ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একটানা বয়ে চললো ঝড়। বিকেল চারটের দিকে কমে এলো বাতাসের বেগ। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তিতে একবারে কাহিল হয়ে পড়েছে কিশোর। গাছ জড়িয়ে ধরে রাখার শক্তিও যেন নেই।
পানি নেমে যেতে শুরু করলো। মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো সূর্য। দিগন্তসীমার কাছাকাছি নেমে গেছে। বিরাট এক আগুনের গোলার মত লাগছে এখন ওটাকে।
নামবে কিনা জিজ্ঞেস করলো কিশোর। মাথা নাড়লো সাগরের হাসি। এখনও সময় হয়নি।
সূর্য ডুবলো। সাগরের হাসি ঘোষণা করলো, এবার নামা যেতে পারে। নেমেই ভেজা মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো কিশোর। শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি ব্যথা হয়ে গেছে। লবণে শক্ত হয়ে গেছে চুল এমনকি ভুরু পর্যন্ত।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। তবে সকলেই খুশি। ঝড়টা কাটাতে পেরেছে। আর বেঁচে তো রয়েছে এখনও। কোন কিছু নিয়েই একটুও উদ্বিগ্ন হলো না দুই পলিনেশিয়ান।
খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠলো ওরা। এগোল ক্যাম্প এলাকার দিকে। দ্বীপের চেহারা বদলে দিয়ে গেছে ঝড়। প্রবালের অনেক চড়া গায়েব হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় মাটি খুবলে নিয়ে গেছে ঢেউ। পানিতে ভেসে গেছে অনেক পাতা, কিছু কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখনও। তবে তার চেয়ে বেশি জমে রয়েছে সামুদ্রিক আগাছা। আর রয়েছে ঝিনুক। অগুনতি। নানা জাতের, নানা আকারের। ওসবের মাঝে কিলবিল করছে কাঁকড়ার দল। আরও নানা রকম জলজ প্রাণী উঠে এসেছিলো ঢেউয়ে, নামার সময় আর যেতে পারেনি, আটকা পড়েছে বালিতে।
ক্যাম্প এলাকাটা সব চেয়ে উঁচু ওই দ্বীপে। ওখানে পানি ওঠেনি। কাছাকাছি ঝাপটা দিয়ে গেছে শুধু ঢেউ। পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে রেখে গেছে। প্রবালের চাঙড়ের খাঁজে একটিন গরুর মাংস আটকে থাকতে দেখলো কিশোর। কয়েক টিন কনডেনসড মিল্ক, আর এক টিন বিস্কুট পাওয়া গেল, বালিতে অর্ধেক গাঁথা অবস্থায়। খিদেয় চো চো করছে পেট। তর সইছে না আর। সাগরের হাসির কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে মাংস আর বিস্কুটের টিন কাটলো সে। মুখে দিয়ে চিবুতে গিয়ে টের পেল জিভই নাড়তে পারছে না। শুকিয়ে যেন আঠা হয়ে লেগে গেছে মুখের ভেতরে। পানি দরকার। ঝর্নাটার দিকে চলল সে। কিন্তু গিয়ে অবাক হয়ে গেল। যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই ওটা। বালিতে ঢাকা পড়ে গেছে।
দুই পলিনেশিয়ানও এসেছে তার পিছু পিছু। তাদের দিকে চেয়ে গুঙিয়ে উঠলো কিশোর, পানি নেই! এবার মরব!
হেসে উঠলো সাগরের হাসি। না, মরব না। পানি অনেক আছে। পড়ে থাকা অনেক ডাব দেখালো সে।
তাই তো! ভুলেই গিয়েছিলো কিশোপ। চিন্তা দূর হলো।
একটা ডাব তুলে নিলো সাগরের হাসি। ছুরি দিয়ে মুখটা কেটে ছিদ্র করে তুলে দিলো কিশোরের হাতে।
মিষ্টি পানিতে ভরে গেল কিশোরের মুখ। জিভ নাড়তে কষ্ট হচ্ছে এখনও। আস্তে আস্তে ভিজিয়ে নরম করে আনলো। পানি খাওয়ার পর ডাবটাকে দুই টুকরো করে ভেতরের নরম মিষ্টি শাস খেলো সে। অনেকটা বল ফিরে পেলো শরীরে।
ভেজা মাটিতে বসে নীরবে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া চালিয়ে গেলো ওরা। ধীরে ধীরে খাচ্ছে। গরুর মাংস, বিস্কুট আর নারকেল।
শেষ হলো খাওয়া। চাঁদ উঠেছে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। সাগরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কিশোর, ওমররা প্লেন নিয়ে নিরাপদ জায়গায় যেতে পেরেছে তো? নাকি ডুবে মরেছে সাগরে? কালকের মধ্যে যদি ফিরে না আসে, তাহলে বুঝতে হবে বেঁচে নেই ওরা।
বেশিক্ষণ দুশ্চিন্তা করার সুযোগ পেলো না কিশোর। এতে ক্লান্ত হয়েছে শরীর, বসেও থাকতে পারছে না আর। শুয়ে পড়লো বালিতে। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
১১
সকালে আগে ঘুম ভাঙলো কিশোরের। চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো নীল আকাশের দিকে, পুরো দুই মিনিট। কি যেন একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে, অনুভূতি বলছে। হঠাৎ মনে পড়লো। গন্ডগোলটা আর কিছু না, আগের দিনের ঝড়। বিপদে রয়েছে ওরা। নড়তে ইচ্ছে হলো না। বাতাস তাজা। গায়ে পরশ বোলাচ্ছে যেন ভোরের কাঁচা রোদ। বেশ আরাম। মাথার নিচে হাত দিয়ে চিত হয়ে থেকে ভাবতে শুরু করলো সে।
কি করেছে ওমর ভাই? তার জায়গায় সে নিজে হলে কি করতো? ওদেরকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি, কারণ ঝড় আসছিলো, বিমানটাকে বাঁচানোর জন্যে শেষে মুসা আর ডজকে নিয়ে উড়ে চলে গেছে। অবশ্যই ফিরে আসবে আবার। ঝড়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে ওরা, ভাবতেই পারলো না কিশোর। এত সহজে মরবে না। যে কোন মুহূর্তে এখন ফিরে আসতে পারে।
চোখ মেললো সাগরের হাসি। উঠে বসে কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। লেগুনের দিকে ফিরলো। সাগরের দিকে চোখ পড়তেই হাসি মিলিয়ে গেল মুখ থেকে। বলে উঠলো, সর্বনাশ! কারনেস!
লাফিয়ে উঠে বসলো কিশোর। লেগুনে ঢোকার প্রণালী দিয়ে ঢুকছে স্কুনারটা। ঝড়ে পড়েছিলো, অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত। একটা পালও আস্ত নেই। কারনেসের হোয়াইট শার্ক, কোন সন্দেহ নেই। দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত জাহাজটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো কিশোর, কি করবে? ঝিনুকের পা ধরে ঝাঁকানি দিলো, এই ঝিনুক, ওঠ।
উঠে বসলো ঝিনুক। জাহাজটা দেখে দূর হয়ে গেল ঘুম। ভয় দেখা দিলো চোখে।
নড়ো না, হুঁশিয়ার করলো কিশোর। হয়ত আমাদেরকে দেখেনি। এসেছে কোন কারণে। আমাদের না দেখলে চলে যাবে শীঘ্রি।