জাহাজটায় দুশো পঁচাশি জন লোক ছিলো। আরজেনটিনার পতাকা। আঠারোশো আঠারো সালে স্পেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলো আরজেনটিনা। কুখ্যাত সব ডাকাতদের ভাড়া করেছিলো স্প্যানিশ জাহাজ আর শহর আক্রমণ করার জন্যে। কালিফোর্নিয়া তখন স্পেনের দখলে। আঠারোশো আঠারো সালের। একুশে নভেম্বর মনটিরে শহরের ওপর কামানের গোলা ফেলতে আরম্ভ করেছিলো জাহাজ দুটো। ওখানকার গভর্নর ছিলেন তখন সোলা।
বুম্মম্! করে কামান গর্জে উঠলো।
খাইছে! বলে লাফিয়ে একহাত শূন্যে উঠলো মুসা। তার পাশেই রয়েছে। কামানটা। একঝলক কালো ধোঁয়া বেরোলো ওটার মুখ দিয়ে। ছড়িয়ে পড়লো ডেকের ওপর। হাঁচি দিলো কয়েকজন, কাশতে লাগলো অনেকে।
কামানের গোলার জবাব এলো তীর থেকে, গল্পের খেই ধরলেন আবার ক্যাপ্টেন।
সত্যিই এলো জবাব।
কামানের গোলা ফাটলে আর পানিতে পড়লে যেরকম আওয়াজ হয়, তেমন। শব্দ হতে লাগলো লাউডস্পীকারে।
চারটে দ্বীপের প্রথমটার দিকে এগিয়ে চলেছে ব্র্যাক ভালচার। সরু পথ দিয়ে। দ্বীপগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা এবং মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। প্রথম দ্বীপটার পাশ দিয়ে জাহাজ যাওয়ার সময় ঝোঁপের ভেতর থেকে চারটে কার্ডবোর্ডের মূর্তি লাফিয়ে উঠলো। যান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থা রয়েছে ওগুলোকে ভোলা এবং নামানোর জন্যে। পুরনো কালের স্প্যানিশ সৈনিকের মূর্তি। ছোট একটা পুরনো কামান, চাকায় গড়িয়ে বেরিয়ে এলো পাথরের আড়াল থেকে। জাহাজ লক্ষ্য করে গোলা ফেললো।
চললো ভয়াবহ লড়াই! বললেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ।
বুম করে ধোয়া উদগীরণ করলো আবার জাহাজের কামান। জবাব দিলো। তীরের কামানটা।
শীঘ্রি ডা বুচার্ডের সৈন্যরা তীরে নামলো, বলছেন ক্যাপ্টেন। হটিয়ে দিলো। গভর্নর সোলার সৈন্যদের।
ধীরে এগোচ্ছে ব্ল্যাক ভালচার। গলুইয়ের কাছ থেকে দড়িতে ঝুলে দ্বীপে। নামলো দুজন জলদস্যু, দাঁতে কামড়ে রেখেছে কাঠের ছুরি। ডাঙায় পা দিয়েই কোমর থেকে একটানে ভোজালি বের করে, গালি দিয়ে উঠে কার্ডবোর্ডের সৈন্যগুলোকে আক্রমণ করলো ওরা। ঝোঁপের মধ্যে পড়ে গেল ওগুলো। দুজন। দস্যুই চেনা কিশোর আর মুসার। একজন সেই টিকেট বিক্রেতা, যার বয়েস। আন্দাজ করা যায় না, আরেকজন পিটার ফিলিপ।
কেন ব্যবসা করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন, মুসা বললো, বুঝতে পারছি।
আমিও পারছি, শুকনো গলায় বললো, কিশোর।
লাউডস্পীকারে গমগম করছে কণ্ঠ, মনটিরের সমস্ত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে দস্যুরা, শুধু মিশনারি আর কাস্টোম হাউসটা বাদে। তারপর জাহাজ নিয়ে দক্ষিণে রওনা হলো ওরা। পৌঁছলো গিয়ে রিফোজিও কোভ আর ওরটেগা সিয়েনড়ায়। সমস্ত ধনরত্ন একটা ট্রাংকে ভরে রিফোজিও পাস দিয়ে পালালো ওরটেগারা, সান্তা। ইনেস মিশনে আশ্রয় নেয়ার জন্যে।
