চুপ করে রইলো কিশোর।
ফেটে পড়লো কারনেস। কে নৌকা চুরি করেছে?
লম্বা দম নিলো কিশোর। তাহলে এই ব্যাপার। ডিঙিটা নেই। নিশ্চয় তাকে ধরে আনার পর ফিরে এসেছিলো ঝিনুক। নৌকাটা নিয়ে চলে গেছে। আশা হলো মনে। তবে সেটা চেহারায় প্রকাশ পেতে দিলো না। কিন্তু তার পরেও কি করে যেন বুঝে ফেললো কারনেস। ঠাস করে চড় মারলো।
মাথা সরানোরও সুযোগ পায়নি কিশোর। আরেকটু হলেই উল্টে পড়তো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছলো সে।
আর কে ছিলো তোমার সাথে? আবার গর্জে উঠলো কারনেস।
আর চুপ করে থাকার কোন মানে হয় না। লাভ হবে না। নৌকা যখন চুরি হয়েছে, কেউ না কেউ ছিলোই দ্বীপে এটা বুঝে ফেলেছে কারনেস। অস্বীকার করে অযথা মার খেতে হবে। বললো, ঝিনুক। মনে মনে আশা করলো, এতক্ষণে নিশ্চয় সাগরের হাসিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে ঝিনুক।
তীব্র ঘৃণা দেখা দিলো কারনেসের চোখে। শুঁয়োপোকার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায় মানুষ সেভাবে তাকালো কিশোরের দিকে। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে পিষে ফেলতে চায় যেন। ওই নোংরা কানাকাটা! জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে করসিকান। কোথায় গেছে? এত জোরে চিৎকার করে উঠলো সে, চমকে গেল কিশোর। পিছিয়ে গেল এক পা।
গেলে রাটুনাতেই গেছে, আর কোথায়।
আকাশের দিকে নজর চলে গেল কারনেসের। তার মনে কি ভাবনা চলেছে অনুমান করতে পারলো কিশোর। রাটুনায় পৌঁছার আগেই নৌকা-টাকে ধরতে পারবে কিনা ভাবছে সেকথা। পারবে না। এক বিন্দু বাতাস নেই। সাগরের পানিও লেগুনের মত শান্ত, এক বিরাট আয়নার মত লাগছে। এক রত্তি মেঘ নেই আকাশে। বাতাস যে আসবে তার কোন সম্ভাবনাই নেই।
সেটা বুঝে আরও রেগে গেল কারনেস। মাথায় আগুন ধরছে তার, বুঝতে পারছে কিশোর। ভয় পেয়ে গেল। এখন বেফাস কিছু করে বসলে মরতে হবে।
কিশোরের গলা চেপে ঠেলতে ঠেলতে মাস্তুলের কাছে নিয়ে গেল কারনেস। ছুরি বের করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, আমার সঙ্গে চালাকির মজা দেখাচ্ছি!
মাথা গরম করলো না কিশোর। গলায় চাপ রয়েছে। ফ্যাসফ্যাস করে কোনমতে বললো, আমাকে মেরে ফেললে মুক্তোর খেতটা আর খুঁজে পাবেন না।
দ্বিধা করলো কারনেস। গলার চাপ বাড়িয়েই আবার ঢিল করে ফেললো। কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এলো এক পা। হ্যাঁ, মুক্তো। আরও কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। ফিরে তাকিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় আদেশ দিলো। নাবিকদেরকে।
লোকটাকে যে কি ভীষণ ভয় পায় সেটা নাবিকদের আচরণেই বোঝা গেল। লংবোট নামাতে দৌড়ে গেল ওরা। দেখতে দেখতে নামিয়ে ফেললো জাহাজের পাশে পানিতে। তাতে চড়ে বসলো ছজন লোক, দাঁড় তুলে নিলো।
এসো আমার সঙ্গে, কিশোরকে বললো কারনেস। ওরা উঠলে দাঁড় বাইতে শুরু করলো লোকগুলো। তীরে পৌঁছলো।
