কি করা যায়? ভাবতে শুরু করলো কিশোর। নৌকা নিয়ে দ্বীপে পৌঁছতে দেরি হবে না লোকগুলোর। ধরে ফেলবেই। তবে যতক্ষণ দেরি করিয়ে দেয়া যায়। সকাল পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলে, আর ওদের কপাল ভাল হলে ওমর ভাই এসেও যেতে পারে। কিংবা লোকজন নিয়ে ঝিনুক। দ্বীপের সরু অংশটায় রয়েছে ওরা। চওড়া দিকটায় যাবে বললো সাগরের হাসিকে। ছুটলো। ওদিকে উঁচুনিচু অনেক টিলাটক্কর রয়েছে। লুকানোর জায়গা মিলতে পারে।
গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটছে দুজনে। যাতে গুলি করতে না পারে কারনেস। ঝড়ে নানারকম জঞ্জাল এনে ফেলেছে বালিতে। নারকেল পাতা, শ্যাওলা, ঝিনুকের খোসা। সেসবের জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছে দৌড়ান। কিন্তু কোন কিছুই ঠেকাতে পারলো না ওদেরকে। চলে এলো দ্বীপের চওড়া দিকটায়। বেশ উঁচু একটা টিলা রয়েছে ওখানে। ঢালের গায়ে মিশে থেকে আস্তে মুখ বাড়িয়ে তাকালো কিশোর। দেখলো, পৌঁছে গেছে লংবোট। টেনে সৈকতে তুলছে নাবিকেরা। রাইফেল বগলে চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে কারনেস।
চলেই তো গিয়েছিল, বিড়বিড় করে বললো কিশোর। আবার ফিরে এলো কেন ব্যাটা?
চুপ করে রইলো সাগরের হাসি।
ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে কিশোরের মগজে। এই দ্বীপে বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকা অসম্ভব। জায়গাই নেই তেমন। নারকেল গাছে চড়ে বসে থাকতে পারে। বড়জোর রাতটা টিকতে পারবে তাতে। আলো ফুটলেই চোখে পড়ে যাবে। জ্যান্ত নামার আর সুযোগ পাবে না তখন। গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে গাছ থেকে। লুকানোর আরেকটা জায়গা হলো দ্বীপের নিচের গুহাঁটা। ওতে লুকালে হয়তো কয়েকদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে, যদি নাবিকেরা ডুব দিয়ে খুঁজতে না আসে। ওখানে লুকানোর সব চেয়ে বড় বিপদ হল হাঙর। ঝড়ের সময় ঢুকেছিলো। এখনও লেগুনেই আছে, না বেরিয়ে গেছে? থাকলে ওদেরকে ধরলো না কেন? কয়েকবার তো লেগুনে নামতে হয়েছে ওদেরকে। থাকুক না থাকুক, ওখানেই গিয়ে লুকানোর সিদ্ধান্ত নিলো কিশোর। কারনেসের হাতে ধরা দিলেও মরতে হবে। তার চেয়ে গুহায় ঢোকার ঝুঁকিটাই নেয়া যাক। ভাগ্যে যদি থাকে হাঙরের পেটে যাওয়া, ঠেকাতে তো আর পারবে না।
কিন্তু এগোতে গিয়ে থমকে গেল সে। কি করে আন্দাজ করেছে কারনেস, কে জানে। কিংবা এমনিই হয়তো একজন লোককে পাহারায় রেখেছে ওদিকটায়, যেদিক দিয়ে গুহায় যেতে হয়। অন্যখান দিয়ে পানিতে নেমেও যাওয়া যায়। তবে যেদিক দিয়েই যাক, চাঁদের আলোয় কারনেসের লোকের চোখে পড়ে যাবেই ওরা।
কিশোরের মত একই ভাবনা চলেছে সাগরের হাসির মাথায়। বললো, নারকেল গাছে চড়তে হবে। তার পর সুযোগ বুঝে চলে যাব গুহায়। সকাল হতে দেরি আছে। অনেক সময় পাওয়া যাবে।