দ্বিতীয় দ্বীপটায় পৌঁছলো ব্ল্যাক ভালচার। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলো দুজন। মানুষ, মাথায় কাউবয় হ্যাট, পরনে পুরনো ছাঁটের স্যুট। পিটার আর সেই টিকেট বিক্রেতা। প্রথম দ্বীপটা থেকে পায়ে হেঁটে চলে এসেছে এখানে, পোশাক বদলে। নিয়েছে। স্প্যানিশ জমিদার সেজেছে ওরা এখন। ছোট একটা টিলার ওপর দিয়ে একটা ট্রাংক বয়ে নিয়ে চলেছে। লাউডস্পীকারে শোনা যাচ্ছে ছুটন্ত অশ্বারোহী বাহিনী আর জলদস্যুদের চেঁচামেচি।
ঝাঁকে ঝাঁকে জলদস্যু গিয়ে নামলো তীরে, বললেন ক্যাপ্টেন। আগুন। লাগিয়ে দিলো পুরো ওটেগা হাসিয়েনড়ায়।
ঝোঁপের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলো, আবার জলদস্যুর পোশাক পরে বেরিয়ে এলো পিটার আর টিকেট বিক্রেতা। হাতে মশাল। আসল মশাল নয়, তৈরি করা। হয়েছে ঝাড়ুর ডাণ্ডায় লাল প্ল্যাস্টিকের গোলক বসিয়ে। গোলকের ভেতরে ব্যাটারির সাহায্যে ছোট বাল্ব জ্বলছে। একটা স্মোক বম্ব ফাটলো, ছড়িয়ে দিলো ঘন ধোয়া। কার্ডবোর্ড দিয়ে র্যাঞ্চ হাউস বানানো হয়েছে। দেয়ালে লাল রঙ করে বোঝাতে চাইছে, আগুন জ্বলছে। চিৎকার করে সেই আগুনের চারপাশে নাচানাচি শুরু করলো দুই জলদস্যু।
উপকূল ধরে এগিয়ে চললো দুটো জাহাজ, বললেন ক্যাপ্টেন। পথে বাড়িঘর যা চোখে পড়লো, সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে লাগলো। পৌঁছলো। তৎকালীন বুয়েনাভিস্তা কোভে। এখানকার বড় বড় স্প্যানিশ জমিদারেরা শেষ। চেষ্টা করলো লস অ্যাঞ্জেলেস আর স্যান ডিয়েগোর শহরগুলোকে বাঁচানোর।
খাঁড়ির সব চেয়ে বড় দ্বীপটার দিকে এগোচ্ছে জাহাজ। কার্ডবোর্ডের অসংখ্য মূর্তি উঠে দাঁড়াচ্ছে ঝোঁপের ভেতর থেকে। রঙ দিয়ে পোশাক একে বোঝানো হয়েছে কোনটা কোন ধরনের মানুষ। কাঁচা হাতে রঙ করা হয়েছে। বেশির ভাগই রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু মূর্তি ভেঙে গেছে কয়েক জায়গায়। প্রথমে পাহাড়ের। গোড়ায় দেখা দিলো একসারি মূর্তি, আরেক সারি মূর্তি লাফিয়ে উঠলো পানির কিনারে। লাউডস্পীকারে বাজতে লাগলো প্রচণ্ড লড়াইয়ের শব্দ-কামানের গর্জন, জলদস্যু আর স্প্যানিশ সৈন্যদের চিৎকার, তলোয়ারের ঝনঝন। এতো কিছু ঘটছে, কিন্তু দর্শকদের তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে, যেন পুরো ব্যাপারটাই হাস্যকর আর একঘেয়ে লাগছে তাদের কাছে।
উত্তেজিত করার যথেষ্ট চেষ্টা করছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। প্রাণপণে যুদ্ধ করলো স্প্যানিশরা, কিন্তু জলদস্যুরাই জিতলো। এখন আমরা যে খাড়িটায় রয়েছি, এটারই নাম ছিলো তখন বুয়েনাভিস্তা কোভ। জলদস্যুরা জেতার পর থেকেই এর নাম হয়ে গেল পাইরেটস কোভ। ডা বুচার্ড আর তার সহযোগীরা ধ্বংস করে দিলো সমস্ত হাসিয়েনড়া, লুটপাট করলো ইচ্ছেমতো। রওনা হলো আরও দক্ষিণে। একের পর এক শহর ধ্বংস করে দিয়ে কেবল এগিয়েই গেল ওরা, ফিরলো না আর কোনোদিনই। তবে পাইরেটস কোভের নাম আর ধ্বংসস্তূপই শুধু ফেলে যায়নি, মূর্তিমান একটা মারণাস্ত্রও ফেলে গিয়েছিলো। তার নাম বেগুনী জলদস্য!