মাথা নাড়লো ঝিনুক। না, যাবে না। ঝড়ে পড়েছিল। অনেক ক্ষতি হয়েছে জাহাজের। এখানে থেমে মেরামত করবে।
ঠিক, সাগরের হাসি বললো। না হলে আসছে কেন?
নিশ্চয় পানি আর খাবারের খোঁজে, কিশোর বললো। দ্রুত একবার চোখ বোলালো দ্বীপটায়। লুকানোর জায়গা খুঁজলো। চল, ওদিকটায় চলে যাই। নারকেল কুঞ্জের অন্য পাশটার কথা বললো সে।
উঠে দাঁড়াতে গেল সাগরের হাসি আর ঝিনুক। বাধা দিলো কিশোর। কারনেসের চোখে পড়ে যেতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ওরা কুঞ্জের দিকে। ভেতরে বালির একটা ঢিবি আছে। তার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকলে জাহাজ থেকে দেখা যাবে না।
গাছপালার ভেতরে ঢুকেই উঠে দাঁড়ালো কিশোর। দৌড় দিলো ঢিবির দিকে। ওটার আড়ালে আসার আগে পেছন ফিরে তাকালো না একবারও। বসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকিয়ে দেখলো লেগুনে ঢুকে পড়েছে জাহাজটা। নোঙর ফেলছে। ডেকে লুটোপুটি খাচ্ছে ছেড়া পাল। ওগুলো মাড়িয়েই হাঁটাচলা করছে নাবিকেরা। কারনেসের গলাকাটা সাগরেদের দল। হুইল ধরে থাকতে দেখা গেল কারনেসকে।
কিছুই করার নেই, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া। তা-ই করলো কিশোর আর দুই পলিনেশিয়ান। কিশোর ভাবছে, কারনেস কি করবে? আশা করলো, একটুক্ষণ থেকেই নারকেল নিয়ে চলে যাবে জাহাজটা। তবে যতই সময় যেতে লাগলো, নিরাশ হতে থাকলো সে। ডেকটা যতটা সম্ভব গোছগাছ করলো নাবিকেরা। তার পর ডিঙি নামানোর আদেশ দিলো কারনেস। পানির ওপর দিয়ে স্পষ্ট ভেসে আসছে তার কণ্ঠ। ডিঙি নামানো হলো। তাতে চড়ে বসলো কারনেস আর দুই সাগরেদ। দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে কিশোর। কপালে মনে হয় দুঃখ আছে আমাদের। কারনেস নিশ্চয়, অনুমান করেছে, এই দ্বীপের কাছাকাছিই কোথাও রয়েছে মুক্তোর খেত। দ্বীপে নেমে ঝিনুকের খোসাগুলো দেখলে শিওর হয়ে যাবে। আরও একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাবে, যে আমরাও উঠেছি দ্বীপে। খুঁজতে শুরু করবে।
জবাব দিলো না সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক। তাকিয়ে রয়েছে।
তীরে নামলো কারনেস। চোখ বোলালো দ্বীপের লেগুনের দিকের অংশটায়। পরিত্যক্ত ক্যাম্পটা চোখে পড়লো। দাঁতের ফাঁকে সিগার। কি ভেবে এগিয়ে গেল কয়েক পা। থামলো। দেখলো। আবার এগোল। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিলো একটা জিনিস। ঝিনুকের খোলা। এখান থেকেও দেখতে পাচ্ছে কিশোর।
ব্যস, হয়ে গেছে কাজ! অস্বস্তি বেড়ে গেল কিশোরের। ক্যাম্প দেখতে পেয়েছে কারনেস। ঝিনুকের খোলা পেয়েছে। ওটা কিভাবে কিজন্যে খোলা হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হবে না পাকা মুক্তো শিকারীর।
হাত নেড়ে দুই সঙ্গীকে ডাকলো কারনেস। ওরা কাছে এলে খোলাটা দেখালো।
ঘণ্টাখানেক দ্বীপে থাকলো ওরা। তারপর ফিরে গিয়ে উঠল ডিঙিতে। জাহাজের দিকে রওনা হলো। তীর থেকে একশ গজ দূরে নোঙর করা হয়েছে।
