লম্বা শ্বাস টেনে ডুব দিলো মুসা। নামতে লাগলো নিচের দিকে। তার দুপাশে রয়েছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক। কিছুদূর নেমে, গুহাঁটার দিকে ইঙ্গিত করলো মেয়েটা। তিনজনেই সাঁতরাতে শুরু করলো ওটার দিকে। পানির বিশ ফুট নিচে রয়েছে এখন। আরও কাছে আসার পর মুসা বুঝলো, পানির ওপর থেকে প্রথমে যে গুহা দেখেছিলো, এটা সেটা নয়। আরেকটা।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের সঙ্গে ঢুকে পড়লো ভেতরে। ভয় ভয় লাগছে। অকটোপাস নেই তো? না বোধহয়। তাহলে ওদের দুজনকে আগে ধরতো। ওরা যে হারিয়ে গিয়েছিলো তখন, নিশ্চয় এই গুহাতেই ঢুকেছিলো। বাতাসও আছে। নইলে কিছুতেই পাঁচ মিনিটের বেশি সময় এখানে শ্বাস নিতে পারতো না সাগরের হাসি।
ঠিকই আন্দাজ করেছে মুসা। ওপরে ভেসে উঠলো সে, ওদের দেখাদেখি। পানির নিচের বেশ বড় একটা গুহায় ঢুকেছে ওরা। একধারে তাকের মতো দেখা গেল। তার ওপর উঠে পা দুলিয়ে বসলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। সাঁতরে এসে মুসাও উঠে বসলো।
গুহার সৌন্দর্য দেখে থ হয়ে গেল সে। পানির বেশি ওপরে নয় ছাতটা। জোয়ারের সময় ভরে যায় কিনা কে জানে। তবে সেটা নিয়ে আপাতত ভাবছে না মুসা। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে এক অপরূপ পরীর রাজ্য! ঘন নীল পানি। আলো আসছে কোথা থেকে বুঝতে পারছে না। নানা রঙের প্রবালের ছড়াছড়ি চারপাশে। রঙিন মাছের ঝাঁক।
অনেকক্ষণ দেখার পর জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললা মুসা। বললো, চলো, যাই। বেশি দেরি করলে ওরা আবার ভাববে।
বাইরে বেরিয়ে পানিতে মাথা তুলে দেখলো; নিচের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। উদ্বিগ্ন। মুসাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো, কোথায় গিয়েছিলে?
গুহার ভেতরে। দারুণ জায়গা। যাবে নাকি?
মাথা নাড়লো কিশোর। নাহ, আরেক দিন।
মাছ নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলো ওরা।
ঝিনুক মরে পচন শুরু হতে অন্তত দুটো দিন সময় লাগবে। অযথা বসে না থেকে এই দুদিন মুক্তোর খেত থেকে ঝিনুক তুলে আনতে পারলেই লাভ, যা পাওয়া যায়। সেই আশাতেই যেতে লাগলো অভিযাত্রীরা। আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়িই, সতর্ক সংকেত জানালো ঝিনুক। এগিয়ে আসছে ঝড়।
জায়গাটাতে অকটোপাসের ভয় আপাতত নেই, ডজের সঙ্গে এব্যাপারে একমত হলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক দুজনেই। ডজের সঙ্গে সঙ্গে ওই দুজনও নামতে লাগলো। ডুবুরির গোশাকের দরকার হয় না ওদের। বড় করে দম নিয়ে ডুব দেয়, খানিক পরে ভেসে ওঠে দুই হাতে করে ঝিনুক নিয়ে। দেখে মুসারও নামার লোভ হলো। গভীর পানিতে কি করে ডুব দিতে হয়, জানা আছে তার, অভিজ্ঞতাও আছে। তবু বার বার করে তাকে শিখিয়ে দিলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। ওদের পদ্ধতি কিছুটা আলাদা। এতে সুবিধেই হলো মূসার।
ঝিনুক তোলার চেয়ে পানিতে নেমে খেলা করার দিকেই আগ্রহ বেশি সাগরের হাসি আর ঝিনুকের। মুসাও ওদের সঙ্গে যোগ দিলো।
দ্বিতীয় দিনের কথা। পানিতে নেমে ওরকম খেলা করছে তিনজনে। সাঁতরে দুজনের কাছ থেকে কিছুটা দূরে এসেছে মুসা। হঠাৎই দেখতে পেলো ওটাকে। শরীর বাকিয়ে ঘুরছে বিশাল এক হাঙর।
নাক নিচু করে এগিয়ে আসতে শুরু করলো ওটা। লম্বায় বিশ ফুটের কম হবে না। পেটটা শাদা, বাকি শরীরও শাদাই, তবে কিছুটা ময়লা। ধড়াস করে এক লাফ মারলো মুসার হৃৎপিন্ড। সঙ্গে ছুরিও নেই, যে বাধা দেবে। জানে যদিও, এতো বড় দানবের বিরুদ্ধে সামান্য ছুরি দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। ওপরে উঠে যে, পার পাবে তারও উপায় নেই। হাঙরটা নেমে আসছে ওপর দিক থেকেই। ফুসফুসের বাতাসও ফুরিয়ে এসেছে। এখন রওনা হলেও ওপরে উঠতে উঠতে শেষ হয়ে যাবে বাতাস। কি করবে?
