কথাটা মনে ধরলো। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো দুজনে।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে মুসা বললো, চলো, আমরাও যাই।
চলো।
পানির ধার ঘেঁষে শাদা বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চললো চারজনে। মাছ ধরার জন্যে জায়গা বাছাই করতে শুরু করলো সাগরের হাসি। কয়েকটা জায়গায় থেমে দেখলো। শেষে ছোট একটা গুহার সামনে এসে থামলো সে। খাড়া নেমে গেছে প্রবালের দেয়াল। আয়নার মতো শান্ত নিথর হয়ে আছে পানির ওপরটা। স্বচ্ছ। নিচে অলস ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করছে নানারকম মাছ, দেখা যাচ্ছে। ছোট একটা খাড়ি। বিশ ফুট গভীর হবে। দেয়ালের গা থেকে নেমে গেছে সিড়ির মতো ধাপ। একধারে জন্মে রয়েছে কয়েকটা নারকেল গাছ, দেখে মনে হয় একটাই গোড়া, সেটা থেকে বেরিয়েছে কান্ডগুলো, বাঁশের মতো। মাথা নুইয়ে রেখেছে পানির ওপর। পানিতে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব পড়েছে ওগুলোর। মনে হয় যেন পানির নিচে গজিয়েছে মাথা উল্টো করে।
দেয়ালের গা কামড়ে রয়েছে অসংখ্য শামুক। কয়েকটা তুলে আনলো সাগরের হাসি। খোলা ভেঙে ভেতরের মাংস বের করে বড়শিতে গেথে পানিতে ফেললো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে টোপ গিললো মাছ।
একের পর এক মাছ তুলে বালিতে ফেলতে লাগলো সে। এতো দ্রুত, বিশ্বাসই হতে চাইছে না দুই গোয়েন্দার। মেয়েটার হাত থেকে ছিপটা নিলো কিশোর। বড়শিতে টোপ গেঁথে দিলো সাগরের হাসি। সে ছিপ ফেললো। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনটে মাছ ধরে ফেললো।
যেগুলো খেতে ভালো, বেছে বেছে সেগুলোকে আলাদা করলো ঝিনুক। কিশোর বললো, হয়েছে। রাতে হয়ে যাবে। আর দরকার নেই।
এতো তাড়াতাড়ি মাছ ধরা শেষ হয়ে যাওয়ায় নিরাশই হলো মুসা। কাজকর্ম না থাকলে ভালো লাগে না। অহেতুক কতো আর বসে থাকা যায়?
আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি। ছিপ সরিয়ে রেখে ভোঁদড়ের মতো স্বচ্ছন্দে পানিতে নেমে গেল সাগরের হাসি। মিনিটখানেক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুসা। পানির নিচে এমন সহজ ভঙ্গিতে সাঁতার কাটছে মেয়েটা, দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না। ডাঙার মানুষ নয় যেন, জলকুমারী। সাঁতার কাটার ইচ্ছেটা আর দমিয়ে রাখতে পারলো না মুসা। উঠে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলতে শুরু করলো। সেদিকে তাকিয়ে হাসলো কিশোর, আর পারলে না? তোমারও এখানেই জন্মানো উচিত ছিলো। হাহ হাহ।
গাছের নিচে শুকনো নারকেল পড়ে আছে। কুড়াতে কুড়াতে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। মুসার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালো একবার, তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলো।
জুতো খুলে রেখে পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়ালো মুসা। সাগরের হাসিকে দেখার জন্যে নিচে তাকালো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একেবারে তল পর্যন্ত। কিন্তু মেয়েটা নেই। কোথায় গেল? অস্বস্তি বাড়তে লাগলো। হাত নেড়ে ডাকলো ঝিনুককে। এই ঝিনুক, দেখে যাও।
কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি উঠে এসে মুসার পাশে দাঁড়ালো কিশোর।
ঝিনুকও এলো। পানির নিচে চোখ বোলালো একবার। অবাক হয়েছে, চেহারাই বলে দিচ্ছে তার। খোলা লেগুনের দিকে খুঁজলো একবার। নেই দেখে আবার দৃষ্টি ফেরালো গুহাঁটার দিকে। অস্বস্তি ফুটেছে চোখে। সেটা দেখে ভয়ই পেয়ে গেল কিশোর আর মুসা। ওরকম গুহা মানেই এখন ওদের জন্যে আতঙ্কের জায়গা। অকটোপাস কিংবা অন্য কোনো জলদানবের বাড়ি।
পানিতে ঝাপিয়ে পড়লো ঝিনুক, ঢেউ উঠলো। সেটা না কমা পর্যন্ত নিচের দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পারলো না কিশোর আর মুসা।
ঝিনুকও গায়েব। তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না কোথাও। এক মিনিট গেল…দুই মিনিট। পরস্পরের দিকে তাকালো দুই গোয়েন্দা। দুজনে একই কথা ভাবছে। এমনকি পলিনেশিয়ানরাও পানির নিচে এতোক্ষণ দম বন্ধ করে থাকতে পারে না। কেমন অসহায় বোধ করতে লাগলো দুজনেই।
দেয়ালের ধার ধরে কিছুদূর দৌড়ে গেল মুসা। ঝিনুক কিংবা সাগরের হাসি আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলো। কিছুই নেই। সাগরের তলটা এখানে বেশ অন্ধকার, পানি বেশি গভীর হলে যেরকম হয়।
সাগরের হাসি যে গায়েব হয়েছে, পাঁচ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোনো মানুষের সাধ্য নেই, পানির নিচে ডুব দিয়ে এতোক্ষণ দম আটকে রাখে। নিশ্চয় অকটোপাসে ধরেছে! বিড়বিড় করলো মুসা।
ওমর আর ডজকে ডাকার জন্যে বলতে যাবে কিশোরকে, এই সময় যেন জাদুর বলে ভুস করে একটা মাথা ভেসে উঠলো। সাগরের হাসি! ফুচ করে মুখ থেকে পানি বের করে দিয়ে খিলখিল করে হাসলো।
কোথায় গিয়েছিলে? মুসার প্রশ্ন। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।
জবাবে আরেকবার খিলখিল হাসি। আবার বললো, সাঁতার কাটতে। পানিতে মুখ ডুবিয়ে ফু দিয়ে ভুরভুর করে বুদবুদ তুলতে লাগলো।
তুমি মানুষ না! মাছ!
ঝিনুকও ভেসে উঠলো। দুজনে মিলে সাঁতরে চললো লেগুনের মাঝখানে। কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসতে শুরু করলো। মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। নীরবে ওদের সাঁতার কাটা দেখছে।
মুসার দিকে হাত নেড়ে ডাকলো সাগরের হাসি, এসো।
পানিতে নামার কথা ভুলেই গিয়েছিলো মুসা। ঝাঁপ দিয়ে পড়লো। সাঁতরে চলে এলো মেয়েটার কাছে।
এসো আমার সঙ্গে, মেয়েটা বললো। এসো, দেখাচ্ছি। বললো ঝিনুক।
কি দেখাবে?
সাগরের তল। খুব সুন্দর।
দেখতেই তো পাচ্ছি। আর কি দেখবো?
এসোই না।
কাছে এলো ঝিনুক। হ্যাঁ, এসো। জোরে দম নাও। ভয় লাগছে না তো?
না।
এসো তাহলে।