গুহায় অসুবিধে হচ্ছিলো, ঝিনুক বললো। অনেক বড় তো। হাঁসফাস লাগছিলো হয়ত। তাই বেরিয়ে পড়েছে।
চারপাশে তাকানোর সুযোগ পেলো এতক্ষণে কিশোর। অনুভব করলো ঝড়ের শক্তি। বাতাসের অদৃশ্য থাবা তার দেহ আঁকড়ে ধরে যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কাত হয়ে যাচ্ছে নারকেলের পাতা, ছিড়ে চলে যাচ্ছে ডালের গোড়া থেকে। লেগুনের দেয়ালের নিচে যেন কয়েক কোটি দৈত্যের তান্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে। এমন করে ফুসছে সাগর। শাদা ফেনায় ভরে গেছে লেগুনের পানি। দেখে বিশ্বাসই হয় না, ঝলমলে রোদের সময় ওটা নীল ছিলো। কালচে-ধূসর আকাশের মতই এখন রঙ হয়ে গেছে পানির।
বিমানটাকে খুঁজতে গিয়ে হাঁ হয়ে গেল কিশোর। ছোট্ট একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে। নেই। সে ভাবলো, প্রচন্ড ঢেউ নোঙর ছিড়ে নিয়ে গেছে ওটাকে, ডুবিয়ে দিয়েছে। মুসারা কোথায়? সাগরের হাসি আর ঝিনুককে বললো সে, দেখতে যাচ্ছে। বাতাসের মধ্যে মাথা নিচু করে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলো কতটা ভয়ংকর ঝড়। প্রচন্ড বাধার বিরুদ্ধে যেন লড়াই করতে করতে এগোতে হলো তাকে। যেখানে ক্যাম্প করেছিলো ওরা সেখানে এসে দেখলো কোন মানুষ নেই। মাটিতে বিছিয়ে রয়েছে নারকেল পাতা। ইতস্তত পড়ে থাকা কয়েকটা কাঠের বাক্স প্রমাণ করছে এখানে ক্যাম্প ছিলো। হতাশ কণ্ঠে চিৎকার করে যেন নিজেকেই বোঝালো সে, ওরা চলে গেছে!
সৈকতের দিকে তাকালো। যেখানে বিমানটা বাঁধা ছিলো। বিড়বিড় করে বললো, নিশ্চয় ঝড় শুরু হতেই চলে গেছে।
ওসব নিয়ে পরে ভাববে। আপাতত মাথা গোঁজার একটা ঠাই দরকার। দ্বীপের মাঝখানের দিকে চললো সে। ওখানে নারকেল গাছের জটলার ভেতরে ঢুকে বসার ইচ্ছে। কিন্তু এমন ভাবে ছোটাছুটি করছে নারকেলের পাতা, নিরাপদ মনে করতে পারলো না জায়গাটাকে।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের দিকে তাকালো। হাত নেড়ে সেদিকেই যাওয়ার ইঙ্গিত করলো ওরা। ওরাও সেদিকে চলেছে। নিশ্চয় কোন কারণ আছে। এসব ঝড় দেখে অভ্যস্ত পলিনেশিয়ানরা। ঝড়ের সময় আত্মরক্ষা করতে হয় কিভাবে জানে।
নারকেলের জটলার ভেতরে পৌঁছে গেল ওরা। মুখের কাছে দুহাত এনে কিশোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ঝিনুক বললো, বাতাস পড়ে গেলেই আসবে, বড় জোয়ার।
বোধহয় জলোচ্ছ্বাসের কথা বলছে ঝিনুক। পাগল হয়ে যাওয়া বিশাল ঢেউয়ের দাপাদাপির দিকে তাকিয়ে কিশোর বললো, এর চেয়ে বড়?
হ্যাঁ। দ্বীপ ভাসিয়ে দেবে। এস। যেন ঝিনুকের কথার সমর্থনেই বিশাল এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো সৈকতে, পানি উঠে চলে এল অনেকখানি ওপরে।
এস এস!
