হ্যাঁ, না থাকলে এতক্ষণে হাওরের পেটে চলে যেতাম। একটা মুহূর্ত চুপ করে রইলো কিশোর। কিন্তু এত কিছু করেও লাভ হলো না। যার জন্যে এসেছিলাম তা আর নিয়ে যেতে পারব না। আগুনে পুড়ে নিশ্চয় চুণাপাথর হয়ে গেছে সব মুক্তো।
দুঃখ করে লাভ নেই, যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিলো ওমর। মুক্তো তোলার জন্যে দরকার হলে আবার আসা যাবে, টাকাপয়সা জোগাড় করে। তবে যে অ্যাডভেঞ্চারটা হল, তাতেই আমি খুশি। এই একটিবার অন্তত আমার টাকা খোয়ানোর জন্যে একলা ডজকে দায়ী করতে পারছি না। হাসলো সে। নিষ্প্রাণ দেখালো হাসিটা।
কিসের কথা বলছেন? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো সাগরের হাসি। একটু দূরে বসে ওদের কথা শুনছিলো।
মুক্তো। যেগুলো তুলেছিলাম, ওমর বললো। কিশোর বলছে, টিনটা পেয়ে গিয়েছিলো কারনেস। জাহাজে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলো। পুড়ে সব নষ্ট হয়েছে। আর পাওয়া যাবে না।
না, হয়নি, সাগরের হাসি বললো।
হয়নি! একসাথে বলে উঠলো ডজ, ওমর আর দুই গোয়েন্দা।
না, হয়নি। আমি নিয়ে এসেছি।
নিয়ে এসেছ! ডজ বললো।
কিভাবে? জানতে চাইলো ওমর।
জাহাজে উঠলাম, বললো সাগরের হাসি। পালের নিচে লুকিয়ে রইলাম। কারনেস দলবল নিয়ে দ্বীপে গেল। একটু পরে ওদের চিৎকার শুনলাম, মুক্তোর টিনটা পেয়ে গেছে। ওটা নিয়ে ফিরে এলো জাহাজে। ডেকের একটা জানালা দিয়ে দেখলাম টিনটা কোথায় রাখছে কারনেস। ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলে এক সুযোগে জানালা দিয়ে ঢুকে চট করে নিয়ে চলে এলাম ওটা।
কোথায় রেখেছ? উত্তেজনায় কাঁপছে ডজ।
লেগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি, শান্তকণ্ঠে বললো সাগরের হাসি।
চিৎকার করে উঠলো ডজ। শুনলে! কি বললো শুনলে! পানিতে ফেলে দিয়েছে। চুল খামচে ধরলো সে। এজন্যেই বুঝলে, এজন্যেই ফিরে এসেছিলো কারনেস। জাহাজ ছাড়লে কেবিনে গিয়ে টিনটা খুঁজে পায়নি। তার হয়তো সন্দেহ হয়েছে, দ্বীপে আরও কেউ আছে। যে টিনটা চুরি করেছে। সেটা নেয়ার জন্যেই ফিরেছিলো সে।
সবাই উঠে দাঁড়ালো। তাদের ভাবভঙ্গিতে অবাক হলো সাগরের হাসি। তাকাতে লাগলো একেক জনের মুখের দিকে। মুক্তো নিয়ে এরকম করে বিদেশী মানুষ, ব্যাপারটা খুব বিস্মিত করে তাকে।
হ্যাঁ, এই মুক্তোর জন্যেই ফিরে এসেছিলো কারনেস, বিড়বিড় করলো কিশোর।
আমারও তাই মনে হচ্ছে, সাগরের হাসিও একমত হলো।
তখন আমাকে বলনি কেন? বলার সময় পেলাম কোথায়? আর আর…
ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দাওনি, এই তো?
