সাগরের হাসির দিকে ফিরে বললো সে, একসাথে সবার যাওয়ার দরকার নেই আমাদের। তুমি নারকেল কুড়িয়ে নাও, যত বেশি পার। আমি আর ঝিনুক গিয়ে নৌকাটা নিয়ে আসি।
লেগুনের কিনারে চলে এলো ঝিনুক আর কিশোর। পানিতে পা দিলো। কোমর পানিতে নেমে সাঁতরাতে শুরু করলো। অন্ধকারে পানির ওপরে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে জাহাজটা। কালো বিশাল একটা ভূতুড়ে অবয়ব। নিঃশব্দে সাঁতরে চললো দুজনে।
আলোটার দিকে কিশোরের চোখ। ওটা কারনেসের কেবিন। সে জেগে থাকতে পারে। হয়ত বসে বসে মদ গিলছে। খোলা বাতাসের জন্যে বেরিয়ে আসতে পারে। বলা যায় না। সতর্ক থাকা দরকার। ওকে দেখলেই ডুব মারতে হবে।
মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে ডিঙিটা। নীরব হয়ে আছে জাহাজ। কোন শব্দ নেই। কেউ বেরোচ্ছে না ডেকে। ডিঙির কাছে পৌঁছে আস্তে হাত দিয়ে খামচে ধরল সে ওটার কিনারা। কান পেতে রইল। না, কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না। আস্তে করে দুহাতের সাহায্যে টেনে তুললো নিজেকে। ডিঙির পাটাতনে নামতে গিয়ে পড়লো নরম কিছুর ওপর। ভয়ানক চমকে গেল সে। নরম জিনিসটা কি বুঝতে পেরেছে। মানুষ!
ডিঙিতে ঘুমিয়েছে লোকটা। অন্ধকারে কোন ফাঁকে নেমেছে ও, ঢিবির আড়ালে বসে দেখতে পায়নি কিশোর। জেগে গেল লোকটা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। জাপটে ধরলো কিশোরকে।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করলো কিশোর। কিন্তু অসুরের শক্তি লোকটার গায়ে। তাকে পেড়ে ফেলে গলা টিপে ধরলো। ছটফট করতে লাগলো কিশোর। বাতাসের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ফুসফুস। কানে আসছে অনেক লোকের চেঁচামেচি। ডেকে বেরিয়ে এসেছে নাবিকেরা।
আরেকবার ছাড়া পাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলো কিশোর। প্রচন্ড ঘুসি এসে লাগলো চোয়ালে। হাজারটা তারা জ্বলে উঠলো যেন মাথার ভেতরে। জ্ঞান হারালো সে।
বেশিক্ষণ অচেতন থাকলো না। হুঁশ ফিরলে দেখলো ডেকে পড়ে আছে। প্রায় চোখের কাছে জ্বলছে একটা হ্যারিকেন। অনেকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাকে।
চোখ মেলতেই তার দিকে তাকিয়ে কুৎসিত হাসি হাসলো কারনেস। ওঠ ওঠ। নরম গলায় ডাকলো সে। কিশোরের মনে হলো বেড়ালের ঘড়ঘড়ে স্বর বেরোল লোকটার গলা দিয়ে।
উঠে বসলো কিশোর। এরকম একটা কান্ড ঘটবে কল্পনাই করতে পারেনি। যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনও। মাথা ঝাড়া দিয়ে মগজের ঘোলাটে ভাবটা দূর করার চেষ্টা করলো। সে একাই ধরা পড়েছে? নাকি ঝিনুকও? তবে পালিয়ে গেলেও বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। সকাল হলেই ধরা পড়তে হবে।
আবার তাহলে দেখা হলো, আঁ? দাঁত বের করে হাসলো কারনেস।
জবাব দিলো না কিশোর।
তোমার দোস্তরা কোথায়? শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলো কারনেস।
জানি না, তিক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো কিশোর।
মিছে কথা বলবে না বলে দিলাম!
