কদিন ধরে একনাগাড়ে মদ গিলে চলেছে কারনেস। ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে জাহাজ চালানোে আমি শিখে গেছি ভালোমতোই। চালাচ্ছি। আর কোনো উপায়ও ছিলো না। জাহাজে তখন একমাত্র আমিই সুস্থ রয়েছি। বাকি সবগুলোর অবস্থা কাহিল। কোনখান দিয়ে চলেছি আমরা কিছুই বুঝতে পারবে না কারনেস, বাইরে না বোরোলে। আর বেরোনোর মতো অবস্থাও তখন নেই তার। দ্বীপটার কাছ ঘেঁষে গেলাম, পাঁচশো মাইল দূর দিয়ে গেলাম, কিছু জানবে না। না জানায় ভালোই হয়েছে আমার জন্যে, পরে বুঝতে পারবে। সাগর মোটামুটি শান্ত। তখন ঠিক দুপুর। প্রচন্ড গরম। দ্বীপটাকে কাছে থেকে দেখলাম। প্রবালে তৈরি, অ্যাটল বলে ওগুলোকে। পাশ দিয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে জাহাজ। মনে হয় জাহাজটাই স্থির হয়ে আছে, দ্বীপটা ভেসে যাচ্ছে। চার্টে অবস্থান দেখে নিলাম। সেক্সট্যান্টটা রাখলাম হুইলের কাছে। কখন আবার উঠে এসে রীডিং দেখতে চায় কারনেস কে জানে। সব কিছু রেডি রাখলাম। কে বকা শুনতে যায় খামোকা। লংগি চিউড আর ল্যাটিচিউড দুটোই মনে রাখলাম। পরে লগবুকে লিখে নেবো। ওরকম বহুবার করেছি। কখনো ভুল হয়নি। ডেকেই ছায়ায় শুয়ে পড়লাম। বাতাসের অপেক্ষায় রয়েছি। ভালো বাতাস না হলে ঠিকমতো চলবে না জাহাজ। কেন, নিশ্চয় বুঝতে পারছে। হোয়াইট শার্ক স্কুনার জাতের জাহাজ। ইঞ্জিন থাকলেও পালের দরকার হয়। নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি। অলস ভাবনা। কারনেসের কথা, আমার কথা, আরও অনেক কথা। ডেকের কিনারে উপুড় হয়ে রয়েছি। হঠাৎ এমন একটা জিনিস চোখে পড়লো, ধক করে উঠলো বুক। আরেকটু হলেই বোধহয় কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে সাগরে পড়ে যেতো চোখ। সাগরের যেখানটায় সাংঘাতিক গভীর থাকার কথা, আচমকা যেন সেখানটা উঠে চলে এসেছে কোন জাদুমন্ত্রের বলে! জাহাজের, খোলের নিচেই একেবারে, পঁচিশ-তিরিশ ফুট গভীর হবে। আরেকটু উঠলেই ঘষা লাগবে জাহাজের তলায়। উঠে গিয়ে যে হুইল ঘোরাবো, সে কথাও মনে রইলো না। এতোই অবাক হয়েছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যেমন হঠাৎ উঠলো তেমনি হঠাৎ করেই নেমে গেল সাগরের তল। বিশ্বাস করলাম না। ভাবলাম, গরম আর রোদ এমন কিছু করেছে, যাতে চোখে ভুল দেখেছি। কিন্তু। ডেকের কিনারে বসে তাকিয়েই রইলাম। মনে হতে লাগলো আবার দেখতে পাবো। ঘটলোও তাই। অদ্ভুত কান্ড। মুহূর্তের জন্যে দেখা যায় তল, তারপরই মিলিয়ে যায়, আবার দেখা যায়, আবার গায়েব। গায়ে কাঁটা দিলো। ব্যাপারটা কি! হঠাৎই বুঝে ফেললাম। সাগরের তল উঠছে নামছে তা নয়। ঢেউ। অনেক চওড়া আর উঁচু ঢেউ। খুব ধীরে আসছে। সেজন্যেই জাহাজটা যে একবার উঠছে ঢেউয়ের মাথায়, একবার