চল, ডাঙায় চল। কারনেস দেখে ফেলবে।
তীরে এসে উঠলো দুজনে। চলে এলো নারকেল গাছের আড়ালে।
তুমি এলে কোত্থেকে? জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর।
আমি যাইইনি। এখানেই ছিলাম।
কোথায়? কিশোর অবাক।
কারনেসের জাহাজে। পালের নিচে লুকিয়ে ছিলাম।
আনমনে মাথা নাড়লো কিশোর। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না এভাবে মুক্তি পেয়ে যাবে।
ঝিনুক কোথায় তাহলে?
রাটুনায় চলে গেছে।
কিন্তু জাহাজে গেলে কি করে তুমি? উঠলে কখন?
তুমি ধরা পড়তেই ডুব দিয়ে সরে এলো ঝিনুক। আমাকে বললো। সাঁতরে গিয়ে লুকিয়ে জাহাজে উঠলাম, দেখতে লাগলাম তোমাকে নিয়ে কি করে ওরা। ওরা ঘুমাতে যাওয়ার পরেও জাহাজ থেকে নামলাম না। রাতে নৌকা নিয়ে চলে গেল ঝিনুক। আমাকে থাকতে বলে গেল। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে।
ভাগ্যিস থেকেছিলে! নইলে এতক্ষণে শেষ হয়ে যেতাম!
হেসে উঠলো সাগরের হাসি। জানালো, ঝিনুক লোক নিয়ে ফিরে আসবে। অশান্ত সাগরকে বলে অনেক যোদ্ধা নিয়ে আসবে, বলে গেছে। এবার আর ছাড়বে কারনেসকে। অনেক জ্বালান জ্বালিয়েছে সে।
ও চলেই গেছে, না? অন্ধকার সাগরের দিকে তাকালো কিশোর। জাহাজটা চোখে পড়লো না।
হ্যা। ঝিনুক এসে ওকে খুঁজে বের করবে।
কারনেসের জাহাজে রয়েছে ওরা? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো ওমর। মুশকিল হয়ে গেল।
হ্যাঁ, মাথা নাড়লো মুসা। জাহাজ থেকে কিশোর আর সাগরের হাসিকে উদ্ধার করা কঠিনই। কারনেস মেরেই ফেলে কিনা ওদেরকে কে জানে!
কি করা যায়, বল তো? ওমরের দিকে তাকালো ডজ। নৌকা নিয়ে গিয়ে জাহাজটাকে ধরা যাবে না।
বিমানটা নিয়ে যেতে হবে।
কি করে? মেরামত করতেই তো অনেক সময় লেগে যাবে। ততোক্ষণে অনেক দূরে চলে যাবে কারনেস।
উড়তে পারবো না, কিন্তু ট্যাক্সিইং করে যেতে অসুবিধে কোথায়? পাতার দঙ্গল থেকে ওটাকে বের করে নিয়ে গিয়ে খোলা পানিতে ফেলতে পারলেই তো হয়ে গেল।
তাই তো। এটা তো ভেবে দেখিনি।
অভয় পেয়ে বেরিয়ে এসেছে গাঁয়ের লোকে। যুদ্ধে যাওয়ার আর দরকার নেই, ওদেরকে বোঝাল ওমর। অশান্ত সাগরকে অনুরোধ করলো, কিছু লোক দিতে, যাতে নৌকা নিয়ে গিয়ে বিমানটাকে সরিয়ে আনতে পারে। ওটার চারপাশের জঞ্জাল সাফ করে দিতে পারলেই হলো, এর বেশি আর কিছু করা লাগবে না।
খুশি হয়েই লোক দিলো অশান্ত সাগর। ওদেরকে নিয়ে রওনা হলো আবার ডজ, ওমর আর মুসা। তবে অবশ্যই খাওয়া-দাওয়ার আর খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর। তাদের সঙ্গে চললো ঝিনুক।
বনের ভেতর দিয়ে গেল না আর। অত্যন্ত দুর্গম পথ, বললো অশান্ত সাগর। পারতপক্ষে ওই বনে কেউ ঢুকতে চায় না, একথাও জানালো। সৈকতে চলে এলো দলটা। সাথে এসেছে তিরিশজন অদিবাসী, সবাই যুদ্ধের সাজে সেজেছে। ঝিনুকের সঙ্গে লড়াই করতে যেতে চেয়েছিলো। যেতে পারলো না বলে কিছুটা নিরাশ হয়েছে যেন।
