বছর দেড়েক আগে, টাকাপয়সা নেই আমার হাতে। শেষে এক জাহাজে চাকরি নিলাম। মালিক করসিকার লোক, ভীষণ পাজি। নাম গুডু কারনেস। অনেক বদনাম আছে লোকটার। তার শয়তানী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি। চিনতে দেরি হয়নি। ওসব দ্বীপে তো চিনতে সময় লাগে না। সবাই খোলামেলা। বুঝেও কিছু করতে পারলাম না। চাকরিটা না নিয়ে উপায় ছিলো না আমার। আর কোনো কাজ পাচ্ছিলাম না। মারকুইসাস হয়ে পমোটাস ঘুরে এসেছে সবে তার জাহাজ। জাহাজটারও অদ্ভুত নাম রেখেছে। দুনিয়ার ভয়ংকরতম হাঙরের নামে নাম, হোয়াইট শার্ক; যতোটা নোংরা করা সম্ভব করে রেখেছে। তেলাপোকা আর ছারপোকায় বোঝাই। নারকেলের ছোবড়ায় একরকম পোকা হয়, সাংঘাতিক যন্ত্রণা দেয়, সেই পোকারও অভাব নেই। আর তেলাপোকাও যা একেকখান। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ওসব তেলাপোকার কথা আরেকদিন বলবো তোমাকে। রাতে ঢেকেঢুকে না ঘুমালে ঘুমের মধ্যেই পায়ের তলার চামড়া খেয়ে সাফ করে দেবে, টেরও পাবে না। সকালে উঠে যখন আর দাঁড়াতে পারবে না তখন বুঝবে মজা। হারামীর একশেষ। ওই জাহাজে করেই রওনা হয়ে পড়লাম একদিন পাপিতি বন্দর থেকে। লম্বা একটা পাড়ি জমাবে গুডু কারনেস। ছয় মাস, এমনকি নয়মাসও লেগে যেতে পারে।
যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম তার চেয়েও খারাপ কারনেস। আস্ত শয়তান। ভীষণ মুখ খারাপ। আমি বাদে আরও আটজন নাবিক তার জাহাজে। স্থানীয় লোক। ওগুলোও মহা বদমাশ। বোধহয়, একারণেই ওদেরকে বাছাই করেছে সে। সাধারণত স্থানীয় মানুষেরা ভালো হয়, তাহিতি, মারকুইস, পমেটোর লোকেরা। কিন্তু কারনেসের লোকগুলোর বাড়ি ওসব অঞ্চলে হলেও বেজায় খারাপ। পরে শুনেছি, মানুষের মাংস খাওয়ার অপরাধে অস্ট্রেলিয়ায় জেল খাটতে হয়েছে ওদের। তাতে আর অবাক হইনি তখন। ততোদিনে জেনে গেছি, কপালে দুঃখ আছে আমার। তবে কতোটা দুঃখ আছে তা যদি জানতাম, দ্বীপ থেকে নড়তামই না; যতোই না খেয়ে মরি। সাগরে বেরোনোর পর জানতে পারলাম কারনেসের জাহাজে কি আছে। স্থানীয়দের কাছে স্পিরিট বিক্রি করা ওখানে বেআইনী। ওসব খেলে কতোটা ক্ষতি হয়, ভালো করেই জানে স্থানীয়রা। তার পরেও খায়। আর সাপ্লাই দেয়ার লোকেরও অভাব নেই। নানারকম কায়দা করে চালান দেয়া হয় ওগুলোকে। এই যেমন সেন্টের শিশিতে ভরে, কিংবা তেলের বোতলে ভরে। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না আমার। কারনেসের সঙ্গে কথা বললাম। স্বীকার করলো সে, আছে। নিজেও প্রচুর গিলে সে। অন্য ব্যবসায়ীদের মতো সেন্টের কিংবা তেলের বোতলেও ভরেনি সে, এতোই বেপরোয়া। সরাসরি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়, কেয়ারই করে না আইনের। ওর ওসব ব্যবসায় আমি জড়াতে চাই না, সাফ বলে দিলাম। তর্কাতর্কি হলো, ঝগড়া হলো। শেষমেষ বোকার মতো হুমকি দিয়ে বসলাম আমি ওকে। পুলিশকে বলে দেব। বলার সময়ও বুঝিনি, আমাকে পুলিশের কাছে পৌঁছতেই দেবে না সে।
