কয়েক সেকেন্ড কেবিনের মেঝেতে চিত হয়ে রইলো মুসা। জোরে জোরে দম নিচ্ছে। অবশেষে কোনমতে জিজ্ঞেস করলো, ওরা উঠেছে?
না, জবাব দিলো ডজ।
কিন্তু…নিচে…একটা হাঙর…
জানি। দেখেছি। ওটাকে মারতেই গেছে দুজনে।
ওদেরকেই মেরে ফেলবে তো!
তা পারবে না। এরকম লড়াই অনেক করেছে ওরা। মারকুইজানদের সঙ্গে পারে না হাঙর। পেছন থেকে না জানিয়ে হঠাৎ এসে যদি ধরে ফেলতে পারে, তো পারে, নইলে সম্ভব না। হাঙর শিকার করতে ওস্তাদ মারকুইজানরা। ওদের কাছে খেলা।
আমার কাছে মোটেও খেলা মনে হয়নি, বিড়বিড় করলো মুসা। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো নিচে কি ঘটছে দেখার জন্যে।
পানিতে ভাসলো সাগরের হাসির মাথা। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে এলো ওপরে। ফুচচ করে মুখ থেকে পানি ফেলে বললো, আউফ! ম্যাকো!
তার পর পরই উঠে এলো ঝিনুক। কাঁধের একটা কাটা থেকে রক্ত পড়ছে। সেটা দেখে চিৎকার করে উঠলো মুসা, খাইছে! কামড়ে দিয়েছে!
নাআহ, তেমন কিছু না, ডজ বললো। সামান্য আঁচড়। সিরিশ কাগজের মত ধারালো হাঙরের চামড়া, ঘষা লাগলে ছড়ে যায়।
মেঝেতে বসে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগলো দুই পলিনেশিয়ান। নিজেরা নিজেরা কথা বলছে।
কি বলে? জানতে চাইলো ওমর।
বলছে, মারতে পারেনি। তার আগেই এসে হাজির হয়েছে একটা সোর্ডফিশ। ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে। রক্তের গন্ধে হাজির হয়েছে। ওরা বলছে, হাঙরের চেয়ে বড় ওটা।
নিশ্চয় ততটা ডেনজারাস নয়, তাই না?
তা বলা যায় না। হাঙরের মত যখন তখন মানুষকে আক্রমণ করে না বটে, তবে যদি করে, তো বাঁচার আশাও শেষ। হাঙরের কবল থেকে ফেরা যায়; ওদের কবল থেকে না। সাংঘাতিক শক্ত তলোয়ার দিয়ে জাহাজের তলা ফুটো করে দেয়, মানুষ তো কিছু না।
বিশ্বাস করেন, একথা? মুসার প্রশ্ন।
করব না কেন? অ্যাডমিরালটি রেকর্ড দেখলেই বুঝবে। প্রাইমাউথের জাহাজ দা ফরচুনকে একবার আক্রমণ করেছিলো সোর্ডফিশ। তামার পাত লাগানো ছিল জাহাজটার তলায়। পাতের ওপরে ছিলো তিন ইঞ্চি পুরু লোহাকাঠ, তার ওপরে বার ইঞ্চি পুরু ওককাঠের তক্তা। সেসব তো ফুড়েছেই, ওপরে রাখা একটা তেলের ড্রামও ফুটো করে দিয়েছিলো। আরেকবার একটা ব্রিটিশ জাহাজ-নামটা ভুলে গেছি, ওটারও তলা ফুটো করেছিলো সোর্ডফিশ। সমস্ত পাম্প চালিয়ে দিয়ে পানি সেচতে সেচতে বন্দরে ফিরেছিলো জাহাজটা। সোর্ডফিশকে ছোট করে দেখো না।
তাহলে কেটে পড়া দরকার, শঙ্কিত হয়ে উঠলো ওমর। জাহাজেরই যদি এই গতি করে, ফ্লাইং বোটের ওপর খেপে গেলে সর্বনাশ করে দেবে। এক ইঞ্চি ধাতব পাত ওটার জন্যে কিছুই না, বুঝতে পারছি। তার কথা শেষ হতে না হতেই পানিতে জোর আলোড়ন উঠলো। এই, কি হল?