নামছে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। যখন ঢেউয়ের নিচে নামছে, তখন তল চোখে পড়ছে, ওপরে উঠলেই হারিয়ে যাচ্ছে আবার। আর উঁচু কতো জানো একেকটা ঢেউ? চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট। নিচে কিন্তু বালির চড়া নয়, প্রবাল। ঘাবড়ে গেলাম। ভীষণ ধারালো। কোনোমতে যদি একটা ঘষা লাগে জাহাজের তলায়, তরমুজের মতো চিরে ফেলবে। আর আছড়ে পড়লে গুড়িয়ে যাবে ডিমের খোসার মতো। এখানে জাহাজ সামলানো আমার কর্ম নয়। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম।
ছুটে এলো কারনেস আর তার দলবল। যতোটা মাতাল ভেবেছিলাম ওদেরকে ততোটা হয়নি। চেঁচিয়ে শুধু বলতে পারলাম, জাহাজ সামলাও! কি হয়েছে জানতে চাইলো কারনেস। ডেকের কিনারে এসে দেখতে বললাম। এলো ওরা। পাথর হয়ে গেল যেন আমারই মতো। ওদের মতো মানুষও অবাক হয়েছে বুঝতে পারলাম। আর আমার তো কথাই নেই। তাকিয়ে রয়েছি নিচের দিকে। কি দৃশ্য, বলে বোঝাতে পারবো না। লাল, নীল, সবুজ, আরও কতো রঙ প্রবালের না দেখলে বুঝবে না। যেন এক অপরূপ বাগান তৈরি হয়ে আছে সাগরের তলায়। প্রবাল দেখে অবাক হইনি, ওরকম অনেক দেখেছি দক্ষিণ সাগরে। অন্য জিনিস দেখে হয়েছি। ঝিনুক। হাজারে হাজারে, বাসনের সমান বড় একেকটা। একেকজোড়া করে গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে। ভালো করে তাকাতে বুঝলাম ব্যাপারটা কি। খুলে রয়েছে ঝিনুকগুলো, খোসাগুলো ফাঁক করে চিত হয়ে আছে। খাওয়ার জন্যে ওরকম করে খুলে যায় ওরা। খুব ভালো করেই জানি ওরকম ঝিনুকের ভেতরেই মুক্তো থাকে। সাগরের তলায় তিল ধারণের জায়গা নেই, শুধু ঝিনুক আর ঝিনুক, খুলে রয়েছে। খোলা জায়গায়, প্রবালের খাঁজে, যেখানেই ঠাই, পেয়েছে শুধু ঝিনুক আর ঝিনুক, সোয়ালো পাখির বাসার মতো আঁকড়ে রয়েছে যেন প্রবালের গা। কতো লক্ষ-কোটি ডলারের সম্পদ পড়ে রয়েছে ওখানে কল্পনা করে পা কাঁপতে লাগলো আমার, দুর্বল হয়ে এলো, যেন দেহের ভার রাখতে পারবে না। মনে হতে লাগলো এরকম দৃশ্য শুধু স্বল্লেই দেখা সম্ভব। এতো কিছুর মধ্যেও কি এক অদ্ভুত উপায়ে যেন সজাগ হয়ে গেল আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। অকারণেই ঝট করে ফিরে তাকালাম কারনেসের দিকে। একেবারে সময় মতো। তাকিয়ে ভালো করেছিলাম। তার চোখে এক ধরনের বন্য দৃষ্টি, কলজে ঠান্ডা করে দেয়। ওরকম আর কখনো কোনো মানুষের চোখে দেখতে চাই না আমি। হাত চলে গেছে পকেটে। ওখানেই তার পিস্তলটা থাকে, জানি আমি। চেহারাটা কুৎসিত হয়ে উঠেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, খুব বেশি নেই এখানে, কি বলো? আমাদের দুজনের নেয়ার মতো হবে না। লাফিয়ে সরে গেলাম। আর একটা মুহূর্ত দেরি হলেই গুলি খেতে হতো। অল্পের জন্যে মিস হয়ে গেল বুলেট।