মাথা নাড়লো কিশোর। না, মিথ্যে বলছি না। ঝড়ের সময় হারিয়ে গেছে ওরা। দ্বীপের নিচে একটা গুহার ভেতরে আটকা পড়েছিলাম আমি। হাঙর ঢুকেছিলো গুহায়। ওটার জন্যে বেরোতে পারছিলাম না। সকালে বেরিয়ে দেখি, নেই। জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্যে তখন নারকেল গাছে চড়ে বসে রইলাম।
এমন ভঙ্গিতে বলেছে কিশোর, বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো কারনেস। মসৃণ গলায় জিজ্ঞেস করলো, অনেক মুক্তো পেয়েছে, না?
অল্প কিছু, অস্বীকার করার কোন কারণ দেখতে পেলো না কিশোর। বেশি তুলতে পারিনি। একটা সোর্ডফিশ প্লেনের তলা ফুটো করে দিয়েছিলো। ডুবুরির সাজসরঞ্জাম সব পানিতে ফেলে দিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি আমরা।
মুক্তোগুলো কোথায়?
ওদের কাছে।
খেতটা কোথায়, জান?
মোটামুটি।
ঠিক আছে। সকালে আমাকে দেখাবে।
আচ্ছা। কথা দিলো বটে কিশোর, তবে দেখাবে কিনা ভাবতে হবে। আসলে সময় চাইছে সে। এখনই কারনেসের বিরোধিতা শুরু করে মার খেতে চায় না।
কোমরের খাপ থেকে ছুরি বের করলো কারনেস। ইচ্ছে করেই চোখা মাথাটা তুললো কিশোরের দিকে। হুমকি দেয়ার জন্যে। বললো, সাবধান, চালাকির চেষ্টা করবে না। তাহলে কি করবো জানো? দিয়ে দেব তোমাকে। আমার সাগরেদদের হাতে। ওরা নিয়ে গিয়ে জবাই করবে। কেটে মাংস খাবে তোমার। অনেক দিন মানুষের মাংস খায় না। পেলে খুব খুশি হবে।
কিশোরকে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলো কারনেস।
প্রায় টেনেহিঁচড়ে কিশোরকে নিচে নামিয়ে আনলো দুজন নাবিক। একটা ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো ওরা। বোটকা গন্ধ। গন্ধেই চিনতে পারলো কিশোর, এই ঘরেই বন্দী করে রাখা হয়েছিলো ঝিনুককে।
১২
প্রচন্ড মাথা ধরেছে কিশোরের। দপদপ করছে চোয়ালের যেখানটায় ঘুসি খেয়েছে। তার পরেও ঘুম এলো।
ওপরে ডেকে চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। আঞ্চলিক ভাষায় অনর্গল কথা বলছে নাবিকেরা। মুখ খারাপ করে গালাগাল করছে কারনেস। কাকে, কেন, কিছুই বোঝা গেল না। গোল একটা ফুটো দিয়ে আলো আসছে। ভোর হয়ে গেল? অবাকই লাগলো কিশোরের। ঘুম কত দ্রুত সময় পার করে দেয়।
বাইরের করিডরে পায়ের আওয়াজ হলো। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। দুজন নাবিক ঘরে ঢুকলো। আগের রাতে যারা কিশোরকে এখানে রেখে গেছে তারা দুদিক থেকে এসে চেপে ধরলো তাকে। আবার টেনে নিয়ে চললো ওপরে।
ডেকে পায়চারি করছে কারনেস। কিশোরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ। পিচিক করে থুথু ফেললো ডেকের ওপরেই। ধীরে ধীরে এগোল শিকারি বেড়ালের মত। হাতের আঙুল একবার খুলছে, একবার মুঠো করছে। তোমার সাথে দ্বীপে আর কে ছিল? লোহা, ঘষলো যেন শিরিষ দিয়ে এমনই কণ্ঠস্বর।