নীরব একটা মুহূর্ত ডজের দিকে তাকিয়ে রইলো ওমর। বেশ, বলো। বিশ্বাস করবো।
হ্যাঁ, শুরু করুন, কৌতূহলী হয়ে উঠেছে কিশোর।
একটা কথাও বাড়িয়ে বলবো না আমি, আবার বললো ডজ। গেলাসে লম্বা একটা চুমুক দিলো। যে লোকের কাছে শুনেছো, আমি দক্ষিণের দ্বীপে আছি, সে ঠিকই বলেছে। তবে আরামে ছিলাম, একথা ঠিক নয়। ওরকম জায়গায় আরামে থাকা যায় না। সভ্যতার ছিটেফোঁটা আছে কিনা ওখানে সন্দেহ। যা-ই হোক, গিয়ে তো উঠলাম। বসে থাকতে ভালো লাগে না। কিছু একটা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মনের মতো কাজ পেলাম না। আমি হলাম গিয়ে বৈমানিক, প্লেন চালানো আর বোমা ফেলা ছাড়া আর কিছু বুঝি না। ওখানে ওরকম লোকের দরকার হয় না কারো। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কি করি, কি করি! পকেটের টাকাও প্রায় শেষ। কোথাও যেতে হলে ভাড়ার টাকা লাগে। শেষে তাহিতির পাপিতি দ্বীপে যাওয়ার জন্যে জাহাজের একটা তৃতীয় শ্রেণীর টিকেট কাটলাম। মোটামুটি বাস করার মতো একটা জায়গা ওটা।
গিয়েছি আমরা, মুসা বললো।
তার দিকে তাকালো ডজ। গিয়েছে, না? তাহলে তো জানোই। সব রকমের লোক আছে ওখানে। সৎ লোক যেমন আছে, তেমনি আছে অসৎ লোক। ভদ্রলোক আছে, আছে অভদ্রলোক। ব্যবসায়ী, চোর-ডাকাত, শাদা, কালো, বাদামী, হলুদ, যতো রকমের মানুষ আছে দুনিয়ায়, সব রকমের পাওয়া যাবে ওখানে। সমস্ত দুনিয়ায় ঘুরেফিরে আর কোথাও ঠাঁই না পেয়ে গিয়ে যেন ওঠে ওই তাহিতির বন্দরে। একটা ব্যাপারে সবার মিল রয়েছে, সকলেই পোড় খাওয়া লোক। সাধারণ কেউ গিয়ে বাঁচতে পারবে না ওখানে। আমার যা মনে হয়েছে, বেশির ভাগই ভালো। তবে যেগুলো শয়তান, মহা শয়তান। একেবারে খাটাশ। থেমে দম নিলো ডজ। বার কয়েক চুমুক দিলো গেলাসে।
আবার বলতে লাগলো, সব কিছু মিলিয়ে, চমৎকার একটা জায়গা তাহিতি, আমার তা-ই মনে হয়েছে।
আমারও, মুসা বললো।
বাহ্, স্বভাব চরিত্রে মিলে যাচ্ছে দেখি! হাত বাড়িয়ে দিলো ডজ। হাত মেলাও। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তোমরা যখন গিয়েছে, নিশ্চয় সব জানো…
আমি যাইনি, ওমর বললো। যা বলার বলো।
এককালে সোসাইটি অ্যাইল্যান্ড বলা হতো দ্বীপটাকে। তখন ফ্রান্সের দখলে ছিলো ওটা। চীনারা থেকেছে বহুদিন। জাপানীরা দ্বীপটা নিয়ে বহু গুতোগুতি করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। চীনারা এখনও আছে। মায়া কাটাতে পারে না। দেখার মতো একটা বন্দর। জাহাজ আসছে যাচ্ছে। পোড় খাওয়া সব মানুষ, দ্বীপের প্রধান রপ্তানী দ্রব্য নারকেলের ছোবড়ার মতো শুকনো, রোদে পোড়া। রপ্তানী দ্য আরও আছে। নানা রকমের ঝিনুক এবং মুক্তো। আশপাশের দ্বীপে যতো মুক্তো তোলা হয়, সব নিয়ে আসা হয় পাপিতিতে, বিক্রির জন্যে। ব্যাপারিরা কিনে চালান করে দেয় প্যারিসে কিংবা অন্য কোনো বড় শহরে। সেখানে মুক্তার চাহিদা রয়েছে। যা-ই হোক, ভূগোলের জ্ঞান অনেকই দিলাম। এবার আসল কথায় আসি।