কয়েকটা ক্যানুতে চড়লো সবাই। যুদ্ধে যেতে পারেনি তাতে কি হয়েছে, আরেকটা বিশেষ কাজ তো করতে যাচ্ছে। সেটাকে লড়াইয়ের সামিল ধরে নিলো বোধহয় যোদ্ধারা, দাঁড় বাইতে বাইতে বিচিত্র ভাষায় সুর করে যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে চললো।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিমানের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। পাতার দঙ্গল যতই পুরু হোক, এতগুলো মানুষের কাছে টিকতে পারলো না বেশিক্ষণ। পরিষ্কার করে ফেলা হলো আশপাশের অনেকখানি জায়গা। তারপর বিমানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে তিনটে ক্যানু টেনে সরিয়ে আনলো ওটাকে পরিষ্কার পানিতে।
রাত হয়ে গেল কাজ সারতে সারতে। পুরোপুরি অন্ধকার। কিন্তু ভোরের অপেক্ষায় আর থাকতে চায় না ওমর। তখুনি রওনা দেবে ডজ আইল্যান্ডে। তার পরিকল্পনার কথা খুলে বললো সে। বড় একটা শক্ত ক্যানু বাঁধা হলো বিমানের পেছনে। দশজন আদিবাসীকে উঠতে বলা হলো তাতে। ঝিনুক ও আরও চারজন আদিবাসী সহ মুসা আর ডজকে নিয়ে বিমানে উঠলো ওমর। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো খোলা সাগরের দিকে। টেনে নিয়ে চললো ক্যানুটাকে।
চাঁদ উঠলো। নারকেল কুঞ্জের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর আর সাগরের হাসি। দ্বীপের সেদিকটায় চললো যেখানে থেকে সাগরের অনেকদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালো। ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো কিশোরের বুক। লেগুন থেকে সাগরে বেরোনোর মুখটার কাছে রয়েছে স্কুনারটা। যায়নি। থেমে আছে। ওদের কাছ থেকে বড়জোর একশো গজ দূরে।
ঝপ করে বড় একটা পাথরের আড়ালে বসে পড়লো সাগরের হাসি। কারনেস ফিরে এসেছে! ফিসফিস করে বললো সে।
কিশোরও বসলো তার পাশে। স্তব্ধ হয়ে গেছে। এটা আশা করেনি। একটা চিৎকার উঠলো জাহাজে। যতই লুকাক, চোখে পড়ে গেছে ওরা।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সাগরের হাসি। দৌড় দাও! যত জোরে পার! চিৎকার করে বললো কিশোর। বলেই ছুটলো।
পেছনে গর্জে উঠলো একটা রাইফেল। কাছেই একটা প্রবালের চলটা তুলে দিয়ে বিইইং করে সাগরের দিকে উড়ে গেল বুলেট। ফিরেও তাকালো না কিশোর। আবার গুলি হলো। কয়েক গজ দূরে আরেকটা প্রবালের চলটা তুললো বুলেট। চাঁদের আলোয় ছুটন্ত নিশানার গায়ে গুলি লাগানো সহজ নয়।
কয়েকটা নারকেল গাছের আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো দুজনে। তাকালো জাহাজটার দিকে। নোঙর তুলে ফেলেছে ওটা। প্রণালী দিয়ে লেগুনে ঢুকেছে।
কিছু দূর এগিয়ে লেগুনের শান্ত পানিতে এসে আবার থামলো জাহাজ। লংবোট নামাতে ব্যস্ত হলো নাবিকেরা। চেঁচিয়ে আদেশ দিচ্ছে কারনেস। ভীষণ রেগে গেছে সে। এবার ধরতে পারলে গুলি করে মারবে, কোন সন্দেহ নেই।