সব মিলিয়ে ঝুড়ি না ভরলেও ডজের হ্যাটের অর্ধেকটা যে ভরা যাবে মুক্তো দিয়ে তাতে সন্দেহ নেই। নতুন সরঞ্জাম কিনে নিয়ে এসে খেতের বাকি ঝিনুকগুলোও সাবাড় করে দিয়ে যাবার ইচ্ছেটা তার একটুও কমলো না, বরং বাড়লো।
মুক্তোগুলো সব একসাথে রাখতে রাখতে ডজ বললো, তোমরা গিয়ে কিছু মাছ ধরে আনলে পার। খাওয়া যেত।
কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। হেসে বললো, প্রতি বেলাতেই যে হারে মাছ খাচ্ছি, শেষে না মাছের গন্ধই বেরোতে শুরু করে গা দিয়ে।
বড়শি নিয়ে রওনা হলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। কিশোরও তাদের সঙ্গে চললো।
পশ্চিমের আকাশে বিচিত্র রঙ। প্রশান্ত মহাসাগরের অপরূপ সূর্যাস্তের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ওমর। তারপর চোখ ফেরালো আবার জায়গাটার দিকে, যেখানটা মেরামত করেছে। শেষবারের মত পরীক্ষা করে দেখলো সব ঠিক আছে কিনা। ককপিটে এসে ইনস্ট্রমেন্ট বোর্ডের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। বেরিয়ে দ্রুত চলে এলো ডজের কাছে। মুসাও তখন ওখানে।
কি ব্যাপার? ওমরের মুখ দেখেই আন্দাজ করে ফেলেছে ডজ, খারাপ খবর আছে।
ব্যারোমিটারের রিডিং ভাল না, জানালো ওমর।
আকাশের দিকে তাকালো ডজ। কই, ভালই তো আবহাওয়া। খারাপ লাগছে না।
আকাশ-ফাঁকাশ দেখে বোঝা মুশকিল। রিডিং তিরিশের নিচে নেমে গেছে। পড়ছেই।
চমকে গেল ডজ। কী!
মাথা ঝাঁকাল ওমর। গিয়ে দেখ বিশ্বাস না হলে।
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো ডজ। ব্যারোমিটার দেখতে গেল না। বললো, জলদি গোছগাছ করে নিতে হবে। যেরকম নামছে বলছো, বড় রকমের ঝড় আসবে। এখনি উড়তে হবে।
পারা যাবে না।
কেন?
জোয়ার না এলে পানিতে নামানো যাবে না প্লেনটাকে।
এতক্ষণ থাকা যাবে না। ঠেলেঠুলে নামাতে হবে। রাটুনায় গিয়ে পৌঁছতে পারলে যত বড় ঝড়ই আসুক, কিছু করতে পারবে না আমাদের। কিন্তু এখানে থাকলে পাঁচ মিনিটে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে প্লেনটাকে চল।
ফুরফুর করে বাতাস বইছে। মনে হয় খুব ভাল, আসলে তা নয়। ইতিমধ্যেই লেগুনের বাইরে দেয়ালের গায়ে বড় হয়ে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে ঢেউ। বজ্রের মত গর্জন করছে, আর সেই সাথে অনেক ওপরে ছিটিয়ে দিচ্ছে পানির কণা।
আরও আগেই বোঝা উচিত ছিলো আমার, বিড়বিড় করলো ডজ।
এখন আর ভেবে লাভ নেই। চল দেখি নড়ানো যায় নাকি। মুসার দিকে ফিরে ওমর বললো, জলদি ওদের ডেকে নিয়ে এস। মাছ আর লাগবে না।
দৌড় দিলো মুসা। জরুরী অবস্থা এখন।
বিমানের নাকের কাছটায় রইলো ওমর। ঠেলতে লাগলো। নড়লও না বিমান। যেন বালিতে শেকড় গজিয়ে গেছে ওটার। পানির দিকে তাকিয়ে বললো, জোয়ার অবশ্য এসে গেছে। আর দশ মিনিট পরেই ভাসিয়ে ফেলবে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো, আল্লাহ! দেখতে দেখতে কি কান্ড হয়ে গেল!
