চাবুকের মত লাফিয়ে উঠলো কাটা দড়ির মাথা। গায়ে বাড়ি লাগলে চামড়া উঠে যেত। সরে এল সে। সাংঘাতিক দুলে উঠল বিমান। মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মুসা। পড়েই থাকলো। দাঁড়ানোর চেয়ে এটা সহজ।
ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে বিমান। সামনে পানির ছিটে ফোয়ারার মত হয়ে এসে ককপিটের জানালায় লাগছে। এর ভেতর দিয়ে কিছু দেখাই মুশকিল। অনুমানের ওপরই সামনে ছোটালো ওমর। কোন ভাবে এখন দেয়ালে বাড়ি লেগে গেলে সব শেষ। পর পর দুই বার ঢেউয়ের খাঁজে পড়ল বিমান, যেন হঠাৎ করে শূন্য থেকে নিচে এসে পড়লো। ধক করে উঠলো ওমরের বুক। মনে হলো, এই বুঝি বাড়ি লাগল দেয়ালে। তবে নিতান্ত অলৌকিক ভাবেই যেন বেঁচে গেল দুবারই।
ঢেউয়ের মাথায় উঠে সারতেও পারলো না বিমানটা, নাকের ওপর এসে ভেঙে পড়লো আরেকটা ঢেউ। চুবিয়ে মারতে চাইছে। ঘোরানোর চেষ্টা করলো ওমর। কিছু করতে পারলো না। নিয়ন্ত্রণ নাগালের বাইরে চলে গেছে। তবে কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে। আবার সাড়া দিলো বিমানের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। ততক্ষণে আরেকটা ঢেউয়ের খাজে নেমে পড়েছে বিমান। ঢেউয়ের দিকে আর নাক না ঘুরিয়ে দুটো ঢেউয়ের মাঝের খাঁজ দিয়ে তীব্র গতিতে ট্যাক্সিইং করে ছুটলো ওটা। দ্রুত কমে যাচ্ছে মাঝের ফাঁক। বুঝতে অসুবিধে হলো না সাগরের দিক থেকে গড়িয়ে আসছে আরেকটা ঢেউ। যদি বিমানের পিঠে ভেঙে পড়ে, তাহলে আর বাঁচতে হবে না। মরিয়া হয়ে জয়স্টিক ধরে টান দিলো ওমর। ওড়ার এটাই শেষ সুযোগ।
মাতাল হয়ে গেছে যেন বিমানটা। ঢেউয়ের কথা শুনবে, না ইঞ্জিনের বুঝতে পারছে না। অবশেষে টলমল করে যেন ওড়ারই চেষ্টা করলো। মায়া কাটালো পানির। ফ্লোটের গায়ে এসে বাড়ি মারলো ঢেউ। কাঁপিয়ে দিলো বটে, তবে রুখতে পারলো না বিমানটাকে। জোর করতে পারলো না। মস্ত একটা উড়ুক্কু মাছের মত যেন ঢেউয়ের নিচ থেকে লাফ দিয়ে বেরোল ফ্লাইং বোট। ককপিটের জানালায় এসে পড়লো পানির ফোয়ারা। সামনের সব কিছু চোখের আড়াল করে দিল ক্ষণিকের জন্যে।
চেপে রাখা দমটা ফোঁস করে ছেড়ে সীটে হেলান দিলো ওমর। সীট বেল্টের বাঁধন শক্ত করলো। রাটুনার দিকে কোর্স ঠিক করলো বটে, তবে সরাসরি যেতে পারছে একথা বলা যাবে না। কারণ সরাসরি সেদিক থেকেই ধেয়ে আসছে বাতাস। নাকটা কোণাকোণি করতে বাধ্য হলো সে। তারমানে দ্বীপের দিকে না গিয়ে চলে যাবে খোলা সাগরের দিকে, এই পথে চললে। চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ব্যারোমিটারে। সাড়ে আটাশ।