আশা হলো আবার কিশোরের। তীরে নেমে ক্যাম্প আর ঝিনুকের খোলা পাওয়ার পরেও যখন কিছু করেনি, আর করবে না। ফিরে যাবে কারনেস।
কিন্তু নড়লো না জাহাজটা। নোঙর তোলার কোন লক্ষণই নেই। জাহাজ আর পাল মেরামতে ব্যস্ত নাবিকেরা। যতই সময় যাচ্ছে উৎকণ্ঠা বাড়ছে কিশোরের। বিমানটা কখন এসে হাজির হয় কে জানে। তাহলে শুরু হবে বড় রকমের গন্ডগোল।
সারাটা দিন গেল। পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলো সূর্য। তখনও দেখা নেই বিমানের। আসেনি বলে বরং স্বস্তিই বোধ করছে কিশোর। ভালই হয়েছে। কারনেস চলে যাওয়ার পর আসুক। তাহলে অহেতুক গোলমাল এড়ানো যাবে।
কিন্তু জাহাজটার নড়ার কোন লক্ষণই নেই।
ঝিনুকের দিকে ফিরলো কিশোর। আচ্ছা, ছোট একটা নৌকায় করে এখান থেকে রাটুনায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
এক মুহূর্ত ভাবলো ঝিনুক। একদিন। বড় জোর দুদিন।
জাহাজের পাশে বাধা ডিঙিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ওই নৌকাটা হলে?
ঝিনুক জানালো, রাতের বেলা রওনা হতে পারলে পরদিন গিয়ে তার পরদিন সকালে রাটুনায় পৌঁছতে পারবে।
পথ চিনে যেতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করলো না কিশোর। সে নিশ্চিত, একটুও ভুল না করে চলে যেতে পারবে সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক।
তাহলে, ঘোষণা করলো যেন কিশোর। রাতে কারনেসরা ঘুমিয়ে পড়লে নৌকাটা চুরি করবো আমরা।
কিশোরের কথা শুনে খুব খুশি সাগরের হাসি আর ঝিনুক। উত্তেজনা ফুটলো চেহারায়। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালো ডিঙিটার দিকে, যেন ওটা মহামূল্যবান একটা বস্তু।
ভাবছে কিশোর, ডিঙি চুরি করাটা কিছুই না। অন্ধকারে নিঃশব্দে সাঁতরে চলে যেতে পারবে ওটার কাছে। তারপর বাঁধন খুলে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেই হল। ভয় একটা আছে অবশ্য, হাঙরটার। ওটা এখনও লেগুনে রয়েছে কিনা কে জানে। সারা দিনে একবারও ওটার পাখনা দেখা যায়নি যদিও। তবু থাকতে পারে। কিছু করার নেই। ডিঙিটা পেতে চাইলে ঝুঁকিটা নিতেই হবে।
এখানকার গোধূলি খুব সংক্ষিপ্ত। এসেই চলে যায়। সেদিনও গেল। অন্ধকার নামলো। একটামাত্র আলো জ্বলছে জাহাজে। নাবিকদের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় রইলো কিশোর। অন্ধকারে এখনও যেতে পারে, ডেকের ওপর দেখা যাচ্ছে না কাউকে। কিন্তু বলা যায় না। বেরিয়ে আসতে পারে। তাড়াহুড়ো করে অযথা বিপদে পড়ার কোন মানে হয় না।
কোন শব্দ নেই জাহাজে। ডেকে একবারের জন্যেও আর কেউ আসেনি। সারাদিন খেটেছে নাবিকেরা। সন্ধে হতে না হতেই তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। উঠে। দাঁড়াল কিশোর। চাঁদ ওঠেনি এখনও। তবে তারার আলো আছে। আকাশটাকে লাগছে বিশাল এক গম্বুজের মতো। ভেতরের দিকে যেন ঝুলে রয়েছে তারাগুলো।