ঢোকার মুখটা দেখুন না! মুসা বললো।
লেগুনে ঢোকার প্রণালীটাতে এখন আর পানি আছে বলে মনে হয় না। শুধু ফেনা। পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে। হ্যাঁ, হয়ে গেছে কাজ! ডজ বললো। আসছে। আর কোনই সন্দেহ নেই।
দশ মিনিটের মধ্যেই রওনা হতে না পারলে, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ওমর বললো। রাটুনায় পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। ঝড়ের মধ্যে অন্ধকার সাগরের ওপর দিয়ে ওড়ার সাহস নেই আমার। রাটুনায় ল্যান্ডিং লাইটও নেই যে আলো দেখে নামতে পারব। সময় থাকতে এখানে একটা জায়গা খুঁজে বের করা দরকার, যেখানে একটু আশ্রয় মিলবে।
কিছু বলছে না ডজ। তাকিয়ে রয়েছে সাগরের দিকে।
পায়ের শব্দে ফিরে তাকাল ওমর। মুসা ফিরে এসেছে, একা।
ওরা কোথায়? জানতে চাইলো ডজ। আমরা এখুনি রওনা হব।
পেলাম না, জবাব দিলো মুসা।
পেলে না মানে? যাবে কোথায়? দ্বীপেই আছে।
সারাটা দ্বীপ খুঁজে এসেছি। ওরা নেই। কিশোরের জুতো পেয়েছি, আর বড়শি দিয়ে ধরা কিছু মাছ। ওদের চিহ্নও নেই।
জুতো কোথায় পেলে?
এই তো, কাছেই। প্রবালের ওপর পড়ে ছিলো। একটা খাড়ির ধারে।
ডজের দিকে তাকালো ওমর। ব্যাপারটা কি? গেল কোথায়?
মাথা নাড়লো ডজ। বুঝতে পারছি না। ক্ষতি হবে না কিশোরের। সাগরের হাসি আর ঝিনুক রয়েছে তার সঙ্গে। এসময় কি করতে হবে ভাল করেই জানে ওরা।
জানলেই ভাল। কিন্তু কথা হল, ওদেরকে না নিয়ে তো যেতে পারছি না আমরা। প্লেনটা ভাসিয়ে রাখি। তৈরি হয়ে থাকি। ওরা এলেই রওনা দেব।
পনের মিনিট পেরিয়ে গেল। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে পশ্চিমের আকাশ। তার ভেতরে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে দৃশ্যটা। ভয় ভয় করে। ইতিমধ্যেই দিগন্ত রেখার নিচে অনেকখানি নেমে গেছে সূর্য, যেন পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে যেন টুপ করে ডুবে গেল। অন্ধকার নামতে শুরু করলো।
গেল! হাত নেড়ে বলল ওমর। আজকে ফেরার আশা শেষ। রাতে আর পারব না। কিন্তু ওরা গেল কোথায়? আর তো চুপ করে থাকতে পারছি না।
প্লেনটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। রীফের দিকে হাত তুলে দেখালো মুসা। এখুনি কিছু করতে না পারলে সর্বনাশ করে দেবে।
এই প্রথমবার দেখলো, প্রবালের দেয়াল ছাপিয়ে লেগুনে ঢুকতে আরম্ভ করেছে সাগরের পানি। ঢেউ এসে ঝাপিয়ে পড়ছে ওপাশে, ঠেলে পানি ঢুকিয়ে দিচ্ছে লেগুনের ভেতর, ফলে ভেতরেও ঢেউ উঠছে এখন। পানি ফুলে ওঠায় বিমানটাও ভেসে উঠেছে। ভীষণ দুলছে।
নোঙরে ভার বেঁধে দেয়া দরকার, ওমর বললো। তাহলে দুলুনি কিছুটা কমতে পারে।