দানবটা যদি তাকে আক্রমণের পরিকল্পনা করে থাকে; তাহলে কোনোমতেই রক্ষা নেই। ফুসফুসে বাতাস থাকলেও না, না থাকলেও না। তবু হাত-পা গুটিয়ে রেখে বাঁচার চেষ্টা তো অন্তত করে দেখতে হবে।
ওপরে উঠতে শুরু করলো মুসা। বোধহয় এতোক্ষণ তাকে নজরে পড়েনি হাঙরটার, কিংবা দ্বিধায় ছিলো, কোন ধরনের জীব, আক্রমণ করবে কিনা, এসব। এখন মনে হলো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কারণ, আবার মুসার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে ওটা। দ্রুত এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
৮
এই সময় মুসা দেখলো ঝিনুক আর সাগরের হাসি নেমে আসছে। পানি এতই পরিষ্কার, মনে হচ্ছে পানিতে নয় ডাঙাতে রয়েছে ওরা। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে হাঙরটার দিকে সাঁতরে যাচ্ছে ঝিনুক। এখনও উঠছে মুসা, শেষ হয়ে আসছে শক্তি। যেন দুঃস্বপ্নের মাঝে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখছে দৃশ্যটা। ধীরে ধীরে ঘুরছে বিশাল দানবটা, তাকে ধরার জন্যে আসছে। ওটার মাথার কাছ দিয়ে চলে গেল ঝিনুক। পলকের জন্যে মুসা দেখলো, তার হাতটা উঠল নামলো একবার দ্রুত, সাপের মত ছোবল মারলো যেন ছুরি। হাঙরের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত, বেরিয়ে এলো। আবার আঘাত হানলো ঝিনুক। পাক খেয়ে ঘুরে গেল হাঙর। হাঁ হয়ে গেছে মুখ। বেরিয়ে পড়েছে মারাত্মক দাঁতের সারি। কাছাকাছি রয়েছে সাগরের হাসি, তাকে কামড়াতে গেল ওটা। ওপর দিকে ছুরি চালিয়ে হাঙরের পেট কেঁড়ে দিলো মেয়েটা।
হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করেছে মুসা। পানিতে লাথি মেরে ভেসে উঠতে চাইছে ওপরে। পানি আর আগের মত পরিষ্কার নয়, রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে হাঙর। ঘোলাটে লাল পানির ভেতরে এখন কি ঘটছে, আর দেখা গেল না। একটাই ভাবনা, যে করেই হোক, ভেসে উঠতে হবে। মনে হচ্ছে এই বুঝি পায়ে কামড় বসালো হাঙরটা। ফুসফুসের বাতাস শেষ। যখন ভাবলো, আর উঠতেই পারবে না, এই সময় পানির ওপরে ভেসে উঠলো মাথা। হাত বাড়িয়েই রেখেছে ডজ আর কিশোর। একটানে তাকে তুলে নিলো ওপরে।