কাছে পৌঁছে গেলাম। এটা সেই দ্বীপ, জাহাজ থেকে যেটা দেখেছিলাম। আরেকটু হলেই তীরে গিয়ে তরী ডুবতে বসেছিলো আমার। ভীষণ ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো তীরে। চুবিয়ে মারার জোগাড় করেছিলো। সেই দশটা মিনিট জীবনে ভুলতে পারবো না আমি। প্রতিটা অ্যাটল ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রবালের দেয়াল, তার ভেতরে লেগুনের শান্ত পানি। কিন্তু সেখানে যাওয়া সহজ নয়। কোন দিক দিয়ে মুখ বুঝতে পারলাম না। কিছু লেগুন আছে প্রশান্ত মহাসাগরে যেগুলোতে ঢোকার কোনো মুখই থাকে না সাগরের দিক থেকে। তার বাইরের দেয়ালগুলোতে যে কি ভয়ানক বেগে ঢেউ আছড়ে পড়ে না দেখলে বুঝবে না। প্রচন্ড কোনো শক্তি পাহাড়ের মতো অনড় কোনো কিছুকে নড়াতে চাইলে যে কান্ডটা ঘটবে, অনেকটা সেরকম ব্যাপার, আর কোনো ভাবে বোঝাতে পারছি না। হাজার হাজার টন পানির বোঝা নিয়ে একেকটা ঢেউ গর্জন করতে করতে ছুটে আসছে। দেখে মনে। হবে এমন শক্ত কোনো জিনিস নেই যা ঠেকাতে পারে ওই ঢেউকে। কিন্তু আটকে ফেলছে প্রবালের দেয়াল। ঢেউয়ের গোড়ায় ধরে টান মেরে যেন ছিনিয়ে নিচ্ছে ওটার ভিত। পুরো একটা মিনিট শূন্যে ঝুলে থাকছে পানির পর্বত, তারপর হাজারো বজ্রের মিলিত শব্দকে এক করে ধসে পড়ছে হড়মুড় করে। টগবগ করে যেন ফুটছে ওখানে সাগর, শাদা ফেনা তৈরি করছে, লম্বা একটা শাদা রেখা সৃষ্টি করছে সেসব ফেনা, যেন ফেনার স্থূপকে টেনে লম্বা করে দিচ্ছে অদৃশ্য কোনো হাত। সরে যেতে চাইছে পরাজিত ঢেউয়ের সঙ্গে, কিন্তু দেয়ালের মায়া কাটাতে না পেরে রয়ে যাচ্ছে পরের ঢেউটা আসার অপেক্ষায়। চলছে এভাবেই। বছরের পর বছর, একটানা। থামাথামি নেই। মাঝে মাঝে যেন খেপে গিয়ে সমস্ত রাগ প্রবালের ওপর ঢেলে দেয় সাগর, ঝাল মেটাতে চায়। সেটা হারিকেনের সময়। ওই সময় কোনো নৌকা কিংবা মানুষ ঢেউ আর দেয়ালের মাঝখানে পড়লে ভর্তা হয়ে যাবে। যাই হোক, আমি যখন পৌঁছলাম তখন হারিকেন ছিলো না। সাঁতরাতে থাকলাম দেয়ালের ধার দিয়ে। পেয়ে গেলাম একটা পথ। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ঢেউ এসে ধরে ফেললো আমাকে। ছুঁড়ে ফেলে দিলো দেয়ালের ভেতরে, এক্কেবারে সময়মতো, কারণ তখন কয়েকটা হাঙর আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিলো আমার প্রতি। কয়েক মিনিট ধরেই আমার পিছে লেগেছিলো। ভেজা একটা কম্বলের দলার মতো গিয়ে নেতিয়ে পড়লাম সৈকতে।
লোক-টোক ছিলো দ্বীপে? তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো মুসা। উত্তেজনায় কাঁপছে তার কণ্ঠ। সাংঘাতিক আগ্রহ নিয়ে শুনছে ডজের গল্প।
