নৌকা নিয়ে আসার নির্দেশ দিলো কারনেস। ফিরে এলো লংবোট। তাড়াতাড়ি দলবল নিয়ে গিয়ে তাতে চাপলো কারনেস। জাহাজে গিয়ে উঠলো। দূরবীন দিয়ে ভাল করে দেখলো বিমানটাকে। পেছনের ক্যানুতে বসা লোকগুলোকেও দেখলো। প্রমাদ গুণলো সে। বুঝতে পারলো সামনাসামনি লড়াইয়ে পারবে না ওদের সঙ্গে। তাড়াতাড়ি জাহাজ ছাড়ার নির্দেশ দিলো সে।
লেগুনের মুখের কাছে যাওয়ার আগেই পৌঁছে গেল বিমানটা। নারকেল গাছ থেকে নামলো না কিশোর আর সাগরের হাসি। ওখানে বসে বসেই সমস্ত ঘটনা দেখতে লাগলো।
তার পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। গুলি করতে করতে জাহাজের দিকে এগিয়ে এলো বিমান। কারনেস এতই ভয় পেয়ে গেছে, গুলি চালানোর কথাও যেন ভুলে গেল। তার লোকেরা গিয়ে ঢুকেছে জাহাজের খোলে। আদিবাসীদের যুদ্ধের সাজই ঘাবড়ে দিয়েছে ওদেরকে। তাছাড়া জেনে গেছে অনেকগুলো আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বিমানে। শুধু কারনেসের একটা রাইফেল আর একটা পিস্তল দিয়ে ঠেকানো যাবে না ওদেরকে। তাছাড়া লোকবলও বেশি বিমানের। ফলে যা করার তাই করেছে ওরা। লুকিয়েছে গিয়ে।
জাহাজের কাছে চলে এলো বিমান। দড়ি খুলে ক্যানুটাকে নিয়ে গিয়ে জাহাজের গায়ে ভেড়ালো আদিবাসীরা। উঠে গেল জাহাজে।
মিনিট কয়েক পরেই দেখা গেল, ডেকে তুলে আনা হয়েছে কারনেসের গলাকাটা ডাকাতদের। হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হলো।
কিন্তু পালের গোদাটা গেল কোথায়? খুঁজছে কিশোরের চোখ। দেখতে পেলো। জাহাজের পাশের একটা দড়ি ধরে ঝুলে রয়েছে, পেছন দিকটায়। পানির একেবারে কাছাকাছি। তবে বেশিক্ষণ বাঁচতে পারলো না। আদিবাসীদের চোখে পড়ে গেল।
ধর! ধর! কলরব উঠলো। দড়ি থেকে হাত ছেড়ে দিলো কারনেস। পড়লো পানিতে। সাঁতরাতে শুরু করলো তীরের দিকে।
এই সময় পাখনাটা ভেসে উঠতে দেখলো কিশোর। লেগুনের পানি কেটে দ্রুত ছুটে চলেছে ত্রিকোণ পাখনাটা, পালের মতো উঁচু হয়ে আছে। হাঙর! ছুটে যাচ্ছে কারনেসের দিকে। যেন ওরই জন্যে অপেক্ষা করছিলো এতোক্ষণ ওটা। তাহলে কিশোররা যখন পানিতে নেমেছিলো তখন ছিল কোথায়? নিশ্চয় গুহার ভেতরে, ভাবলো কিশোর, এর আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
জাহাজে যারা রয়েছে তারাও দেখতে পেয়েছে। একসঙ্গে হৈ চৈ করে উঠলো ওরা। অনেক পরে দেখতে পেলো কারনেস! আতঙ্কে বিকট চিৎকার করে উঠলো। তাড়াতাড়ি হাত পা ছুড়ে তীরে পৌঁছার চেষ্টা করলো। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। তীর অনেক দূর।
তার কাছে চলে এসেছে হাঙরের পাখনা। ডুবে গেল। পরক্ষণেই ঝটকা দিয়ে নিচে ডুবে গেল কারনেসের মাথা। আবার ভাসলো। চিৎকার করে উঠলো। আবার ডুবলো। ভাসলো। চিৎকার। ডুবলো।
অপেক্ষা করে রয়েছে দর্শকেরা। কিন্তু আর ভাসতে দেখা গেল না তাকে।
উচিত সাজা হয়েছে! পাশের গাছ থেকে বললো সাগরের হাসি। কিশোর কিছু বলতে পারলো না। তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে। কারনেসের মত লোকেরও এই পরিণতি মেনে নিতে পারছে না সে। ভীষণ খারাপ লাগছে।
হৈ হৈ করে উঠল জাহাজে দাঁড়ানো আদিবাসীরা। চেঁচিয়ে বলছে, ঠিক হয়েছে। উচিত সাজা হয়েছে! শয়তানটাকে খেয়েছে ম্যাকো!