কোথায় ফেলেছ ওটা? জানতে চাইলো ডজ।
দ্বিধা করলো সাগরের হাসি। আসুন, দেখাচ্ছি।
আবার উত্তেজনা দেখা দিলো অভিযাত্রীদের মাঝে। আদিবাসীদের অনুরোধ করলো ডজ, ক্যানুটা দিতে। সেটাতে করে চলে এলো লেগুনের সেইখানটায় যেখানে নোঙর করে ছিলো হোয়াইট শার্ক। সবাই নিচে তাকাতে শুরু করলো। ওপর থেকেই দেখতে চায় লেগুনের তলায় কোথায় পড়ে আছে মুক্তোর টিনটা। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাগরের হাসি। ডুব দিলো।
হাঙরটা যদি আসে? কিশোরের প্রশ্ন।
এলে ওটার কপালে দুঃখ আছে। মেয়েটার জন্যে ভাবছো তো। ভেবো না।
দাঁড় বেয়ে ওদের সঙ্গে এসেছে ছয়জন আদিবাসী। তাদের মুখের দিকে তাকালো কিশোর। মনে পড়লো রাটুনায় অকটোপাস শিকারের কথা। বুঝতে পারলো, হাঙরটার কাপালে দুঃখ আছে কেন বলছে ডজ। সাগরের হাসির সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই ছুরি হাতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওরা।
ভেসে উঠলো মেয়েটা। ঝাড়া দিয়ে চুল থেকে পানি ফেললো। দেখেছি, বললো সে। মিনিট দুয়েক ক্যানুর ধার খামচে ধরে দম নিলো সে। তারপর লম্বা খাস টেনে গভীর পানিতে ফুসফুসটাকে বেশিক্ষণ ডুবে থাকার উপযুক্ত করে, আবার ডুব দিলো।
সবাই তাকিয়ে রয়েছে নিচের দিকে। টানটান উত্তেজনার মাঝে কাটতে লাগলো দীর্ঘ মুহূর্তগুলো। অবশেষে শেষ হল উত্তেজনা। ভাসলো আবার সাগরের হাসি। ডান হাতটা তুলে ধরলো। টিনটা বাড়িয়ে দিলো নৌকার দিকে।
প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে টিনটা নিয়ে নিলো ডজ। খুলে ফেললো ডালা। ঝকঝক করে উঠলো মুক্তোগুলো। আছে! সবই আছে! উত্তেজনায় খসখসে হয়ে গেছে তার কণ্ঠ।
পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তব লাগছে! ওমর বললো। এই অভিযানের পর কোন ঘটনাকেই আর অসম্ভব মনে হবে না আমার কাছে!
নৌকায় উঠলো সাগরের হাসি। হাঙরটা আসেনি। দেখাও যায়নি ওটাকে। হয়ত কারনেসকে দিয়ে ভূরিভোজের পর সাগরে বেরিয়ে গেছে। কিংবা আবার গিয়ে গুহায় ঢুকেছে ঘুমানোর জন্যে।
তীরে ফিরে এলো ক্যানু। টিনটা শক্ত করে ধরে রেখেছে ডজ। আর কোন ভাবেই এটাকে হাতছাড়া করতে চায় না।
আর থেকে কি হবে, ওমর বললো। রওনা হওয়া দরকার। রাতের আগেই ফিরে যেতে চাই রাটুনায়।
বিমানে এসে উঠলো অভিযাত্রীরা। সাগরের হাসি আর ঝিনুকও উঠলো ওদের সঙ্গে। দুটো নৌকাকে বাঁধা হলো এখন বিমানের লেজের সঙ্গে। এত বোঝা টেনে নিতে অসুবিধে তেমন হবে না ওটার, তবে গতি কমে যাবে। কমুক। ভাবলো ওমর। তার পরেও ঠিক সময়ে ফিরে যেতে পারবে রাটুনায়, যদি আর। ঝড়টড় না ওঠে। আকাশের দিকে তাকালো। ঘন নীল রঙ। মেঘের চিহ্নও নেই। সহসা আর হারিকেনের সম্ভাবনা নেই।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ওমর। চলতে শুরু করলো বিমান।
মিনিট পনের পরে উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকালো কিশোর। নারকেলের পাতা দুলতে দেখলো বাতাসে। ধীরে ধীরে দিগন্তে মিলিয়ে গেল ওগুলো। ততক্ষণ চেয়েই থাকলো সে। অদ্ভুত এক বিষন্নতায় ভরে গেছে মন। ভাবছে আর কোনদিন দেখতে পাবে না দ্বীপটা।