জাহাজে তো উঠলাম। ভেসে চললাম এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে। একদিন গিয়ে পৌঁছলাম পাপিতিতে। গিয়েই কাজ পেয়ে গেলাম। আমার মনের মতোই বলতে হবে। অবশ্যই জাহাজের চাকরি। দ্বীপ থেকে দ্বীপে যাই। কয়েক দিনের বেশি ভালো লাগলো না এই চাকরি। মালবাহী জাহাজ থেকে নেমে চাকরি নিলাম, এক ব্যবসায়ীর দোকানে। দোকানদারি করলাম কিছুদিন। ভালো লাগলো না। বসে রইলাম কয়েক দিন। আরও খারাপ লাগলো। কথা বলার লোকের অভাব হয় না ওখানে। যদি কেউ মানিয়ে নিতে পারে, আরামেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে ওরকম একটা দ্বীপে। দুই বেলা রুটি জোগাড়ের জন্যে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। দেখার জিনিসের অভাব নেই। তবু মাঝে মাঝে মনে হতো, ওই সবুজ দ্বীপ, রূপালী সৈকত, নীল লেগুন আর ঝলমলে মুক্তার চেয়ে অনেক ভালো আমাদের স্কটল্যান্ডের ধোঁয়াটে কুয়াশা ওঠা মেঘলা দিনগুলোও। পালিয়ে আসতে ইচ্ছে করতো। আসতে পারতাম, কিন্তু আসিনি। চেষ্টা করতে লাগলাম কিছু একটা করার। ওখানে অনেকে বড়লোক হয়েছে, আমি পারবো না কেন? টাকা নিয়ে স্কটল্যান্ডে ফিরতে পারলে বাকি জীবনটা আরামে কাটিয়ে দিতে পারবো। অনেক উপায় আছে টাকা রোজগারের, কিন্তু আমার হাতে ধরা দিতে চাইলো না। হাতে আসি আসি করেও আসে না, কেবলই ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।
কিভাবে? কৌতূহল বাড়ছে কিশোরের।
কিভাবে? সেসব গল্প বলতে গেলে কয়েক ঘণ্টায় কুলোবে না। অনেক সময় দরকার। তবে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। পমোটাস দ্বীপে একদিন এক দোকানে একটা ডাইভিং স্যুট নজরে পড়লো। জিনিসটা দোকানের মালিকের শখের জিনিস। বিক্রি করতে রাজি হলো না। তবে আমার চাপাচাপিতে ধার দিতে রাজি হলো এক শর্তে। যদি মুক্তো খুঁজে বের করতে পারি, তাহলে তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে দিতে হবে তাকে। ওটা নিয়ে চলে গেলাম আরেক পরিচিত লোকের কাছে। ঝরঝরে একটা বোট আছে তার। আরও একটা ভাগ দিতে হবে, এই কথা আদায় করে নিয়ে বোটটা নিয়ে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলো সে। স্যুট পেলাম, বোট পেলাম, আর ভাবনা কি? বেরিয়ে পড়লাম মুক্তো শিকারে। নিগ্রোরা ওখানে ভীষণ পরিশ্রম করে। গাধার মতো খাটতে পারে। আমিও ওদেরই মতো গাধা হয়ে থাকলাম পুরো একটা বছর। ডুবলাম ভাসলাম, ডুবলাম ভাসলাম, কতো হাজার বার যে ডুব দিয়েছি সাগরে, হিসেবই করতে পারবো না। বেশ কিছু মুক্তোও জোগাড় করলাম। ছোটখাটো একটা ব্যাগ ভর্তি। তিন ভাগের দুই ভাগ দিয়েও আমার যা থাকবে, যথেষ্ট। আর দরকার নেই। নিয়ে রওনা হলাম পাপিতিতে। পরের দিনই আঘাত হানলো সাইক্লোন। ওখানে ঝড়ের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যখন তখন চলে আসে। ভাঙা একটা কাঠ ধরে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছলাম মেরিয়েটা দ্বীপে, জান নিয়ে কোনোমতে ধুকতে ধুকতে। রোদে পুড়ে উঠে গেছে পিঠের চামড়া। নতুন চামড়া গজানোর জন্যে পড়ে থাকতে হলো হাসপাতালে। আর মুক্তোগুলো? যেখান থেকে তুলেছিলাম সেই সাগরের তলায়ই আবার ফিরে গেছে বোটটা সহ। আরেকবার একটা মালবাহী জাহাজে চাকরি নিয়ে চলেছি। একটা ক্যানুতে দেখলাম দুজন লোক, মারকুইস দ্বীপের লোক। মুক্তোর জন্যে ডুব দিচ্ছে। বড় বড় তিরিশটা ঝিনুক তুলে ফেলেছে, একটাও খোলা হয়নি। হাতে কাজকর্ম কিছুই নেই। ভাবলাম কিছু তো একটা