তখন আমার অবস্থা কল্পনা করতে পারছো? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে রয়েছি। কারনেসের হাতে পিস্তল, খুনের নেশা চেপেছে তার মাথায় আমার কাছে অন্ত্র বলতে কিছুই নেই। ছুরি বের করে ফেলেছে তার সাগরেদরা। পালানোর পথ নেই। লুকানোর জায়গা নেই। সারা জাহাজে এমন একটা জায়গা নেই যেখানে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে রেহাই পাবো। ঝাঁঝরা করে দেয়া হবে আমার শরীর। বুঝতে পারলাম, আমার দিন শেষ। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়লো, মুক্তোর খেত দেখেছে বটে কারনেস, কিন্তু সেটার অবস্থান জানা নেই তার। আমরা কোথায় রয়েছি, জানে না। জানি শুধু একমাত্র আমি। লগবুকে লিখিনি। তবে সেক্সট্যান্টটা দেখলে জেনে যাবে কারনেস। পরে এসে তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে। আমি যদি মরি, তাকেও পেতে দেবো না ওই মুক্তো। সেক্সট্যান্টের রীডিং ছাড়া কিছুতেই বের করতে পারবে না কারনেস; আমরা কোথায় রয়েছি। এমনিতেও মরেছি, ওমনিতেও। গুলির পরোয়া আর করলাম না। মরিয়া হয়ে দিলাম ছুট। গুলি করলো কারনেস। তাড়াহুড়োয় আবার মিস করলো। পৌঁছে গেলাম হুইলের কাছে। থাবা দিয়ে তুলে নিলাম সেক্সট্যান্টটা। সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম আনন্দে। আবার গুলি করলো কারনেস। কিন্তু ওর গুলিতে আমার মরণ লেখা নেই। ঈশ্বরের দয়া। ঠিক এই মুহূর্তে জোরে এক ঢেউ এসে বাড়ি মারলো জাহাজের গায়ে। ভীষণ দুলে উঠলো জাহাজ। পড়ে গেলাম আমি। কারনেসও পড়লো। কিন্তু তার সাগরেদরা বহাল তবিয়তেই রইলো। ছুরি নিয়ে তেড়ে এলো আমাকে খুন করার জন্যে। মোরব্বা হওয়ার চেয়ে সাগরে ঝাপিয়ে পড়ে মৃত্যু অনেক ভালো মনে হলো আমার। দ্বিধা করলাম না আর। ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম পানিতে। প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগলাম। প্রাণের ভয়ে সাঁতরাচ্ছি। উঠতে উঠতে দেরি করে ফেললো কারনেস। ততক্ষণে আমি দূরে চলে গেলাম। গুলির রেঞ্জের বাইরে যেতে পারিনি। কিন্তু অতো দূর থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে ঢেউয়ের মাঝে একটা মানুষের গায়ে লাগানো আর সম্ভব ছিলো না। তবু গুলির পর গুলি করতে লাগলো সে। আমার আশেপাশে এসে পড়লো কয়েকটা। গায়ে লাগলো না।
কিছুতেই আমাকে পালাতে দিতে রাজি নয় কারনেস। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, পাল ঠিক করছে সাগরেদরা। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে আমাকে ধাওয়া করলো। জানি, পালাতে পারবো না। ধরা আমাকে পড়তেই হবে। সাগরের মাঝে কোথায় যাবো? বাতাসও বইতে শুরু করেছে। খানিক আগে যেরকম শান্ত ছিলো সেরকম নয়। দুবার আমার পাশে চলে এলো জাহাজ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ডুব মারলাম। এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকলো কারনেস। লাগাতে পারলো না। বাতাসের বেগ বাড়লো। ভীষণ গড়াতে লাগলো জাহাজ। এই অবস্থায় রেলিঙের কিনারে দাঁড়িয়ে গুলি করা খুব কঠিন। বাতাস আরেকটু বাড়তে গুলি করা বাদ দিয়ে জাহাজ সামলাতেই ব্যস্ত হতে হলো ওকে। নইলে যাবে কাত হয়ে ডুবে কিংবা প্রবালে বাড়ি খেয়ে ছাতু হবে। ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে সরে যেতে লাগলো স্কুনারটা। আমি বাঁচবো না, জানি। তবে শান্তিতে মরতে পারবো, এই যা। সেটাও আর তেমন সুখকর কল্পনা মনে হলো না কয়েক মিনিট পরে। কিন্তু মরা ছাড়া আর করবোটাই বা কি? কল্পনা করতে পারছো? প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে। ডাঙা নেই। হাঙরের ঝাঁক। তার ওপর প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস। সাংঘাতিক না?
