শান্ত পানিতে কাঁপন উঠেছে এখন। হাঙরটা চুপ করে রয়েছে, আলোড়নটা তার সৃষ্ট নয়। পানি একবার উঠছে একবার নামছে। সেদিকে তাকিয়ে ঝিনুককে বললো কিশোর, ঠিকই বলেছ। ঝড়ই আসছে।
ঝড় থেমে গেলেই ম্যাকো চলে যাবে, বললো ঝিনুক।
ঝড়টা কতক্ষণ থাকবে?
দুই দিন। তিন দিন। ঠিক নেই।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো কিশোর। প্রবালের টুকরো ভেঙে ভেঙে ছুঁড়ছে সাগরের হাসি। যেন ঝাল মেটাচ্ছে হাঙরের ওপর। গায়েই যেন লাগছে না এই আঘাত, কিংবা অপমান গায়ে মাখছে না হাঙর। চুপ করে রয়েছে সেটা। দ্রুত অন্ধকার হয়ে গেল। আলোর কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। তার মানে একটা রাত এই গুহার ভেতরে অন্ধকারে কাটাতে হবে, যদি মুসা না আসে। আল্লাহ্, না আসুক, প্রার্থনা শুরু করলো কিশোর। না আসুক! অন্ধকারেই থাকব আমরা!
ঘুটঘুটে অন্ধকার। পানির ওঠানামার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দও নেই। হাঁটুতে থুতনি রেখে রাত কাটাতে তৈরি হলো কিশোর। জীবনের দীর্ঘতম রাত।
রাত যেন আর শেষই হতে চায় না। ভোরের আলো আসতে এত দেরি হচ্ছে, একসময় কিশোরের মনে হল দেয়াল ধসে পড়ে গুহার মুখটাই বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে। পানির ওঠানামার শব্দ বাড়ছে। তার মানে বাইরে ঝড়ও বাড়ছে। ঘুমানো তো দূরের কথা, চোখের পাতাও এক করতে পারছে না সে। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, তাকিয়ে রয়েছে তবু।
অবশেষে দেখা গেল আলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। নাহ, গুহার মুখটা খোলাই আছে, দেয়াল ধসে পড়েনি। কিন্তু আলো বাড়লেও পানির রঙ আর নীল হলো না। ধূসর, একঘেয়ে, বিষন্ন। আবার দুশ্চিন্তা হতে লাগলো মুসার জন্যে। রাতের অন্ধকারে পানিতে নামেনি বটে, কিন্তু এখন আলো ফুটেছে। নিশ্চয় দেখতে আসবে।
গুহার দেয়ালে হেলান দিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক। যেন ঘরের ভেতরে রয়েছে। ভাবনার কিছুই নেই এখানে। কোন বিপদ নেই, ভয় নেই। আস্তে করে ঝিনুকের কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল সে। জেগে গেল ঝিনুক। সাগরের হাসিও। পানির রঙ দেখাতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল, পাখনাটা দেখা যাচ্ছে না। তার মানে কি হাঙরটা নেই?
