একটা নদীর মুখ। নদী না বলে সাংঘাতিক জলাভূমি বললেই ঠিক হয়। পাহাড়ের গোড়ায়। যদি খালি পানি থাকতো, তেমন অসুবিধে হত না। তবে পেরিয়ে গেলেই চলতো। একশ গজের বেশি চওড়া নয়। কিন্তু পানিতে জন্মে রয়েছে কচুরীপানা। বড় বড় ফুল ফুটে রয়েছে। অন্য সময় হলে বরং মুগ্ধই হতো ওমর, দেখে চোখ জুড়াতো। এখন সে অবস্থা নয়। ঘন হয়ে জন্মানো শুধু কচুরীপানা পেরোনোই এক অসম্ভব ব্যাপার। তার ওপর তার ভেতরে যদি থাকে এক ফুট লম্বা হাজার হাজার বিষাক্ত, শতপদী তাহলে তো কথাই নেই। না যাবে সাঁতরানো, না ওপর দিয়ে হেঁটে পেরোনো।
স্তব্ধ হয়ে কয়েক মিনিট বসে রইলো ওখানে ওরা। কি করা যায়? সরাসরি পার হওয়ার আশা ছাড়তেই হলো। জলার পাশ দিয়ে জঙ্গল কেটে ঘুরে এগোনে ছাড়া বিকল্প নেই। শেষে তা-ই করতে লাগলো। জানে না কতদূর গড়িয়ে রয়েছে জলাটা। তবে আশার কথা, কাছেই পাহাড় রয়েছে। উপত্যকার পরে যেখান থেকে ঢাল শুরু হবে, সেখানে আর নদী থাকতে পারবে না। এটা অবশ্য ডজের অনুমান। ঠিকই অনুমান করেছে সে। আস্তে আস্তে সরু হয়ে আসছে নদী। শেষে এতই সরু হয়ে গেল, খাল বলা চলে এখন। তার পরেও পার হওয়া গেল না, শতপদীর ভয়ে। এগোতে থাকলো ওরা। যতটুকু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আর সরু হচ্ছে না নদী। অবশেষে ভাগ্য কিছুটা সদয় হলো ওদের ওপর। একটা জায়গায় ঝড়ে কাত হয়ে পড়ে গেছে একটা রুটিফল গাছ, আর পড়েছে একেবারে খালের ওপর লম্বা হয়ে, এপার থেকে ওপারে যাবার সাঁকো তৈরি করে দিয়ে।
খাল পেরোলো ওরা। ততক্ষণে রাত হয়ে এসেছে। অন্ধকার নামতে দেরি নেই। সারাটা দিন কাটিয়ে জঙ্গলে ঘুরে মরে গাঁয়ের দিকে মাত্র একটা মাইল এগোতে পেরেছে।
সাঁকো পেরিয়ে এসে দেখলো, এখানকার জঙ্গলও একই রকম ঘন। রাতে এগোনো সম্ভব না। দিনের জন্যে অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু বসে থাকতে চাইলো না ওমর। বললো রাতেই চলবে। ডজ রাজি হলো না। সে এখানকার জঙ্গল চেনে। বললো সেই চেষ্টা করাটাই স্রেফ পাগলামি। সামনে অনেক বাধা থাকতে পারে। আরও জলা থাকতে পারে। চোরাকাদা থাকতে পারে। আর যদি কিছু না-ও থাকে, সারারাত পথ হারিয়ে অযথা ঘুরে মরতে হতে পারে বনের ভেতর।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে আধমরা হয়ে গেছে ওরা। গড়িয়ে পড়লো বনের ভেজা মটিতে। একধরনের অদ্ভুত ফাঙ্গাস জন্মে রয়েছে। অন্ধকারে জ্বলে। বাতাসে একধরনের সোঁদা গন্ধ। নিঃশ্বাস নিতে গেলে মনে হয় ফুসফুসে চাপ লাগছে। বিমানে থাকতে বন থেকে মশা গিয়ে হামলা চালিয়েছিলো, আর এখানে তো মশার রাজত্বেই এসে ঢুকেছে ওরা। কাজেই কামড়ানোর পরিমাণটা অনেক বেশি। ভয়াবহ আরেকটা রাত কাটাতে তৈরি হলো তিনজনে।।