সবাই তাকালো সেদিকে। পানিতে প্রচন্ড আলোড়ন, সেই সাথে ফেনা। দেখ দেখ! চিৎকার করে উঠলো কিশোর।
সবার চোখ পড়েছে সেদিকে। পানিতে লাফিয়ে উঠলো বিশাল এক হাঙর। মুসাকে আক্রমণ করেছিলো যেটা সেটাও হতে পারে কিংবা অন্যটা। একটা মুহূর্ত যেন ঝুলে থাকলো শূন্যে, তারপর ঝপাস করে পড়লো। মস্ত ঢেউ উঠলো পানিতে। পরক্ষণেই একটু দূর ভেসে উঠলো সোর্ডফিশটা। নিশ্চয় ওটাই হাঙরটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল।
আপু! আপু! চেঁচিয়ে উঠলো ঝিনুক। জলদি পালান!
ওমর, জলদি! তাগাদা দিলো ডজ। ঝিনুক যখন ভয় পেয়েছে, তার মানে..
আর শোনার জন্যে দাঁড়ালো না ওমর। ককপিটের দিকে দৌড় দিলো। শখানেক গজ দূরে রয়েছে সোর্ডফিশ। বিমানটাকে বোধহয় কোন শয়তান জানোয়ার ভেবে ছুটে আসতে শুরু করলো আক্রমণ করার জন্যে।
চালু হয়ে গেল একটা ইঞ্জিন। তার পর পরই দ্বিতীয়টা। সবে চলতে শুরু করেছে বিমান, এই সময় প্রচন্ড এক আঘাতে কেঁপে উঠলো থরথর করে। ঝাঁকি দিয়ে পানির ওপরে উঠে গেল কয়েক ইঞ্চি। সীট থেকে প্রায় উড়ে চলে গেল ওমর। যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণের কেউ রইলো না। কোনমতে উঠে গিয়ে সীটে বসে আবার জয়স্টিক চেপে ধরলো সে।
মুহূর্ত পরেই তিরিশ ফুট দূরে ভেসে উঠলো সোর্ডফিশ। দ্রুত বিমানটাকে ওটার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো ওমর। কিন্তু ওড়ার আগেই আবার এক ভয়াবহ ঝাঁকুনি। ভোজবাজির মত যেন কেবিনের মেঝে ফুড়ে উদয় হলো একটা বিশাল তলোয়ারের মাথা। পলকের জন্যে। তারপরই এক হ্যাচকা টানে সরে গেল ওটা। গলগল করে পানি ঢুকতে শুরু করলো ফুটো দিয়ে। একটা তোয়ালে দিয়ে পানি বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো কিশোর। চেঁচাতে লাগলো, ওমরভাই, জলদি! জলদি করুন! দুই মিনিটও লাগবে না ডুবতে!
ককপিটের দিকে ছুটে গেল মুসা। তাড়াতাড়ি ওড়ান! ফুটো করে দিয়েছে!
চেষ্টা তো করছি!
পঞ্চাশ ফুট গিয়ে ঘুরতে শুরু করলো সোর্ডফিশ। আবার এসে খোঁচা মারার ইচ্ছে বোধহয়। আবার আসছে! বলেই পিস্তল বের করে গুলি করতে লাগলো ডজ। ওটার গায়ে লাগলো কিনা বোঝা গেল না, তবে ততক্ষণে মাছটার চেয়ে গতি বেড়ে গেছে বিমানের। কেবিনে ফিরে এসে মুসা দেখলো তুলকালাম কান্ড শুরু হয়েছে সেখানে। পানি বন্ধ করার চেষ্টা করছে সবাই প্রাণপণে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই ভেসে গেছে মেঝে। কিশোর বললো মুসাকে, ওমর ভাইকে চালিয়ে যেতে বল। থামলে আরও বেশি ঢুকবে।
ছুটে এসে ওমরকে খবরটা জানালো মুসা।
তুলতেই পারছি না! ফাসফেঁসে কণ্ঠে বললো ওমর। একেতো ঝিনুকের ভার, তার ওপর পানি…উঠতেই চাইছে না!