বন্দিদেরকে লংবোটে নামাতে শুরু করলো ওরা। ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো না কিশোর। সব কজনকে নামিয়ে নিজেরাও নেমে এলো ক্যানু আর লংবোটে। একজন বাদে। সে চলে গেল নিচে।
একটু পরেই বুঝতে পারলো, কেন জাহাজটা থেকে সবাইকে নামিয়ে আনা হয়েছে। শেষ লোকটাও বেরিয়ে এসে তাড়াহুড়া করে নৌকায় নামলো। সরে আসতে লাগলো দুটো নৌকাই। ক্যানু থেকে চেঁচিয়ে কিছু বললো ঝিনুক। বিমানটাও সরে আসতে লাগলো জাহাজের কাছ থেকে।
কারণটা বুঝতে পারলো এতক্ষণে কিশোর। ধোয়া দেখা গেল। জাহাজে। আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। গাছের মাথায় থেকেই চিৎকার করে বললো সে, ওমরভাই! জলদি! আগুন নেভাতে বলুন!
কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দের জন্যেই বোধহয়, লোকের হট্টগোলের জন্যেও হতে পারে, তার চিৎকার কানে গেল না কারও। আগুন নেভাতে গেল না কেউ।
পিছলে গাছ থেকে নামতে গিয়ে দুই উরু ছিলে গেল কিশোরের। কেয়ারই করলো না। গোড়ায় নেমেই দিলো, দৌড়। সৈকতের কিনারে পৌঁছতে পৌঁছতেই আগুন ছড়িয়ে পড়লো অনেকখানি। ডেকের নিচে বোঝাই করা নারকেলের ছোবড়ায় নিশ্চয় আগুন লাগানো হয়েছে।
কিনারে এলে ডজকে যখন বোঝাতে সমর্থ হলো কিশোর, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সমস্ত জাহাজে জড়িয়ে গেছে আগুন। ওটাতে এখন গিয়ে ঢোকা আর আত্মহত্যা করা সমান কথা।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে ডজ। তার চোখের সামনে পুড়লো জাহাজটা, ডুবে গেল, কিছুই করলো না সে। একেবারে চুপ। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে যেন। চেয়ে চেয়ে দেখলো তার অত সাধের মুক্তোগুলো নিয়ে তলিয়ে গেল জাহাজটা।
কিশোরের কানে বাজতে লাগল ডজের কথাঃ যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে গেল মুক্তো, রাখতে আর পারলাম না।
পাশে এসে দাঁড়ালো সাগরের হাসি। এইমাত্র গাছ থেকে নেমে এলো।
নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্যাম্পের কাছে নারকেল গাছের ছায়ায় বসে কিশোরকে জানালো ওমর আর মুসা, কেন আসতে দেরি হয়েছে ওদের।
কিশোর বলতে লাগলো, সে কি করে মরতে মরতে বেঁচেছে।
খাইছে! শুনতে শুনতে বলে উঠলো মুসা। সাগরের হাসি না থাকলে তো…