টিনের অবস্থা দেখে পছন্দ হলো না কারনেসের। ছুঁড়ে ফেলে দিলো। হাঁপ ছাড়তে যাচ্ছিলো কিশোর, ছাড়া আর হলো না। টিনের মুখটা হয় ঠিকমত লাগেনি, নয়তো জোর ঝাকুনিতে গেল খুলে। ছড়িয়ে পড়লো ওটার ভেতরের জিনিস।
পাথরের মূর্তি হয়ে গেল যেন কারনেস। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো জিনিসগুলোর দিকে। বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপরই জোরে এক চিৎকার দিয়ে দৌড় দিলো। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মুক্তোগুলোর কাছে। কাঁপা হাতে তুলে রাখতে শুরু করলো আবার টিনের মধ্যে। একবার তাকালো কিশোরের দিকে। উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। ঘামছে দরদর করে। দৌড়ে এলো তার সাগরেদরা। উত্তেজিত হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় কিচির মিচির করে কি বলতে লাগলো ওরা বুঝতে পারছে না কিশোর।
অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। টিনটা যে কেন ফেলে গেছে ডজ, মাথায় ঢুকছে না কিশোরের। এত কষ্ট করলো ওরা ওগুলোর জন্য, সব শেষ, কোনই লাভ হলো না। এসব জিনিসের লোভ নেই তার, নির্দ্বিধায় ওই একটিন মুক্তো দান করে দিতে পারে, কিন্তু এখন তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কারণটা আর কিছু না, অভিযানের ব্যর্থতা। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। রাগ হতে থাকলো ডজের ওপর, আর কারনেসের প্রতি তীব্র ঘৃণা। ওই মুহূর্তে বুঝতে পারলো কেন এসব মূল্যবান রত্নের জন্যে মানুষ মানুষকে খুন করে।
কারনেস মুক্তোগুলো পাওয়ার খানিক আগে ঝিনুকের প্রথম চালানটা নিয়ে রওনা হয়েছিলো লংবোট। জাহাজের কাছে পৌঁছে গেছে। দুজন লোক গেছে সঙ্গে। চিৎকার করে জানতে চাইলো, কি হয়েছে। তীর থেকে জানালো ওদের সঙ্গীরা। দ্রুত ঝিনুকগুলো ডেকে ছুঁড়ে ফেলে নৌকা নিয়ে ফিরে এলো ওরা।
অনেক ঝিনুক পড়ে রয়েছে এখনও। সেগুলো তোলার নির্দেশ দিল কারনেস। লোকটার লোভ দেখে আরও তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। এতগুলো মুক্তো পেয়েছে, তার পরেও আরও পাওয়ার লোভে ঝিনুক তুলে নিয়ে যাচ্ছে। জাহাজ বোঝাই করে মুক্তো দিয়ে দিলেও হবে না, আরও চাইবে, আরও।
নিজে দাঁড়িয়ে ঝিনুক তোলা দেখতে লাগল কারনেস। তদারক করছে। কোনটা বাকি রয়ে গেল কিনা দেখছে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে কিশোরের দিকে। কিশোরের গম্ভীর হয়ে যাওয়া মখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, খুব মজা পাচ্ছে যেন। ক্ষোভ, রাগ সব দূর হয়ে গেছে তার। খোশমেজাজে আছে। একবার জিজ্ঞেস করলো, এগুলো যে আছে বলনি কেন?
জানতাম না।
কণ্ঠের তিক্ততা চাপতে পারলো না কিশোর। তাতে আরও মজা পেল লোকটা। হেসে উঠলো। অনেক কষ্ট থেকে আমাকে বাচিয়ে দিলো তোমার বন্ধুরা। এতগুলো মুক্তো রেখে গেল। কিশোরের দিকে একটা ডাব ছুঁড়ে দিলো সে। ছুরি দিয়ে আরেকটা ডাবের মুখ কাটলো নিজে খাওয়ার জন্যে।
ডাবটা দেখে পিপাসার কথা মনে পড়লো কিশোরের। কারনেসের কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে মুখ কাটতে লাগলো। গলা শুকিয়ে গেছে।
শেষ ঝিনুকটা যখন নৌকায় তোলা হলো, পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই ছুঁই করছে তখন সূর্য। নৌকায় উঠলো দাঁড়ীরা। যার যার জায়গায় বসলো। কিশোর ভাবলো, তাকে ফেলেই চলে যাবে কারনেস। তাতে বরং খুশিই হবে কিশোর। কারণ ওমররা ফিরে আসবেই। কিন্তু তাকে নিরাশ করলো কারনেস। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এক ধরনের অদ্ভুত দৃষ্টি ফুটেছে চোখে। নৌকায় ওঠার ইশারা করলো।
উঠলো গিয়ে কিশোর। তার পেছনেই বসলো কারনেস। নৌকা ছাড়তে বলার আগে শেষবারের মত সৈকতে চোখ বোলালো সে, কিছু ফেলে যাচ্ছে কিনা দেখলো। আরেকবার ফেরার কোন ইচ্ছেই নেই তার। নৌকা ছাড়তে বললো সে।
জাহাজের দিকে এগিয়ে চললো নৌকা। একেবারে নিরাশ হয়ে পড়েছে কিশোর। সারাটা দিন বিমানের অপেক্ষা করেছে। ভেবেছে এই বুঝি এলো, এই বুঝি এলো। শব্দ শোনা গেল। কিন্তু এলো না ওটা। এখন রাত হয়ে আসছে। আজ আর আসবে না বিমানটা। এলেও আগামী দিন।
জাহাজের গায়ে এসে ভিড়লো নৌকা। ডেকে উঠতে বলা হলো কিশোরকে। উঠলো সে। সাগরের দিক থেকে ধেয়ে এলো এক ঝলক বাতাস। আলোড়ন তুললো লেগুনের পানিতে। মৃদু দুলতে লাগলো জাহাজ। আনন্দে চিৎকার করে উঠলো কারনেস। তার খুশির কারণ বুঝতে পারলো কিশোর। প্রকৃতিও যেন কারনেসের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে। প্রথমে পাঠিয়েছে ঝড়, মুক্তোগুলো দ্বীপে ফেলে রেখে বিমানটাকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। সেগুলো পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে কারনেসকে। এখন পাঠিয়েছে বাতাস। স্কুনারটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। পরদিন ওমররা আসতে আসতে অনেক দূরে চলে যাবে ওটা। ধরার আর কোন উপায়ই থাকবে না হয়তো।
মুক্তোর টিনটা বগলে চেপে নিচে চলে গেল কারনেস। ফিরে এলো একটু বাদে। ওটা ছাড়া অন্য কোন পরিকল্পনা ছিলো হয়ত তার, বাতাস আসায় সেটা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিচু গলায় নির্দেশ দিতে আরম্ভ করল তার নাবিকদের। ওরা ফিরে তাকালো কিশোরের দিকে। ওদের দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল সে। নিশ্চয় তার ব্যাপারেই কিছু আলোচনা হয়েছে।
আমার জাহাজটা তোমার পছন্দ হয়নি, কিশোরকে বললো কারনেস। ভাল কথা। এখানেই থেকে যাও! রেখে যাওয়া হবে তোমাকে।
এতে বরং খুশিই হলো কিশোর। এটাই চাইছিলো। বললো না কিছু।