তবে, কারনেস বললো, অনেক কিছু জেনে ফেলেছ তুমি। বলে দিলে বিপদে পড়বো আমি। তাই যাতে বলতে না পার সেই ব্যবস্থা করে যাব। আবার নাবিকদের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকালো। রওনা হয়ে গেল হুইলের দিকে।
ক্যাপস্টানের দিকে দৌড়ে গেল চারজন নাবিক। নোঙর তোলার সময় ঝনঝন করে উঠলো শেকল। দ্রুত কালো হয়ে আসা আকাশের পটভূমিতে দুলে উঠলো একটা শাদা পাল।
দুজন নাবিক রয়ে গেল কিশোরের পাশে। ফুলে উঠলো পাল। লেগুনের মুখের দিকে রওনা হয়ে গেল জাহাজ। কি করতে বলা হয়েছে লোকগুলোকে?
সতর্ক নজর রাখলো কিশোর। রেখেও কিছু করতে পারলো না। জোর করে তাকে ধরে শুইয়ে ফেললো লোকগুলো। কারাত আর জুডোর সাহায্যে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলো সে। কিছুই করতে পারলো না। অসম্ভব শক্তি লোকগুলোর গায়ে। চেপে ধরে রেখে সাহায্যের জন্যে ডাকলো অন্যদেরকে। একজন একটা দড়ি পেঁচিয়ে বাঁধলো তার কোমর। আরেক মাথা বাঁধলো একটা লোহার পাইপের সঙ্গে। আতঙ্কিত হয়ে পড়লো কিশোর। ওদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে। পানিতে ফেলে দেয়া হবে তাকে, হাত-পা বেঁধে। লোহার পাইপের ভার তাকে টেনে নিয়ে যাবে। লেগুনের তলায়। কিছুতেই ভেসে উঠতে পারবেনা।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করলো সে। দুএকজনের নাকে ঘুসিও মারলো। লাভ হলো না কিছু। এতগুলো শক্তিশালী হাত থেকে মুক্তি পেলো না। উপুর করে ফেলে মুচড়ে তার হাত নিয়ে আসা হলো পিঠের ওপর। দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। আরেকজন পা বেধে দিলো। শিকারীর হাতে অসহায় খরগোশ যেন সে, কিংবা কসাইয়ের কাছে ছাগল। বয়ে নিয়ে আসা হলো রেলিঙের কাছে। খিকখিক করে তার কানের কাছে হেসে উঠল একটা লোক। দুজনে দুদিক থেকে ধরে তুলে দোলা দিয়ে তাকে রেলিঙের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিলো। ঝপাং করে পানিতে পড়লো সে।
পড়েও সারতে পারলো না। টেনে নিয়ে চললো তাকে লোহার পাইপ। মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে লাগলো ছাড়া পাওয়ার জন্যে। সব দিক থেকে চেপে ধরতে শুরু করেছে যেন কালো পানি।
অবশেষে শেষ হলো নিচের দিকে টানা। তার মানে তলায় পৌঁছে গেছে। লোহার পাইপ, বালিতে ঠেকেছে। চারপাশে শুধুই ঘন অন্ধকার।
১৩
রাটুনাতেই রয়েছে ওমর, মুসা আর ডজ। কিশোরের মতো মারাত্মক বিপদে নেই ওরা, তবে অসুবিধেয় পড়েছে। প্রচন্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে কিশোরদের জন্য। উৎকণ্ঠাও খুব খারাপ জিনিস। শরীরের ওপর ভীষণ চাপ দেয়।
ওমর আশা করেছিলো লেগুনে থাকলে ঝড়ে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না বিমানটার। ভেবেছে, কিছু পাতাটাতা এসে পড়তে পারে, তাতে আর কি এমন হবে? কল্পনাই করতে পারেনি সে কতটা ক্ষতি হবে। প্রথমেই ধরা যাক, বড় একটা নারকেলের ডালের কথা। তুমুল গতিতে উড়ে এসে একটা ডানার ওপর আছড়ে পড়েছে ওটা। যদিও খসে যায়নি ডানাটা, তুবড়ে গেছে। ওড়া অসম্ভব, যতক্ষণ না ওটা মেরামত হয়। আর শুধু পাতাই যে কি করতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঝড়ের মধ্যে উড়ে এসে বৃষ্টির মত অঝোরে ঝড়ে পড়েছে যেন। হারিকেন শেষ হতে হতে পাতার নিচে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গেল বিমানটা।
সেই পাতা সরানোই এক মহা ঝামেলার ব্যাপার। সরিয়ে বেরোনোর পথ তো পরিষ্কার হলো, কিন্তু তীরে যাবে কি করে? পানির ওপরে পাতার স্তর এতটা পুরু নয় যে ওদের ভার রাখতে পারবে। হেঁটে যাওয়া যাবে না। আবার সাঁতরে যাওয়াও মুশকিল। একটা কাজই করা যায়। চারপাশ থেকে লতাপাতা জোগাড় করে ফেলে ফেলে একটা সাঁকোমত তৈরি করে তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। পাতা ঠেলে সাঁতরে যাওয়ার চেয়ে সেটা কোন অংশেই সহজ মনে হলো না ওদের কাছে।
রাত হয়ে গেল। তীরে পৌঁছতে পারলো না ওরা। বিমানের মধ্যে বসে বসে একটা বিনিদ্র রাত কাটাতে হলো ওদের। কিশোরদের ভাবনা না থাকলে এতটা কষ্ট পেতে হতো না। শরীরের কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্ট অনেক বেশি। তবে শারীরিক কষ্টও কিছু কম হলো না। বিমানটা যেখানে নেমেছে তার কাছেই রয়েছে একটা খড়ি। তার ওপাশে জলাভূমি। সেখান থেকে এসে হাজির হলো মশার ঝাঁক। ছেকে ধরলো। কিছুই করার নেই ওগুলোর বিরুদ্ধে। মসকুইটো কয়েল কিংবা স্প্রে কোনটাই নেই বিমানে।
ভোরের আলো ফুটতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো ওরা। মশার যন্ত্রণা অন্তত কমবে। সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। সাঁকো তৈরি শেষ হয়নি তখনও। ক্লান্ত শরীর নিয়েই কাজে লাগলো ওরা। অনেক কষ্ট আর কায়দা কসরৎ করে ভাসমান সেই পাতার সাঁকো দিয়ে এসে নামলো তীরে। রওনা দিলো গায়ের দিকে। সেটাও কম দূরে নয়। পাঁচ ছয় মাইল তো হবেই। সাধারণ সময়ে ভালো রাস্তা পেলে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। কিন্তু গায়ে জোর নেই। তার ওপর ঘন জঙ্গল। জীবনে অনেক জঙ্গল দেখেছে ওমর, এত ঘন দেখেনি। প্রতিটি ইঞ্চি পথ লতাপাতা কেটে তৈরি করে নিতে হচ্ছে। তার ওপরে রয়েছে ভয়ংকর গরম। দ্রুত শরীরকে অবসন্ন করে দেয়।
শত শত মশার কামড়ের দাগ একেকজনের শরীরে। দিনের বেলা এখন জঙ্গলে হামলা চালালো এক ধরনের মাছি, স্যান্ড ফাই। কামড়ে ভীষণ জ্বালা। রক্ত বেরিয়ে যায়। এতে বাধার পরেও এগোনো থেমে থাকলো না। তবে পানির কিনার থেকে পোয়াটাক মাইল পেরোনোর পরেই এমন আরেকটা বাধা পড়লো সামনে, দিশেহারা হয়ে গেল ওমর।