উঠে দাঁড়ালো ওমর। শক্ত হয়ে গেছে শরীর, নড়তেই চায় না। ঝড়াঝুড়া দিয়ে হাত-পাগুলোকে সচল করলো। চল, রওনা হওয়া যাক।
ভোর তখনও হয়নি। শুধু অন্ধকার ফিকে হয়েছে কিছুটা। এরই মাঝে বন কেটে এগোতে শুরু করলো ওরা।
গত দুদিনে শরীরের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। আর সহ্য করতে পারছে না শরীর। বন থেকে বেরোতে যদি বেশি দেরি হয়, তাহলে আর বেরোতেই পারবে না। তবে বন আর বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখলো না ওদের। পাতলা হয়ে এলো। বাইরের খোলা অঞ্চলে বেরিয়ে ধপ করে বসে পড়লো মুসা। চিত হয়ে শুয়ে পড়লো বালিতে। চারপাশে তাকাচ্ছে ডজ। পানি খুঁজছে। একপাশে জলা ছাড়া পানির আর কোন উৎস চোখে পড়লো না। সেই জলার পানি ছুঁয়েও দেখলো না। গিজগিজ করছে জীবাণুতে। খেলেই মরবে।
কয়েক মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিলো ওরা। তারপর উঠল।
সান্ত্বনা দিয়ে ওমর বললো, আর বেশিক্ষণ লাগবে না। গায়ের কাছে চলে এসেছি। গিয়েই পানি খেতে পারব।
পা টেনে টেনে এগিয়ে চললো তিনজনে। প্রথম নারকেল গাছটার গোড়ায় এসেই দাঁড়িয়ে গেল। ঝড়ে অনেক নারকেল পড়ে রয়েছে। তর সইলো না আর। খেতে বসে গেল। প্রথমে খেল পানি, তার পরে শাস। লোভীর মত।
গায়ের কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়ালো মুসা। তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। সে কি দেখেছে দেখার জন্যে অন্য দুজনও তাকালো। ঘন গাছের আড়ালে ছায়ার মত মিশে যেতে দেখলো একজন আদিবাসীকে। ঝিনুকদের গায়ের মানুষের চেয়ে অন্য রকম মনে হলো লোকটাকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত শাদা চক কিংবা কাদা দিয়ে অদ্ভুত সব দাগ আঁকা।
আমার ভাল্লাগছে না, বিড়বিড় করে বললো ডজ। কিছু একটা ঘটছে এখানে।
কি ঘটছে? জানতে চাইলো ওমর।
লোকটাকে দেখলে? কেমন রঙ মেখেছে। যুদ্ধের সাজ। হাতের মুগুরটাও লড়াইয়ের সময় ব্যবহার করে। বহু দেখেছি ওরকম। আইনের বিরুদ্ধ কাজ এটা। তার পরেও লেগে যায় ওরা। ডজের কথার সমর্থনেই যেন দিড়িম দিড়িম করে ঢাক বেজে উঠলো। কয়েকবার বেজে থেমে গেল। দূর থেকে শোনা গেল আবার। থামলো। বিরতি দিয়ে আবার বেজে উঠলো এপাশে। শুনছো? মেসেজ পাঠাচ্ছে। সংবাদ আদান প্রদান করছে। আমরা এখান থেকে যাওয়ার পর নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে, যার ফলে খেপে গেছে লোকগুলো। আমাদের ওপর এখন কোন কারণে খেপে না গেলেই হয়। তাহলে সোজা ধরে কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলবে।
এখন তো আর নরখাদক নয় ওরা, বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
তার দিকে তাকালো ডজ। জোর দিয়ে বলতে পার না। কেউ স্বীকার করে না বটে। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোকে অবশ্য বাদ দেয়া যায়। তবে বুড়োগুলোকে বিশ্বাস নেই। মানুষের মাংসের লোভ আছে ওদের। আগে খেয়েছে তো। কর্তৃপক্ষ কড়া নজর রেখেছে ওদেরকে ঠেকানোর জন্যে। তার পরেও বলা যায় না।
ওসব ভেবে লাভ নেই, ওমর বললো। তবে গলায় জোর নেই তার। চল, গিয়ে দেখি কি হয়েছে।
গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুজন আদিবাসী। ওদের ঠিক সামনে। দুজনের গায়েই রঙ মাখা, হাতে মুগুর। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অভিযাত্রীদের দিকে, তারপর ছুটে পালালো।
গায়ে এসে ঢুকলো অভিযাত্রীরা। কোন পুরুষমানুষ চোখে পড়লো না। শুধু দুতিনজন মহিলা। ঢাকের আওয়াজ হচ্ছে না আর।
সব চেয়ে বয়স্ক মহিলাটার কাছে এগিয়ে গেল ওমর। জিজ্ঞেস করলো, গাঁয়ের লোক কোথায়?
