সত্যি সত্যি যদি ঝড় আসে, এক ডজন নোঙর বাঁধলেও লাভ হবে না, ডজ বললো। ছিড়ে নিয়ে চলে যাবে। চোখের পলকে।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো ওমর। সেজন্যে তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। কিছু একটা করতেই হবে। বড় বড় প্রবালের চাঙড় এনে নাক আর লেজের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখব। নোঙরের কাজ করবে।
এটা অবশ্য করা যায়, ডজ বললো। টিকবে বলে মনে হয় না। তবু, চেষ্টা করি।
মুসা, আরেকবার গিয়ে দেখ কিশোরদেরকে পাও কিনা। আমি আর ডজ কাজটা সেরে ফেলি।
মাথা ঝাঁকিয়ে তাড়াহুড়া করে রওনা হয়ে গেল মুসা।
আধ ঘণ্টা পরেই ফিরে এল। ততক্ষণে ছয়টা নোঙর বেঁধে ফেলা হয়েছে বিমানের, ভাল সময়ে এর যে কোন একটাই বিমানকে আটকে রাখতে যথেষ্ট। পেলাম না, মুসা জানালো। কিশোরের জুতো আগের জায়গাতেই পড়ে রয়েছে। সাঁতার কাটতে নেমেছিলো মনে হয়। ওমর ভাই, ভয় লাগছে আমার। কিছু হলো তো?
একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইলো ওমর। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে বললো সে। কিছু একটা হয়েছে। নইলে ফিরে আসতো। পানিতেই কোন একটা ব্যাপার ঘটেছে। ডুবে মরেছে, এটা ভাবতে পারছি না। তবে কোন ভাবে বাইরের সাগরে গিয়ে পড়লে কি হবে বলা যায় না। ঢেউয়ের টানে ভেসে চলে যেতেই পারে।
তাহলে তো আরও অনেক কিছুই ঘটতে পারে, বললো ডজ। হাঙরে ধরে খেয়ে ফেলতে পারে…
তা পারবে না, বাধা দিয়ে বললো ওমর। একজনকে হয়ত খেতে পারে, একসঙ্গে তিনজনকে সম্ভব না। বিশেষ করে ঝিনুক আর সাগরের হাসিকে। ওই একটা ঘটনাই ঘটে থাকতে পারে। দেয়ালে চড়েছিল হয়ত কিশোর। ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়েছে তাকে। বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে পড়েছে তখন সাগরের হাসি আর ঝিনুক। ওরাও ভেসে গেছে। ঢেউয়ের জন্যে এখন আর ফিরতে পারছে না। এক মুহূর্ত ভাবল সে। অন্ধকার না হলে উড়ে গিয়ে দেখতে পারতাম। কিন্তু এখন প্লেন নিয়ে ওঠাই যাবে না। উঠলে আর নামতে পারবো না। যা ঢেউ, নামতে গেলেই বাড়ি মেরে উল্টে ফেলবে। এক মিনিট লাগবে ডোবাতে।
বিশাল ঢেউয়ের ভারি গর্জন যেন সমর্থন করল ওমরের কথা। ভয়ংকর গতিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দেয়ালের গায়ে, তার আঘাতে কাঁপছে এখন দ্বীপটা। বাতাসের বেগ বাড়ছে। নারকেলের পাতা ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, ওমর বললো।
করবটা কি তাহলে? বিড়বিড় করলো ডজ। কিছু তো করা দরকার। চুপ থাকতে পারি না।
চল, সবাই মিলে আরেকবার খুঁজি, গম্ভীর হয়ে বললো ওমর। ফল হবে বলে মনে হয় না। মুসা, তুমি পুবে যাও। ডজ মাঝখানটায় গিয়ে খোঁজ। আমি যাচ্ছি পশ্চিম দিকে।
আলাদা হয়ে খুঁজতে বেরোল তিনজনে। কিশোর আর দুই পলিনেশিয়ানের নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে।
ঘণ্টাখানেক পরে আগের জায়গায় ফিরে এসে ওমর দেখলো, মুসা আর ডজ দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতে হলো না, ওদের মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলো। আর কিছু করার নেই আমাদের, তিক্ত কণ্ঠে বললো সে। সকালের জন্যে বসে থাকতে হবে। ঝড় যদি থামে, আর প্লেনটা আস্ত থাকে তাহলে আরেকবার খুঁজতে বেরোব আরকি। থমথম করছে তার মুখ। আল্লাই জানে ওদের কি হলো!
