দেখার মত হলো ডজের চেহারা। মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে বললো সে, আগেই বলেছি, আমি একটা হতভাগা! পোড়া কপাল! মুক্তো কি আর আমার মত লোকের কপালে সইবে! দুহাতে মাথা চেপে ধরলো সে। রয়ে গেছে দ্বীপেই। পাথরের নিচে যেখানে রেখেছিলাম।
ঘুরতে ঘুরতে এসে মাথার ওপরে হাতে পড়লো একটা নারকেল পাতা।
বাহ, চমৎকার! এভাবে পড়তে থাকলে ছাতটাও কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে আল্লাহই জানে! ওমরের কণ্ঠে সন্দেহ।
১০
কোথায় যে গেছে কিশোর, মুসার অন্তত এটা বোঝা উচিত ছিলো। কিন্তু উত্তেজনা আর বিপদের সময় হাত-পা যতটা সহজে খেলে ততটা খেলে না তার মগজ। সে জায়গাটায় মুসা গিয়েছে, কিন্তু সেকথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি ওমর কিংবা ভজকে। তাহলে ওরা হয়ত অনুমান করতে পারতো।
ডজের অনুরোধে গুহার কাছে এসে মাছ ধরতে বসলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। তাদের পাশে কিশোর। দেখতে দেখতে যথেষ্ট মাছ ধরা হয়ে গেল। আগের দিনের মতই প্রস্তাব দিলো সাগরের হাসি, সাঁতরাতে নামবে। বলেই নেমে পড়ল।।
ঝিনুকও কি আর বসে থাকে? নেমে পড়লো সে-ও। কিশোর ভাবলো, গুহাঁটা দেখেই আসা যাক। এত সুন্দর যখন বলেছে মুসা।
সাগরের হাসি আর ঝিনুককে বললো সেকথা। ওরা তো বলতেই রাজি। ঢুকে পড়লো তিনজনে।
গুহাঁটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল কিশোর। মুসার মত এত সহজে আগ্রহ নষ্ট হলো তার, দেখছেই, দেখছেই। কোন দিক দিয়ে যে বেরিয়ে যাচ্ছে সময়, খেয়ালই রাখছে না।
অবশেষে যখন খেয়াল হলো, তাকে বসেই মুখ ফিরিয়ে দুই সঙ্গীকে বললো সে, চল, যাই। আর দেরি করলে রাত হয়ে যাবে। পানির দিকে তাকিয়ে কি ভাবলো। দেখ, পানির রঙ কেমন বদলে যাচ্ছে। না?
তাকের ওপর দাঁড়িয়ে সাগরের হাসি আর ঝিনুকও তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে। তাকের কিনার ধরে দুই হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে উঁচু করলো কিশোর। এক দোলা দিয়ে আলগোছে ছেড়ে দিতে যাবে এই সময় চিৎকার করে উঠলো সাগরের হাসি, ম্যাকো! ম্যাকো?
শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালো কিশোর। কিংবা বলা যায় ভীষণ চমকে গিয়ে শরীরটাকে ছেড়ে দিলো। ধপ করে বসে পড়লো আবার তাকের ওপর। কি বললে?
পানির দিকে হাত তুলে রেখেছে সাগরের হাসি।
মস্ত একটা তিনকোণা পাখনা ভেসে উঠেছে পানিতে। গুহার প্রবেশ মুখের কাছে। এগিয়ে আসতে লাগলো ধীরে ধীরে।
পুরো একটা মিনিট নীরবে তাকিয়ে রইলো কিশোর। লেগুনের পানিতে এখানে এই প্রথম হাঙর দেখলো। বাধা দিতে আর একটা সেকেন্ড দেরি করলে সাগরের হাসি কি ঘটত ভেবে শিউরে উঠলো। কি করবো? প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো সে।
বসে থাকতে হবে, বললো ঝিনুক। আর তো কোনো উপায় দেখি না।
সাত দিনেও যদি না যায় ওটা?