যাই হোক, আমি আমার মতো আছি। আর কারনেস তার সলোমন আইল্যান্ডের গলাকাটা ডাকাতগুলোকে নিয়ে সারাদিনই মদে চুর হয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করতে পারো, ওই অবস্থায় জাহাজ চলছিলো কি করে? চলছিলো। তার কারণ কারনেসের লোকগুলো সব পাকা নাবিক। ওসব অঞ্চলের সব লোকই ভালো নাবিক। সমুদ্র সম্পর্কে অসীম জ্ঞান। ছোট একটা ক্যানুতে করেও বিশাল সাগর পারি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। কম্পাস-টম্পাস বাদেই দুহাজার মাইল দূরের অন্য কোনো দ্বীপে চলে যেতে পারে, একটুও ভুল করে না। বিশ্বাস করো, এক বিন্দু বাড়িয়ে বলছি না। প্রথমে আমরা গেলাম পমোটোসে। ঠিক দ্বীপ বলা যায় না। ওটাকে, একসারি প্রবালের দেয়াল বলাই ভালো। পানি থেকে বেশি উঁচু নয়। তাই অনেকে এর নাম দিয়েছে লো আরচিপেলাজো। স্থানীয়রা নাম দিয়েছে বিপদের দ্বীপ, এটাই মানিয়েছে ভালো। ওখানকার সাগরে জাহাজ চালানো যতোটা কঠিন, পৃথিবীর আর কোনো সাগরেই ততটা নয়। মারকুইসাসের দিকে চললাম আমরা। ওটা হলো পমোটোস থেকে একেবারে ভিন্ন জাতের। আগ্নেয় শিলায় বোঝাই, আর রয়েছে ঘন জঙ্গল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মস্ত কোনো মহাদেশ ছিলো একসময় ওই জায়গাটায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সাগরের নিচে চলে গেছে। উঁচু পার্বত্য অঞ্চলগুলো ডোবেনি, বেরিয়ে রয়েছে এখনও পানির ওপরে। দেখে অবশ্য সেরকমই মনে হয়। হাজার হাজার ফুট উঁচু বড় বড় পাহাড় যেন তালগোল পাকিয়ে রয়েছে। পাহাড়ের এরকম চেহারা আর কোথাও দেখা যায় না। কোনো কোনোটা তো বিশাল। হ্যাঁ, যা বলছিলাম।
দুটো দ্বীপপুঞ্জকেই ম্যাপে দেখে মনে হবে খুব বুঝি কাছে। আসলেই কাছে, অবশ্যই দক্ষিণ সাগরের বেলায়। ওখানে পাঁচশো মাইল কিছুই না। এখানে আমেরিকায় এই দূরত্ব অনেক বেশি। ওখানে শত মাইলের হিসেবটাকে কিছুই মনে করা হয় না। বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ নিয়ে হয়তো বেরিয়ে পড়লে, চলছে তো চলছেই, ছহাজার সাত হাজার মাইল পেরিয়ে গেলে, এতো মাইলের মধ্যে ছোট একটা প্রবাল প্রাচীর দেখা না গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওখানে ওরকমই। মারকুইসাসের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। ভালো বাতাস পাওয়ার জন্যে সামান্য একটু বায়ে কেটে চালাচ্ছে নাবিকেরা। বোধহয় তাতেই, কিংবা বাতাসের কারণে সরে গেল জাহাজ। একটা দ্বীপ দেখতে পেলাম। নাবিকেরা তো বটেই, কারনেসের কাছেও দ্বীপটা নতুন। আগে কখনও দেখেনি। গ্যালাপাগো থেকে ল্যাডরোনি পর্যন্ত এলাকা যাদের নখদর্পণে, তাদের নজরে ওই দ্বীপ পড়েনি! অবাকই হলাম। ওরা হলো না। প্রশান্ত মহাসাগরে দ্বীপের অভাব। নেই, কখন কোন একটা দ্বীপ নজর এড়িয়ে গেল, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই ওদের। যেহেতু অচেনা দ্বীপ, নোঙর করার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না কারনেস। দ্বীপটা নির্জন। ওখানে থেমে তার কোন লাভ হবে না। এইখানে এসেই আমার আসল গল্প শুরু, এবং এখানেই আমার প্রাণ প্রায় যেতে বসেছিলো।