ধীরে ধীরে কাটছে সময়।
মুসার মনে হলো কয়েক শো বছর পরে অবশেষে হালকা হয়ে এলো পুব আকাশের অন্ধকার। ভোর যতই এগিয়ে এলো, বাড়তে থাকলো-ঝড়ের বেগ। দেয়ালের ওপর দিয়ে পানি পাঠাতে আর চেষ্টা করতে হচ্ছে না এখন ঢেউকে, আপনাআপনিই ঢুকে পড়ছে। সাগর আর লেগুন এখন প্রায় এক হয়ে গেছে। কয়েক ঘণ্টা আগেও নীরব আর শান্ত ছিলো যে সৈকত সেখানে এখন ঢেউ আছড়ে ভাঙছে। বাঁধা গরুর মতো দড়ি টানাটানি করছে বিমানটা, যেন দড়ি ছিড়ে পালাতে চাইছে।
আরেকটু জোর বাড়লে টিকবে না, ওমর বললো। ব্যারোমিটারটা দেখে আসিগে। কোমর পানিতে ভিজে এসে অনেক কায়দা কসরৎ করে বিমানে উঠলো সে। ককপিটে ঢুকলো। ইনট্রুমেনটস বোর্ড দেখে ফিরে এসে নামলো আবার পানিতে। কিংবা বলা যায় পানিতে ছুঁড়ে ফেলা হলো তাকে।
কি দেখলে? জিজ্ঞেস করলো ডজ।
উনত্রিশ।
ভাল। এসেই গেল তাহলে।
এখন উড়তে না পারলে আর কোনদিনই পারব না। লেগুনের দিকে হাত তুললো ওমর। অবস্থা দেখেছ। আরেকটু পরেই বাইরের সঙ্গে এর কোন তফাৎ থাকবে না। মহাবিপদে পড়ে গেলাম। কিশোররাও ফিরল না। এই ডজ, কি করি?
যাওয়াই উচিত, গলায় জোর নেই ডজের। ঝড় থামলে আবার ফিরে আসা যাবে। খুঁজতে হবে ওদের। আর বসে থেকে এখন প্লেনটাই যদি ভেঙে যায়, আমরাও ফিরতে পারবো না। ওরা এলে ওরাও পারবে না। মোটকথা সবাই আটকা পড়বো তখন।
বেশ, ওঠ গিয়ে, ওমর বললো। খুব সাবধান। যে হারে টানে পানি, পা ফসকে ভেসে গেলে আর আসতে পারবে না।
একজন আরেকজনের হাত ধরে একটা শেকল তৈরি করলো ওরা। পানির টানের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কোনমতে যেন নিজেদেরকে টেনে তুললো বিমানে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ওমর। ইঞ্জিন, ঢেউ, বাতাস আর নারকেল পাতার মিলিত শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বললো, দড়ি কেটে দাও! কণ্ঠস্বরটা নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনালো। ডজ, আগে সামনেরগুলো কাট। মুসা, তুমি পেছনে যাও। আমি না বললে কাটবে না। সাবধান।
এমনিতেই টান টান হয়ে আছে দড়ি। ডজ ছুরি ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই আলাদা হয়ে গেল। এক হ্যাচকা টানে বিমানটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল ঢেউ। এমন টানতে শুরু করলো, যেন লেজ ছিড়েই নিয়ে চলে যাবে। থ্রটল দিলো ওমর। চেঁচিয়ে বললো, মুসা, কাট।