করি। ঝিনুকগুলোর জন্যে দুটো পূরনো পাইপ আর এক কৌটো তামাক দিতে চাইলাম। লাফিয়ে উঠলো ওরা। লুফে নিলো প্রস্তাবটা। কারণ তিরিশটা কেন, তিরিশ হাজার ঝিনুক খুলেও অনেক সময় একটা মুক্তো পাওয়া যায় না। তবে ঝিনুকেরও দাম আছে, সেটা অন্য ভাবে। বীজ হিসেবে। টন টন ঝিনুক কিনে নিয়ে গিয়ে সাগরের বিশেষ জায়গায় ফেলে, যারা মুক্তোর চাষ করে। ওসব ঝিনুকের অনেক দাম। তবে এমনিতে তিরিশটা ঝিনুকের কোনো দামই নেই ব্যাপারটা আমার পাগলামি হিসেবেই ধরে নিলো ওরা। কিন্তু আমি তখন কাজ খুজছি, হাত চালানোর মতো যে কোনো কাজ। ডেকে বসে খুলতে শুরু করলাম ঝিনুকগুলো। একটা কথা বলে নিই। কিশোর আর মুসার দিকে ফিরে বললো, তোমাদেরকে বলছি না। তোমরা নিশ্চয় জাননা। ওমরকে বললো, এমনিতে সাধারণত যেসব ঝিনুক দেখা যায়, দক্ষিণ সাগরের ওসব মুক্তোওয়ালা ঝিনুক সেরকম নয়। অনেক বড়। কয়েক পাউন্ড ওজন। অনেক সময় নিয়ে খুললাম প্রথমটা কিছু নেই। দ্বিতীয়টা খুললাম। ওটাতেও কিছু পেলাম না। এক এক করে উনত্রিশটা ঝিনুক খুলে ছড়িয়ে ফেললাম ডেকের ওপরে। আমার ভাগ্যে কিছুই মিললো না। আর একটা মাত্র ঝিনুক বাকি। ওতে কিছু পাওয়ার আশা করলাম না। সবগুলোর চেয়ে ছোট ওটা। খাবার সময় লোকে কি করে? প্রথমে বড়টা বেছে নেয়, সে যা-ই হোক। মিষ্টি হোক, মাছ হোক, যেটাই হোক, প্লেটের বড়টার দিকেই ঝোঁক মানুষের। আমিও তা-ই করেছিলাম। প্রথমে বড়টা বেছে নিয়ে খুলেছিলাম, তারপর ওটার চেয়ে ছোটটা। এভাবে খুলতে খুলতে বাকি রয়ে গিয়েছিলো সব চেয়ে ছোটটা। বেশ অবহেলা নিয়েই ফাঁক করলাম ওটা। ভেতরে আঙুল ঢোকালাম। নরম মাংসের মধ্যে শক্ত কি যেন লাগলো। বের করে আনলাম। মুক্তোই! থ্রাশ পাখির ডিমের সমান বড়। এমন মুক্তো জীবনে দেখিনি। ডেকের ওপর পড়ে রইলো। ঝিনুক থেকে বের করার পর ভেজা মুক্তোর রঙই অন্যরকম লাগে। আগুনের মতো জ্বলে। প্যারিসে নিয়ে গেলে ওই একটার দামই বিশ হাজার ডলারের কম হবে না। বেশিও হতে পারে। এর আগে আমিও এতো বড় আর সুন্দর মুক্তো দেখিনি। বোকা হয়ে গেলাম যেন। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক ওই সময় জোরে বাতাস লাগলো, ঢেউয়ে কাত হয়ে গেল জাহাজ। ডেকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল মুক্তোটা। চিৎকার করে উঠে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম, থাবা দিয়ে তুলে নিতে চাইলাম ওটাকে। ধরতে পারলাম না। চোখের সামনে গড়িয়ে গিয়ে সাগরে পড়ে গেল। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো ঝিলিক দিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেল নীল সাগরে। আরেকবার চিৎকার করে উঠেছিলাম, যেন ওটাকে ফেরানোর জন্যেই। কিন্তু কথা শুনলো না মুক্তোটা। চলে গেল। মুক্তো সম্পর্কে অনেক গুজব রয়েছে। অনেক কিংবদন্তী। দ্বীপের লোকেরা বলে, অনেকের ভাগ্যে মুক্তো সয় না। তাকে দেখা দিয়ে আবার ফিরে যায় সাগরে অনেকের আবার দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে। আমার ভাগ্যে যে কোনটা ঘটলো, বুঝতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলাম। কতো মুক্তোই হাতে এসেছে, একটাও বিক্রি করতে পারিনি। যা-ই হোক, আসল গল্পটা এবার বলি।