নারকেল উড়ছে না আর। কারণ ওড়ার মত নেইই। সব পড়ে গেছে, বিছিয়ে রয়েছে গাছের তলায়। মোটা একটা গাছ বেছে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো সাগরের হাসি। গাছের চারপাশ ঘিরে খাঁজ কাটছে। কাটা শেষ করে নিজের শরীর পেঁচিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধলো গাছের সঙ্গে, দড়িটা বসিয়ে দিয়েছে খাঁজের মধ্যে। ক্যাম্পের কাছে দড়ি পড়ে ছিলো, ওখান থেকে তুলে এনেছে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো, গাছে ওঠার জন্যে। তার সঙ্গে একই গাছে।
ঠিক কি করতে চাইছে সাগরের হাসি তখনো বুঝতে পারছে না কিশোর। যা করতে বলা হলো করলো সে। মেয়েটার কাছে উঠে এলো। আরেকটা খাঁজে দড়ি বসিয়ে কিশোরের চারপাশে পেঁচিয়ে বাঁধলো সাগরের হাসি।
ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে ব্যাপারটা কিশোরের কাছে। বাতাসে দুলছে নারকেলের কান্ড, মাঝে মাঝে এত বেশি নুয়ে পড়ছে তার ভয় লাগছে ভেঙেই না যায়। মাটি থেকে অনেক ওপরে রয়েছে। দড়ি ছিড়ে গেলে কি হতে পারে কল্পনা করতে চাইলো না সে।
ক্রমেই এগিয়ে আসছে ঢেউ, পানি উঠছে দ্বীপে। সব চেয়ে উঁচু জায়গাটায় উঠতেও দেরি হবে না, বুঝতে পারছে কিশোর। এখনও গুহার ভেতরে থাকলে কি অবস্থা হতো ভেবে গায়ে কাঁটা দিলো তার। হাঙরে না খেলেও পানিতে ডুবেই মরতে হতো। নিশ্চয় এতোক্ষণে পানিতে ভরে গেছে গুহাঁটা।
মাথা ঘুরিয়ে তাকালো কিশোর। আরেকটা গাছে উঠে একই ভাবে নিজেকে বেঁধেছে ঝিনুক। এই বাতাসের মধ্যে নারকেলের কান্ড আঁকড়ে থাকা যে কতটা কঠিন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান। ওই মুহূর্তে তার মনে হলো এসব অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে গোয়েন্দাগিরি অনেক ভালো এবং সহজ।
তার দিকে তাকিয়ে হাসলো ঝিনুক। বাপরে, বাপ! সাহস আছে ওদের! ভাবলো কিশোর।
গাছের কান্ড আঁকড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কখন থামবে সেটা ঝড়ের ইচ্ছে।
এক ঘণ্টা পেরোল, দুই ঘণ্টা। তারপর আচমকা নীরব হয়ে গেল সব কিছু। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি মাথার ওপরে নীল আকাশও চোখে পড়লো একটুকরো।
যাক, ঝড়টা তাহলে গেল। হাঁপ ছাড়লো কিশোর।
কিন্তু মাথা নাড়লো সাগরের হাসি। উহু! শেষ হয়নি। এটা ঝড়ের মধ্যিখাটা। আবার আসবে বাতাস।
মেয়েটা কি বলছে বুঝতে পারলো কিশোর। মনে পড়ল অথৈ সাগর অভিযানের কথা। সেবারেও হারিকেনের মাঝে পড়েছিল জাহাজ। ঝড়ের মধ্যিখান বলতে কেন্দ্রবিন্দু বোঝাচ্ছে সাগরের হাসি। ঝড়ের কেন্দ্রে বাতাস থাকে না, সেটা পেরোলেই আবার আগের মত জোরালো তুফান শুরু হবে।
বেশিক্ষণ থাকলো না ওই নীরবতা। হঠাৎ যেমন থেমে গিয়েছিল, তেমনি হঠাৎই আবার এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো বাতাস। মাথার ওপর থেকে হারিয়ে গেল নীল আকাশ। ধেয়ে এল ঢেউ।