ভালো করে দেখে ঘোষণা করলো সাগরের হাসি, নেই, চলে গেছে। স্বস্তির কাপা নিঃশ্বাস পড়লো কিশোরের। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে যাবে, এই সময় গম্ভীর মুখে ঝিনুক বললো, ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে না বটে। হয়ত নিচে ডুবে রয়েছে। নামলেই ধরবে।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল যেন কিশোর। এটা ভাবেনি। সত্যি, নিচে ডুব দিয়ে থাকতেই পারে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন হাঙরটা ভাসলো না, উঠে দাঁড়ালো ঝিনুক। বললো, আমি যাচ্ছি।
হাঙরটা যদি থাকে? কিশোরের প্রশ্ন।
লড়াই করবো। হয় ম্যাকো মরবে। নয়তো আমি।
মাথা নাড়লো কিশোর। তবে নিষেধ করতে পারলো না ঝিনুককে। করতে হলে অন্য কোন উপায় বাতলে দিতে হবে এখান থেকে মুক্তির। সেটা যখন পারছে না, কি আর বলবে।
আমি যাই, আবার বললো ঝিনুক। তোমরা থাক। ম্যাকো না থাকলে ফিরে আসব।
এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে চলেছে কেন ঝিনুক, বুঝতে পারছে কিশোর। মুসার কথা ভেবে। তাকে যেতে না দেয়াই উচিত। কিন্তু এবারও মানা করতে পারলো না। ভাবলো, সে নিজেও যাবে। সাহায্য করবে ঝিনুককে। পরক্ষণেই বাতিল করে দিলো চিন্তাটা। বদ্ধ জায়গায় উপকার তো করতেই পারবে না, গিয়ে আরও সমস্যা বাড়াবে ঝিনুকের। অসহায় দৃষ্টিতে সাগরের হাসির দিকে তাকালো সে। পানির দিকে চেয়ে রয়েছে মেয়েটা। বোধহয় ম্যাকোকে খুঁজছে।
ওই মুহূর্তে ছুরি কামড়ে ধরে পানিতে ঝাঁপ দিলো ঝিনুক। কোমরের ছুরির বাঁটে হাত ছোঁয়ালো সাগরের হাসি। তৈরি রয়েছে। দরকার হলেই যাতে ঝাঁপ দিতে পারে।
কয়েকটা সেকেন্ড পানির দিকে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। তারপর আচমকা কোমর থেকে ছুরিটা টেনে বের করে দাঁতে কামড়ে নিয়ে দিলো ঝাঁপ। কিশোর কিছু বলার সময়ও পেল না, বাধা দেয়া দূরে থাক। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো পানির দিকে।
বেশ আলোড়ন উঠতে লাগলো। যেন হঠাৎ করেই সাংঘাতিক তোলপাড় শুরু হয়েছে তলায়। গুহামুখের কাছে কালো ছায়া দেখতে পেল বলে মনে হলো তার। মিনিট কাটছে। উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠেছে স্নায়। ভেসে উঠলো ঝিনুকের মাথা। ডেকে বললো, জলদি এস!
ম্যাকো গেছে?
জলদি এস! বড় বড় ঢেউ!
একবার দ্বিধা করলো কিশোর। তার পরই ঝাঁপ দিলো পানিতে নেমে চললো ঝিনুকের পিছু পিছু। ভয়ে বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি এসে পা কামড়ে ধরলো হাঙরটা।
ঠেলে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরতে চাইছে তাকে স্রোত। ঢোকার সময় এই স্রোত ছিলো না। এখন এলো কোথা থেকে? হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে চললো ঝিনুক। সুড়ঙ্গের মুখের ভেতরে ঢুকতেই যেন অদৃশ্য এক দানবের হাত হ্যাচকা টানে বাইরে বের করে নিয়ে গেল তাকে। তারপর ছুঁড়ে দিলো ওপর দিকে।
কি করে ডাঙায় উঠলো কিশোর, বলতে পারবে না। শুধু মনে আছে, পেছন থেকে তাকে ঠেলছে ঝিনুক, আর চুল ধরে তাকে টেনে তুলছে সাগরের হাসি। হাঁটু পানিতে থাকতেই পেছন থেকে এসে ধাক্কা মারলো মস্ত এক ঢেউ। তিনজনকেই প্রায় ছুঁড়ে ফেললো সৈকতে।
ধপ করে বসে পড়লো কিশোর। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো ঝিনুক। হাত তুলে দেখালো ঢেউয়ের দিকে। মস্ত একটা পাখনা ভেসে উঠেছে। শিউরে উঠলো কিশোর। ওরা যখন বেরিয়ে আসছে তখনও কাছাকাছিই ছিল হাঙরটা।