না, জবাব দিলো ডজ। আগেই তো বলেছি নির্জন। রবিনসন ক্রুসো হয়ে গেলাম। একা, শুধু একা আমি, আর কেউ নেই। সে অন্তত একটা পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলো দ্বীপে, আমি তা-ও পেলাম না। সৈকতে পড়ে থাকতে দেখলাম। শুধু নানারকম ঝিনুক আর নারকেল। প্রথম ভাবনাটা হলো পানির জন্যে। যদি মিষ্টি পানি না থাকে? কিন্তু ঈশ্বর কাউকে বাঁচাতে চাইলে সব ব্যবস্থা করেই দেন। আমাকেও দিলেন। পানি আছে দ্বীপে। ওই নোনা পানির মাঝে কোথেকে যে এলো ওই মিষ্টি পানি, বলতে পারবো না। এই প্রশ্নের জবাব আমি কিছুতেই বের করতে পারিনি। পানি খেলাম। নারকেল খেলাম। বালিতে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে শক্তি সঞ্চয় করলাম শরীরে। তারপর উঠলাম দ্বীপটা ঘুরে দেখতে। কোন স্বর্গে উঠেছি জানার আগ্রহ হলো খুব। খুবই সুন্দর দ্বীপ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লেওনের দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না, এতোই সুন্দর। কিন্তু সৌন্দর্য দেখার অবস্থা তখন নেই আমার। একটা কথা এখন জোর গলায় বলতে পারি, রবিনসন ক্রুসোর গল্প পড়তে যতো ভালো লাগে, বাস্তবে তার মতো অবস্থায় পড়লে লাগে ঠিক উল্টোটা। যেমন খারাপ লাগে, তেমনি অসহায়। যতোই ভাবতে লাগলাম বাকি জীবনটা এখানেই একা কাটাতে হবে, ততোই চুপসে যেতে লাগলাম ভেতরে ভেতরে। ভাবো একবার, এতো টাকার মুক্তো পেলাম, জানি কোথায় আছে, তুলে নিতে পারলেই রাজার হালে কাটাতে পারি জীবনটা। তা না, হয়ে গেলাম রবিনসন ক্রুসো। আর কোনো জাহাজ না আসুক, মুক্তোর খোঁজে কারনেসের জাহাজ আসতে পারে, হয়তো বাড়ি ফেরার একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে, এই আশায় তাকিয়ে রইলাম সাগরের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেললাম, জাহাজ আর এলো না। আর দেখলাম না তার স্কুলারটাকে।
ওই দ্বীপে কতোদিন ছিলেন আপনি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
মাত্র তিন মাস। আরেকবার আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে হয়। রাটুনা থেকে দুজন মারকুইজান এসে ক্যানুতে করে নিয়ে যায় আমাকে। একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে। মেয়েটার মারকুইজান নামের ইংরেজি অর্থ করলে হয় সাগরের হাসি, আর ছেলেটার ঝিনুক। ওরকম নামই পছন্দ ওখানকার লোকের। কঠিন নাম নয়। সহজ। বেশির ভাগই সাগর কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে রাখে। মনে রাখা বোধহয় সহজ, সে-জন্যেই। মাছ ধরতে বেরিয়েছিলো দুজনে, অ্যালবিকোর মাছ। ছোট একটা ঝড়ে পড়ে, স্রোতের মুখে পড়ে যায়। ভেসে যায় দূর সাগরে। তাতে মোটেও উদ্বিগ্ন হয়নি ওরা। ওরকম হরহামেশাই ঘটে। সাগরে ভেসে যায়, আবার বাড়ি ফেরে। সাগরও ওদের কাছে ডাঙার মতোই। ডাঙায় যেরকম সহজ ভঙ্গিতে ঘটতে পারে, পানিতেও তেমনি সাঁতরাতে পারে। পানিকে একটুও ভয় করে না। ভাসতে ভাসতে এসে আমার দ্বীপটা চোখে পড়েছিলো ওদের। পানি আর নারকেলের জন্যে চলে এসেছিলো। পেয়ে গেল আমাকে। কি হাসাটাই না হাসলো আমাকে ওখানে দেখে, যেন এক মস্ত রসিকতা। ওদের কাছে ওরকম দ্বীপে থাকাটা তো কিছু না, সেজন্যে কিছুই মনে করলো না। তবে আমি খুশি হয়েছিলাম ওদেরকে দেখে, সাংঘাতিক খুশি। সাথে করে আমাকে রাটুনায় নিয়ে গেল ওরা।