অবাক হয়ে কিশোর ভাবছে, কি করবে লোকগুলো? একটু পরেই বুঝতে পারলো। ঢেউয়ের সঙ্গে যে ঝিনুকগুলো তীরে এসে পড়েছে, সেগুলো কুড়াতে এসেছে ওরা। অনেক ঝিনুক পড়ে থাকতে দেখলো কিশোর। শুকনোয় তো আছেই, পানিতেও আছে। অল্প পানিতে ছেয়ে রয়েছে লেগুনের নিচে। তবে ওগুলোর প্রতি কোন আগ্রহ বোধ করলো না সে। চারজন লোক ঝিনুক কুড়িয়ে এক জায়গায় করছে, একজন বয়ে নিয়ে গিয়ে তুলছে নৌকায়। ছয় নম্বর লোকটা নারকেল কুড়াচ্ছে।
কিশোরকে নিয়ে ক্যাম্পের কাছে চলে এলো কারনেস। যেখানে যা পেলো, কাজে লাগার মত, তুলে নিতে আরম্ভ করলো। অভিযাত্রীদের ফেলে যাওয়া জিনিস। মাঝে মাঝে কথা বলছে কিশোরের সঙ্গে, প্রশ্ন করছে। পারলে জবাব দিচ্ছে কিশোর।
তাড়াহুড়া করছে কারনেস। কেন, সেটা বুঝতে পারলো কিশোর। কারনেসের ভয়, ঝিনুক পালিয়েছে। গিয়ে দলবল নিয়ে ফিরে আসতে পারে। তাই পালাতে চাইছে কারনেস, লেগুন থেকে বেরিয়ে দূরে চলে যেতে চাইছে।
পাথরের নিচে, শ্যাওলার ভেতরে খোঁজাখুঁজি করছে কারনেস। নীল আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেছে সূর্য। বেলা যতই বাড়ছে, গরমও বাড়ছে। নিরাসক্ত চোখে তার কাজকর্ম দেখছে কিশোর। সে একটা কথাই ভাবছে, কি করে পালাবে। কিন্তু কোন উপায়ই বের করতে পারছে না। এক কাজ করতে পারে। দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। চলে যেতে পারে দ্বীপের নিচের সেই গুহায়। তবে তাতে হাঙরের ভয় আছে। আর কারনেসের লোকেরাও যে গুহাঁটা খুঁজে বের করতে পারবে না তা নয়। তার ওপর রয়েছে গুলি খাওয়ার ভয়। সে দৌড় দিলেই কোমর থেকে রিভলভার নিয়ে গুলি চালাবে কারনেস। গুহায় ঢোকার ভাবনাটা বাতিল করে দিলো সে।
একটা পাথরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কারনেস। ওটার নিচেই মুক্তোর টিনটা লুকিয়ে রেখেছিল ডজ। এইবার কিছুটা আগ্রহী হলো কিশোর। পাথরের চারপাশে শ্যাওলার স্তূপ জমে রয়েছে। টেনে টেনে কিছু সরালো কারনেস। কিছু সরালো পা দিয়ে। ঘুরে দাঁড়াতে যাবে এই সময় একটা জিনিস চোখে পড়লো তার।
ধক করে উঠলো কিশোরের বুক। মনে হলো হৃৎপিন্ডের গতিই বুঝি থেমে যাবে। এত গরমেও ঠান্ডা শিহরণ জাগলো শরীরে। চিকণ ঘাম দেখা দিলো কপালে। জিনিসটা সে-ও দেখতে পেয়েছে। বালির ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে টিনের একটা অংশ। সেই বিস্কুটের টিনটাই, চিনতে অসুবিধে হলো না তার। ওপরের বালি অনেকখানি ধুয়ে নিয়ে গেছে পানি, ফলে বেরিয়ে পড়েছে টিনটা।
কিশোর আশা করলো, দেখতে পেলেও টিনটা ছোঁবে না কারনেস। কারণ পুরনো একটা জিনিস বালিতে দেবে রয়েছে, কোন মূল্য নেই ওটার। কিন্তু কারনেসের কাছে আছে। এখানে কিশোরদের আনা জিনিস যা-ই পাচ্ছে তুলে নিচ্ছে লোকটা। কি করবে আল্লাহই জানে। লাথি দিয়ে টিনের ওপরের বালি আরও সরালো কারনেস। তারপর টেনেটুনে বের করে আনলো ওটা বালির নিচ থেকে। ওই সময় একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকালেই তার কাছে ফাঁস হয়ে যেত ব্যাপারটা। কারণ একেবারে শাদা হয়ে গেছে তার মুখ।