আমরা থাকি? কিশোর অনুমতি চাইলো। ছবিগুলো দেখেই যাই আমি আর রবিন। অসুবিধে আছে?
হাসলেন উকিল সাহেব। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু আমি একটা দায়িত্ব পালন করছি। একজনের সম্পত্তি আমার কাছে গচ্ছিত রয়েছে। লোকে জানলে খুব সমালোচনা করবে।
কিশোর কথা বলছে, সময় নষ্ট না করে এই সুযোগ আরেকটা স্লাইড ঢুকিয়ে দিয়েছে রবিন। দুটো লোককে দেখা গেল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে।
অস্ফুট শব্দ করে উঠলো কিশোর। একজনকে চিনতে পেরেছে। বায়ের মানুষটি মিস্টার চেস্টার রেডফোর্ড।
অন্য লোকটা কে? রবিনের প্রশ্ন। দেখতে তো অনেকটা ইনডিয়ানদের মতো লাগছে।
স্প্যানিশ-ইনডিয়ান! বিড়বিড় করলো কিশোর। ফাউলারের দিকে তাকালো। কে ও? পিন্টো আলভারো?
বলতে পারবো না, মাথা নাড়লেন উকিল সাহেব। স্থির দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। অ্যাজটেক যোদ্ধার সত্যিকারের বংশধর হতে পারে! চেহারা অন্তত তা-ই বলছে।
কিশোর আর রবিনের মতোই উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন ফাউলার। যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন ছবিটার দিকে। দ্রুত পরের ছবিগুলো চালিয়ে দিলো রবিন। প্রতিটিতেই দুজনের ছবি, নানা ভঙ্গিতে, চমৎকার একটা বাগানের মধ্যে তোলা।
মিস্টার ফাউলার, আবার অনুরোধ করলো কিশোর। ছবিগুলো তো সবই প্রায় এক। একটা নিয়ে গেলে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। নিতে পারি? প্রিন্ট করে নেবো।
ভেবে দেখলেন উকিল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিলেন।
সব চেয়ে পরিষ্কার ছবিটা বেছে বের করলো কিশোর। সাবধানে রুমালে জড়িয়ে পকেটে রাখলো।
প্রেজেক্টর, পর্দা আর বাক্সগুলো যেখানে ছিলো, সেখানে রেখে এলো আবার তিনজনে মিলে। বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। সদর দরজার তালা লাগালেন ফাউলার। তারপর ছেলেদের নিয়ে এসে গাড়িতে উঠলেন। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
ভেতরে ঢুকেই সোজা হেডকোয়ার্টারের দিকে এগোলো দুই গোয়েন্দা। পথে দেখা হয়ে গেল রাশেদ পাশার সঙ্গে। পুরানো একটা গার্ডেন চেয়ারে বসে পাইপ টানছেন তিনি। গভীর মনোযোগে কি যেন দেখছেন ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে। ওদের সাড়া পেয়ে মুখ তুললেন। হাত নেড়ে ডাকলেন, দেখে যা।
গেল দুজনে। ময়লা পুরানো একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দুটো আঙুলের ছাপ আছে। দেখ তো একরকম না আলাদা?
অবাক হয়ে চাচার মুখের দিকে তাকালো কিশোর। নীরবে হাত বাড়িয়ে কাগজ আর গ্লাসটা নিলো। ভালোমতো দেখে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললো, আলাদা। একজনের না।
মুচকি হাসলেন রাশেদ পাশা। আমি যদি বলি একজনের?
চাচার মুখের দিকে তাকিয়েই রয়েছে কিশোর। কি হয়েছে তোমার, চাচা? পুরানো মাল বাদ দিয়ে হঠাৎ এই গোয়েন্দাগিরি!
তুই যদি পুরানো মাল আর গোয়েন্দাগিরি একসাথে চালাতে পারিস, আমি পারবো না কেন?
তা বটে। কিন্তু হঠাৎ তোমার এই শখ কেন?
হঠাৎ দেখলি কোথায়? তোরা যখন কোনো কেসে কাজ করিস, আমি কি ইনটারেস্টেড হই না? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করি না?
তা করো…
নতুন একটা খবর শুনবি? হাসিটা ছড়িয়ে পড়েছে রাশেদ পাশার চোখে। গোঁফের কোণ ধরে টানলেন। আমিও একসময় গোয়েন্দা ছিলাম।
বোমা ফাটলো যেন, এমন ভাবে চমকে গেল কিশোর রবিন। গোয়েন্দা! একই সঙ্গে বলে উঠলো দুজনে।
হ্যাঁ, গোয়েন্দা। জীবনে অনেক কাজই করেছি, জানিস। বাড়ি থেকে পালিয়ে সার্কাসের দলে যোগ দিয়েছি। ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়িয়েছি দেশে দেশে। জাহাজের নাবিক হয়েছি। মরুভূমিতে গিয়ে বেদুইনদের সঙ্গে বাস করেছি…
সেসব জানি, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। জনতাম না শুধু গোয়েন্দা হওয়ার খবর।
ভালো ডুবুরি ছিলাম আমি, সেখবর জানিস? প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপে বহুদিন থেকেছি আমি, মুক্তো-শিকারীদের দলে।
আশ্চর্য! এতো কিছু ছিলে তুমি…
তোর বাপও অনেকটা এরকমই ছিলো। তোর দাদাও। নইলে রহস্য আর, রোমাঞ্চের এই তীব্র নেশা এলো কোত্থেকে তোর রক্তে?
হুঁ! বিমূঢ় হয়ে গেছে যেন কিশোর। রবিন থ। তা গোয়েন্দাটা কবে ছিলে? কোথায়?
জাহাজে থাকতে। একদিন এক কোটিপতি মহিলার নেকলেস হারিয়ে গেল। জাহাজের ডিটেকটিভ কিছুই করতে পারলো না। আমার খুব আগ্রহ হলো, দেখি তো চেষ্টা করে? দুই ঘণ্টার মধ্যেই বের করে দিলাম নেকলেসটা…
এত্তো তাড়াতাড়ি! চোখ বড় বড় করে ফেললো রবিন।
হ্যাঁ। সেদিনই আমাকে সহকারী গোয়েন্দার চাকরি দিয়ে ফেললেন ক্যাপ্টেন। ছমাসের মধ্যেই আসল ডিটেকটিভকে ছাড়িয়ে আমাকে তার জায়গায় বহাল করলেন। কিন্তু টিকলাম না। বছরখানেক পরেই পালালাম। আফ্রিকার উপকূল ধরে চলছিলো তখন জাহাজ। সিংহ আর হাতি শিকারের লোভ সামলাতে পারলাম …
আচমকা কি হলো কিশোরের কে জানে! চট করে বসে পড়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফেললো চাচাকে। এতো কথা কোনোদিন কিন্তু জানাওনি তুমি আমাকে!
জানাবো কি? আমার এই ছন্নছাড়া জীবনের কথা শুনলেই তোর চাচী খেপে যায়। বলে ফালতু সময় নষ্ট করেছি আমি। কে যায় অহেতুক সংসারের শান্তি নষ্ট করতে…
হুঁ! মাথা দোলালো কিশোর। তা এই আঙুলের ছাপের ব্যাপারটা কি, বল তো? আবার গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছে নাকি?
না। পুরানো ডায়েরী ঘাঁটতে গিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়লো কাগজটা। অবসর সময়ে ধাঁধার খেলা আমার খুব ভালো লাগতো। বসে বসে খেলতাম। এই আঙুলের ছাপ আমারই। এই যে এটা আসল। আর এটা নকল।