জবাব দিলো না মহিলা। আরেক দিকে মুখ ফেরালো।
ঝোপের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললো তখন ওমর, অশান্ত সাগর, আমি জানি আপনারা কাছাকাছিই আছেন। আমাদের ওপর চোখ রাখছেন। বেরিয়ে আসুন।
ঝোঁপ ফাঁক করে বেরিয়ে এল একটা ছিপছিপে শরীর। এক তরুণ। শাদা রঙ দিয়ে বন্ধনী আঁকা হয়েছে কপালে। সারা শরীরে দাগ।
বিশ্বাস করতে পারছে না যেন ওমর। ঝিনুক, তুমি!
হ্যাঁ, আমি, এগিয়ে এলো ঝিনুক।
যুদ্ধ ঘোষণা করেছ কার বিরুদ্ধে? ডজ জিজ্ঞেস করলো।
ওই শয়তানটার।
কোন শয়তানটার?
গুডু কারনেস।
১৪
দম ফুরিয়ে এসেছে কিশোরের। মৃত্যু অবধারিত। ছটফট করছে না আর মুক্তি পাওয়ার জন্যে। লাভ নেই। ভাবছে, মরতে কি খুব কষ্ট হবে? কততক্ষণ লাগবে প্রাণ বেরোতে?
হালকা একটা ছোঁয়া লাগলো শরীরে। চমকে উঠলো সে। হাত চেপে ধরলো নরম আরেকটা হাত। না না হাত আসবে কোথা থেকে? হাতের মত কিছু। হয়ত অকটোপাসের গুড়। এসে গেছে তাহলে খুন করার জন্যে! ভাল। সরে গেল চাপটা, পেটের কাছে। হাত বুলিয়ে যেন বোঝার চেষ্টা করছে কোনখান থেকে খাওয়া শুরু করবে। খুঁজে পেলো কোমরে পেঁচানো দড়িটা, যেটার সঙ্গে লোহার পাইপ বাঁধা রয়েছে। তারপর তাকে অবাক করে দিয়ে যেন পোচাতে শুরু করলো দড়িতে।
ফুসফুসের বাতাস প্রায় শেষ। আর কয়েক সেকেন্ড টিকবে বলে মনে হয় না। দড়িটা কাটা হয়ে গেল। তার হাতের বাঁধনে পোচ মারা শুরু হলো এবার। অলৌকিক কান্ডই হোক আর যা-ই হোক, কার কাজ বুঝতে পারলো সে। মানুষ। ছুরি দিয়ে প্রথমে পাইপের দড়ি কেটেছে, এখন হাতেরটা কাটছে। পায়েরও কেটে দেয়া হলো। ওঠার কথা আর বলতে হলো না কিশোরকে।
ওপরে ভেসে হাঁ করে বাতাস টানতে লাগলো কিশোর। চোখের কোণ দিয়ে অন্ধকারেও দেখতে পেলো আরেকটা মাথা ভেসে উঠেছে তার পাশে। কে? জিজ্ঞেস করলো সে।
ফিসফিস করে জবাব এলো, আমি, সাগরের হাসি।
তুমি! যাওনি?