রাটুনা দেখা গেল। শাদা হয়ে গেছে সাগর। তার মাঝে যেন ফ্যাকাসে সবুজ মরুদ্যান। আতঙ্কিত হয়ে ল্যান্ড করার জায়গা খুঁজলো সে। শাদা আর সবুজের মাঝখানে এক জায়গায় সরু এক চিলতে পানি দেখা গেল, সাগরের সঙ্গে যেটার রঙের অমিল রয়েছে। নিশ্চয় ওটাই লেগুন। দেয়াল ডিঙিয়ে এখনও সাগরের ঢেউ ঢুকতে পারেনি ওখানে।
সেদিকেই চললো ওমর। লেগুনের ওপরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বাইরে সাগরের তুলনায় একেবারে শান্ত রয়েছে ওখানকার পানি, বলা চলে। বাতাসে উড়ছে নারকেলের ছেড়া পাতা। অনেক পাতা এসে পড়েছে পানিতে। সরের মত ভাসছে। কতটা পুরু হয়ে, বোঝা কঠিন। বেশি পুরু হলে বাড়ি লেগে ফ্লোটের ক্ষতি হতে পারে। তবে এখন আর বিমান বাঁচানোর কথা ভাবছে না ওমর, নিজেদের বাঁচার কথা ভাবছে। রাটুনায় যখন একবার পৌঁছতে পেরেছে, ঝড় থামলে ডজ আইল্যান্ডে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেই।
কোথায় নামাবে জায়গা বাছাই করে নিলো সে। গতিবেগ একটুও কমলো না, পুরো খুলে রেখেছে থ্রটল। পানিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো যেন বিমান। সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল একপাশে। নারকেল পাতার স্তূপ আঁকড়ে ধরেছে ওদিকের উইং ফ্লোট। কয়েক গজ এগোতে এগোতেই অন্য ফ্লোটটাকেও ধরল। থামাতে পারলো না। টেনেহিচড়ে আরও কয়েকগজ গিয়ে তারপর থামল বিমান।
আরও গজ বিশেক যেতে পারলে নামা যেত। তীরের কাছাকাছি, পানি আছে, তবে মাটি নাগাল পাওয়া যাবে।
ইঞ্জিন বন্ধ করে অন্য দুজনের দিকে ফিরলো ওমর। মনে হচ্ছে কিছু সময় থাকতে হবে এখানে। তা নাহয় থাকলাম, আসল বিপদ কাটিয়ে এসেছি। কিশোরদের জন্যে ভয় লাগছে এখন।
ঝড় থামলে না হয় গিয়ে দেখা যেত, ভীষণ মুষড়ে পড়েছে মুসা। তার কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে। কিশোর মারা গেছে, এটা বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক থাকতে, এটাও বিশ্বাস করে না। তাহলে হলোটা কি?
এখানে থাকার চেয়ে চল গাঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, ডজ বললো। ঝড় থামলে লোক নিয়ে এসে পাতা কেটে প্লেনটা বের করে দ্বীপে যাব আবার। মুসা, ভয় পেয়ো না। সাগরের হাসি আর ঝিনুক থাকতে কিশোর মরতে পারে না। নিশ্চয় কোথাও নিরাপদেই আছে ওরা। আমাদের অজানা কোনখানে।
এই ঝড়ের মধ্যে নামবে? ওমরের প্রশ্ন। শুনেছি, ঝড়ের সময় কামানের গোলার মতো নারকেল ওড়ে এসব অঞ্চলে। মাথায় লাগলে ছাতু বানিয়ে দেবে।
তাই তো! ভুলে গিয়েছিলাম। বাতাস না কমলে বেরোনো যাবে না।
ঠিক আছে, বসেই থাকি। সীটে হেলান দিলো ওমর। পাতায় ঢেকে যাবে আরকি আমাদের ওপরটা। তা যাক। ভাল কথা, মুক্তোগুলো কোথায় রেখেছ?
মুক্তো! চোখ মিটমিট করলো ডজ। তুমি আননি? আমার কি আনার কথা নাকি?