আমাদেরও থাকতে হবে।
তাকে উঠে দাঁড়ালো কিশোর। সে যেখানে রয়েছে তার ফুট দশেক দূরে ভেসে উঠলো বিশাল হাঙরের পিঠ। এত বড় ওটা, গুহাঁটা যেন প্রায় ভরে গেল। ছোট ওই বদ্ধ জায়গায় তিমির চেয়ে বড় লাগলো ওটাকে। যেখানে রয়েছে ওরা, নিরাপদেই থাকবে। কারণ তাকটা পানি থেকে তিন ফুট উঁচুতে, কোন জায়গায় দুই ফুট। ওপরে থাকলে কিছু হবে না, কিন্তু পানিতে পা নামালে মহা বিপদে পড়বে। পা কামড়ে ধরে টেনে নিতে পারে হাঙরটা। আর তার অর্থ ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
আটকা পড়লাম আমরা! বললো সে। বেরোতে পারব না। কিন্তু ব্যাটা এখানে এল কেন মরতে?
অনেক বড় ঝড় আসছে, ঝিনুক বললো। হয়ত হারিকেন। বড় বড় মাছ যখন লেগুনে ঢোকে, গুহায় ঢোকে, বুঝতে হবে বাইরের সাগরের অবস্থা খারাপ।
তাহলে এখন কি করব? এসব অবস্থায় কি করতে হয় তোমরাই ভাল বোঝ।
থাকতে হবে, আরকি।
মারা যায় না? কিংবা তাড়ান? তোমরা তো হাঙরের সঙ্গে লড়াই কর।
সেটা খোলা জায়গায় হলে। এখানে গুহার ভেতরে পারব না। আটকে ফেলবে সহজেই। ওদের ক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। বুদ্ধির জোরেই কেবল কাবু করা যায়।
বিশাল পাখনাটার দিকে তাকালো আবার কিশোর। নৌকার পালের মত খাড়া হয়ে আছে। ওরা খুব চিন্তা করবে। আমাদেরকে না পেয়ে।
বসলো সাগরের হাসি। তাকের কিনারের দেয়াল থেকে আলগা একটুকরো প্রবাল খুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো হাঙরটাকে সই করে। গাল দিলো আঞ্চলিক ভাষায়।
ধীরে সুস্থে শরীর নাড়লো হাঙরটা। দেখিয়ে দিলো ধূসর-শাদা পেট।
তোমাদের দেবতাকে ডাক, কিশোরকে পরামর্শ দিলো ঝিনুক। চিন্তিত লাগছে তাকে।
কিছু বললো না কিশোর। সে-ও ভাবছে। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। কালো হয়ে গেছে নীল পানি। তার মানে সূর্য ডুবে গেছে। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে। ওদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্যেরা। পাবে না ওপরে। তখন মূসার হয়ত, মনে পড়বে গুহাঁটার কথা। মাছ আর জুতো ফেলে এসেছে ওপরে। ওগুলো দেখে সে আন্দাজ করে ফেলবে, ওরা কোথায় রয়েছে। তখন দেখতে আসতে পারে। ওকে হুঁশিয়ার করার কোন উপায়ই নেই। সোজা এসে পড়বে হাঙরের মুখে। নিজেদের চেয়ে মুসার জন্যে এখন বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লো সে।
জীবনে অনেক বিপদে পড়েছে কিশোর। সেগুলো থেকে উদ্ধারও পেয়েছে কোন না কোন ভাবে। কখনও নিজের বুদ্ধির জোরে, কখনও অন্যের সাহায্যে। কিন্তু এই বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথই খুঁজে পাচ্ছে না সে। কোন বুদ্ধি বের করতে পারছে না। কতদিন থাকবে এখানে হাঙরটা, সেটা এখন আর বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, মুসা খুঁজতে আসবে।