তা ঠিক। টিলার পাশ দিয়ে চলে এলো দুজনে একটা নারকেল কুঞ্জের ভেতরে। দুজনে দুটো গাছ বেছে নিয়ে চড়তে শুরু করলো।
কিশোরের অনেক আগেই উঠে গেল সাগরের হাসি। পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসলো। একেবারে মিশে গেছে। কিশোরও দেখতে পাচ্ছে না। ভালমত আলো না ফুটলে তাকে বের করতে পারবে না কারনেসের লোকেরা।
সাগরের হাসির মত একই ভাবে পাতার আড়ালে ঢুকলো কিশোর। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে এখন পুরো দ্বীপটা। খোঁজাখুঁজি করছে নাবিকেরা। রাইফেল হাতে পায়চারি করছে কারনেস।
ওদের গাছের নিচে চলে এলো একজন। ওপরের দিকে তাকাল। কিশোরের ভয় হতে লাগলো দেখে ফেলবে। পা বাড়াতে গিয়ে আচমকা চিৎকার করে উঠলো লোকটা। ধক করে উঠলো কিশোরের বুক। দেখে ফেললো? না। বসে পড়েছে লোকটা। পায়ের পাতা উল্টে দেখার চেষ্টা করছে। নিশ্চয় ভাঙা শামুকে পা কেটে গেছে।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে গেল লোকটা।
কি হলো? জিজ্ঞেস করলো কারনেস। চেঁচালে কেন?
পা কেটে ফেলেছি।
ওরা কোথায়?
দেখিনি।
হু। যাবেটা কোথায়? দিনের বেলা খুঁজে বের করবো।
একটা পাথরের ওপর গিয়ে বসলো কারনেস। রাইফেলটা কোলের ওপর রেখে সিগারেট ধরালো। খুঁজেই চলেছে তার লোকেরা।
ধীরে ধীরে মাথার ওপরে উঠল চাঁদ। চলতে শুরু করল পশ্চিমে। মলিন হয়ে আসছে জ্যোৎস্না। কিশোরের মনে হচ্ছে বড় বেশি দ্রুত যেন ডুবতে চলেছে চাঁদটা। কেটে যাচ্ছে রাত। অনেকবার বিপদে পড়েছে জীবনে। রাত যেন তাড়াতাড়ি কাটে সেই প্রার্থনা করেছে তখন। আজ করতে লাগলো, না কাটার জন্যে। কারণ রাত ফুরিয়ে গেলেই মরতে হবে।
১৫
কিছুক্ষণ থেকেই ইঞ্জিনের শব্দ কানে আসছিলো কিশোরের। বিমানটা আসছে ভেবে বার বার আকাশের দিকে তাকিয়েছে। কিছুই চোখে পড়েনি। কারনেসকেও চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখেছে। কয়েকবার করে পাথরের ওপর থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়েছে।
আরও বাড়লো শব্দ। সাগরের দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো ওটাকে। পুব আকাশে তখন ভোরের আলোর আভাস। আকাশ দিয়ে নয়, জলপথে ছুটে আসছে বিমানটা। ট্যাক্সিইং করে।
এইবার আর স্থির থাকতে পারলো না কারনেস। একজনকে পাঠালো জাহাজে, কিসের শব্দ দেখে আসার জন্যে। দরকার হলে যেন মাস্তুলে চড়ে দেখে, সেকথাও বলে দিলো।
দাঁড় বাওয়ার জন্যে আরেকজন নাবিককে সঙ্গে করে রওনা হলো লোকটা। লংবোট নামিয়ে তাতে চেপে বসলো। কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেল জাহাজে। মাস্তুলে ওঠা আর লাগলো না তার। জাহাজের ডেক থেকেই দেখতে পেলো বিমানটাকে। চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। আঞ্চলিক ভাষায় চেঁচিয়ে জানালো কারনেসকে কি দেখতে পেয়েছে।