হ্যাঁ, মারাত্মক, স্বীকার করলো ওমর।
একেবারে ঠিক শব্দটা বলেছো। মারাত্মক। অনেকক্ষণ বলে বলে গলা শুকিয়ে এসেছে ডজের! চুমুক দিতে লাগলো গেলাসে। দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো, একটা খড়ও নেই যে ধরে ভাসবো। জাহাজডুবি হলে অনেকেই অনেক কিছু পায়, ধরতে পারে, আমার নেই। তবে চিত হয়ে থাকলে অনেকক্ষণ ভেসে থাকা যায়। যদি হাঙরে না ধরে। পানি গরম। চিত হয়ে ভেসে রইলাম। খুব আস্তে পা দিয়ে লাথি মারছি পানিতে, ভেসে থাকার জন্যে। বেশি জোরে নাড়াতে সাহস পাচ্ছি না, যদি হাঙরের নজরে পড়ে যায়। কাপড় খুলে ফেলে দিলাম, বোঝা কমানোর জন্যে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম কখন ভেসে ওঠে হাওরের পিঠের পাখনা। শাই শাই করে ছুটে আসে পানি কেটে। দুএকটা এলো কাছাকাছি, তবে কোনোটাই মানুষখেকো নয়, কামড়াতে এলো না আমাকে। দিগন্তে হারিয়ে গেল জাহাজটা। আমার চারপাশে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। আমি জানি, মরবো, তবু ইচ্ছে করে তো আর ডুবে যেতে পারি না। ভেসেই রইলাম। রাত হলো। বাতাস পড়ে গেল। শান্ত হতে লাগলো সাগর। ভেসেই রয়েছি তখনও। মনে হতে লাগলো, কেন ভেসে থাকছি? যন্ত্রণা আরও দীর্ঘ হচ্ছে! মরে গেলেই তো হয়! কিন্তু একেবারে নিরাশার মধ্যেও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। টিকে থাকতে চায়। আমারও হয়েছিল সেই অবস্থা। মরা দরকার, মরলেই ভালো হয়, কিন্তু মরতে আর পারছি না। কেউ যে আমাকে তুলে নেবে, তারও কোনো-আশা নেই। কয়েক হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে তখন কোনো জাহাজ আছে কিনা, কারনেসের স্কুনারটা ছাড়া, সন্দেহ। আর থাকলেই বা কি? জানতে পারছে না আমি রয়েছি ওখানে। বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো জাহাজ এসে আমাকে উদ্ধার করার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার কপাল ভালো, বাঁচবো, তাই এমন একটা স্রোতে পড়ে গেলাম, যেটা আমাকে টেনে নিয়ে চললো। কোথায় যাবো, জানতাম না। উত্তর মেরুর দিকে, না দক্ষিণ আমেরিকার দিকে। যেদিকেই যাই, বাঁচবো না এটা ঠিক, ধরেই নিয়েছিলাম। সকাল বেলা দেখতে পেলাম ওটাকে। কাছেই। খুব নিচু, পানির সমতল থেকে সামান্য উঁচুতে। দ্বীপটা দেখলাম না, চোখে পড়লো শুধু নারকেল গাছের মাথা। মনে হলো, পানি থেকে গজিয়ে উঠেছে। আশা হলো মনে। সাঁতরাতে শুরু করলাম সেদিকে। ভালো করেই জানি, শুধু পানিতে নারকেল গাছ জন্মাতে পারে না। ডাঙা আছেই। আজব একটা ব্যাপার ঘটলো আমার মধ্যে, বাঁচার সম্ভাবনা দেখা দিতেই। যতোক্ষণ জেনেছি, মৃত্যু নিশ্চিত, ভয়-ডর-আশঙ্কা কোনো কিছু ছিলো না। যেই বাঁচার আশা দেখলাম অমনি সেসব এসে চেপে ধরলো। সেই সঙ্গে উদ্বেগ আর উত্তেজনা। মনে হতে লাগলো গাছগুলোর কাছে। পৌঁছার আগেই হাঙরে ধরে খেয়ে ফেলবে, কিংবা ডুবে যাবো সাঁতরাতে না পেরে।