এখন বুঝতে পারছি, বিষন্ন কণ্ঠে বললো ওমর। মুক্তো কেন এত দামী। দুহাতে একনাগাড়ে চাপড় মারছে শরীরের যেখানে সেখানে।
রাত বাড়তেই মশার অত্যাচারও এতই বেড়ে যেতে লাগলো যে আগুন জ্বালাতে হলো ওদেরকে। ধোঁয়ার ভেতরে গা ডুবিয়ে বসতে হলো। সেই ধোঁয়ার ঝাজে পানি এসে গেল চোখে, গলার ভেতরে জ্বালা ধরালো, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো। মশার কামড়, না সেই ধোঁয়া কোনটা যে ভাল বোঝাই কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।
এতেও এত কষ্ট হত না, ওমর বললো। হাসিমুখে সহ্য করে নিতাম, যদি জানতাম কিশোররা ভাল আছে।
জবাব দিলো না ডজ কিংবা মুসা। খারাপ সম্ভাবনাগুলোই কেবল আসছে মনে। সেগুলো আর প্রকাশ করতে চাইলো না।
স্থির হয়ে আছে যেন সময়, কাটতেই চাইছে না। মাঝে মাঝে জলার দিকে তাকাচ্ছে মুসা। শিউরে উঠছে। আলোজ্বলা ফাঙ্গাস ওখানেও আছে। নড়ছে চড়ছে থেকে থেকে। কারণটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তার। কোন প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ওপর দিয়ে। বনের ভেতর থেকে আসছে বিচিত্র ডাক, চলাফেরার আওয়াজ। সেগুলো যে কিসের ডজও বলতে পারলো না। ধোঁয়ার ওপাশে উড়ছে বড় বড় মথ। ডানা মেলে দিয়ে উড়ছে, গিয়ে বসছে পাতার ওপর। নিঃশব্দে উড়ে এল একটা বিশাল বাদুড়। ড্রাকুলার গল্প পড়া আছে মুসার। ভূতের ভয়ে এমন এক চিৎকার দিলো, লাফিয়ে উঠলো ওমর আর ডজ। বাদুড়টাও চমকে গেল। কাছেই একটা গাছের ডালে গিয়ে ঝুলে রইলো।
এত অন্ধকারও আর কখনও দেখেনি মুসা। মনে হচ্ছে ভারি নিরেট কোন জিনিসের মত চেপে বসেছে ওদের ওপর। এত অত্যাচারের মাঝেও ঢুলতে শুরু করলো সে। দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। পায়ে কিসের ছোঁয়া লাগতে টুটে গেল তন্দ্রা। আগুনের আলোয় আতঙ্কিত চোখে দেখলো লালচে-বাদামী একটা শতপদী এসে পায়ে উঠেছে। দশ ইঞ্চি লম্বা। জুতোর ওপরে অনেকখানি উঠে এসেছে প্যান্ট। পায়ের সেই খালি জায়গাটায় উঠেছে ঘিনঘিনে প্রাণীটা। চিৎকার দিয়ে উঠে থাবা মেরে ওটাকে ফেলে দিলো সে। পায়ের চামড়ায় দেখতে পেলো দুটো লাল বিন্দু। দেখতে দেখতে ফুলে উঠলো জায়গাটা। অকল্পনীয় ব্যথা। ডজ বললো, কয়েক দিন ধরে থাকবে ব্যথাটা।
একনাগাড়ে পাইপ টেনে চললো ডজ। সমস্ত সিগারেট শেষ করে ফেললো ওমর।
আল্লাহ, ভোর মনে হয় হচ্ছে, বিড়বিড় করলো মুসা। আর একটা রাত যদি এই জঙ্গলে কাটাতে হয়, সোজা পাগলা গারদে পাঠাতে হবে আমাকে। আগের বার এসে দক্ষিণ সাগরের এই দ্বীপগুলোকে মনে হয়েছিলো বেহেশত, এখন মনে হচ্ছে দোজখ।