তা নয়। কোণঠাসা হলেই এসে ঢুকতো তার পাথরের দুর্গে। শক্তি সঞ্চয় করে আবার বেরোতো। পরাজিত করে ছাড়তো হামলাকারীদের। তবে একদিন তার দুর্গ বেগুনী জলদস্যুর আড়ায় ঢুকে আর বেরোলো না সে। সেটা আঠারোশো চল্লিশ সালে। বাইরের সৈন্যরা ভাবলো, আটকে ফেলেছে, এবার ধরতে পারবে। কিন্তু পারলো না। দুর্গের ভেতর থেকেই। গায়েব হয়ে গেল সে। তারপর আর কেউ কোনোদিন দেখেনি তাকে। তার বংশধররাই এখনও এই উপদ্বীপ আর টাওয়ারের মালিক।
ক্যাপ্টেনের কাহিনী শেষ হলো। মুখ ঘোরালো ব্ল্যাক ভালচার, দ্বীপগুলোর। পাশ দিয়ে ফিরে চললো। চার তলা পাথরের দুর্গটা দেখালেন ক্যাপ্টেন। নির্জন, শূন্য লাগছে বাড়িটা।
ফিরে এলো টিকেট বিক্রেতা আর পিটার। শশা শেষ হয়েছে। দর্শকদের মনে কোনোই দাগ কাটতে পারলো না জলদস্যুদের নাটক। শুধু বেগুনী জলদস্যুর কাহিনী যা-ও বা একটু কেটেছে, তা-ও নষ্ট করে দিলো এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের। একটা বিমানের গর্জন।
লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, ক্যাপ্টেন বললেন, আমাদের অভিযান শেষ। হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার কুখ্যাত বেগুনী জলদস্যুর ইতিহাস জানলেন আপনারা। ডকে ফিরে যাচ্ছি আমরা। খিদে পেলে খেতে পারেন ওখানে, ব্যবস্থা আছে। সুভনির কিনতে পারে। যতো সময় ইচ্ছে কাটাতে পারবেন ওখানে, কেউ মানা। করবে না। আবার যদি আসতে চান, তা-ও পারেন। পনেরো মিনিটের মধ্যেই আবার শো শুরু হবে।
হেসে উঠলো কয়েকজন, কয়েকজন বিড়বিড় করলো। একটা ব্যাপার। পরিষ্কার হয়ে গেল, দ্বিতীয়বার আর এই ছেলেমানুষী দেখার ইচ্ছে কারো নেই। জাহাজ তীরে ভিড়তেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো সবাই। সুভনিরের দোকানের সামনে থামলো কয়েকজন। হংকং থেকে আমদানী করা প্ল্যাস্টিকের জাহাজের মডেল, ছুরি, খুদে ভোজালি আর আরও নানারকম জিনিস রয়েছে, জলদস্যুরা যেসব জিনিস ব্যবহার করতো, তার নকল। কেউই তেমন আগ্রহ দেখালো না ওগুলোর প্রতি। মারিয়া, সেই মেকসিকান মেয়েটা টিকেট বিক্রি বন্ধ রেখে এসে এখন খাবারের দোকান চালাচ্ছে। কয়েকটা ছেলে মা-বাবার কাছে বায়না ধরলো। কোক আর হটডগ কিনে দেয়ার জন্যে। কিশোর আর মুসা এসে দাঁড়ালো। ওখানটায়। ক্যাপ্টেন ফিলিপের আসার অপেক্ষায়। কিন্তু তিনি এলেন না। এমনকি তার ছেলে পিটারও না।
আসবে না, মুসা বললো।
তাই মনে হচ্ছে, একমত হলো কিশোর। কিন্তু অন্য সময় থাকে কোথায়? বাড়িটাড়ি নিশ্চয় আছে।
মিউজিয়মের পেছনে উঁকি দিয়ে দেখলো ওরা। কোনো বাড়িঘর চোখে পড়লো না, শুধু ওক গাছের জটলার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাথরের টাওয়ারটা। তবে খাবারের দোকান আর স্যুভনির স্ট্যাণ্ডের পেছনে বড় একটা হাউস ট্রেলার দেখতে পেলো ওরা। দ্রুত গিয়ে দাঁড়ালো ওটার কাছে। দরজায় লাগানো একটা মলাটের টুকরোর ওপর নাম লেখা রয়েছেঃ ক্যাপ্টেন রোজার ফিলিপ।
পাওয়ার আশা নেই, তবু এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো কিশোর। সাড়া মিললো না।
জাহাজ থেকেই নামেননি হয়তো, আন্দাজে বললো মুসা।
আমার তা মনে হয় না। হয়তো ভেতরেই আছেন। টোকা শুনতে পাননি।
ট্রেলারের সামনের দিকে জানালাগুলোয় ভারি পর্দা টানা। পেছনটা ফেরানো রয়েছে খাড়ির দিকে, লম্বা পিয়ার আর কারখানাটা রয়েছে যেদিকে। ওদিকের একটা জানালা খোলা দেখা গেল। উঁকি দিয়ে ভেতরে কি আছে দেখতে গেল। কিশোর।
কি-কি-কিশোর! তোতলাতে লাগলো মুসা।
ঝট করে মাথা ঘোরালো কিশোর। জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেগুনী জলদস্যু। মুখে মুখোশ। হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠে ভোজালি উঁচিয়ে ছুটে এলো সে।
.
০৭.
ভোজালিটার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো মুসা। কিশোর চুপ।
দিনে দুপুরে চুরি করতে এসেছো, না! চিৎকার করে বললো বেগুনী জলদস্যুরূপী টিকেট বিক্রেতা।