- বইয়ের নামঃ মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস
১. লন্ডন এক্সপ্রেস
মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস (১৯২৩) / আগাথা ক্রিস্টি / অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ
০১.
লন্ডন এক্সপ্রেসে প্যারিস থেকে লন্ডন ফেরার পথে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল।
জুনের ঝকঝকে দিন। কামরায় আমার সহযাত্রী বলতে ছিল একটি মেয়ে। মুখে পাউডারের প্রলেপ থাকলেও মেয়েটির বয়স সতেরোর নিচে মনে হল না। লাল টকটকে দুটি ঠোঁট সবার আগে নজর কাড়ে। ঘন ঘন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিল সে।
এগিয়ে এসে নিজেই আলাপ করল। কিন্তু আশ্চর্য তার আচরণ আমার গায়ে-পড়া মনে হল না। বরং তার মধ্যে আমি শিশুর সারল্য ও নারীর মাধুর্যের মিশ্রণ পেলাম।
–প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এখন আমরা পরস্পর বন্ধু।
এই ভাবেই সে শুরু করেছিল তার আলাপ। তারপর অল্প সময়ের মধ্যেই অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে সে যা জানাল তা হল, তার জন্ম আমেরিকায়। কিন্তু ইংলন্ডেই সে বড় হয়েছে তার এক বোনের সঙ্গে। পেশায় অভিনেত্রী।
ভালো কিছু করার একটা প্রবল বাসনা তার কথায় প্রকাশ পেয়েছিল যা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় বোধ হয়েছিল।
কথায় কথায়, জানি না কিভাবে সে অনুমান করল, বলল, তুমি নিশ্চয়ই যুদ্ধে গিয়েছিলে?
তার অনুমান যথার্থ স্বীকার করে আমি বললাম, একবার আহত হয়ে পঙ্গু হবারও উপক্রম হয়েছিল। এখন আমি একজন এম. পির সেক্রেটারি।
–কেবল ছারপোকা মারা কাজ যে তুমি কর না তা দেখেই বুঝতে পেরেছি। কাজের বাইরে আর কি কর? জানতে চেয়েছিল মেয়েটি।
এইভাবেই এসে পড়ল আমার সবচেয়ে গর্বের ও আনন্দের প্রসঙ্গ।
–আমার এক বেলজিয়ান গোয়েন্দা বন্ধুর সঙ্গে একটা ঘরে শেয়ার করে থাকি।
ছোটখাট চেহারার খুব মজাদার মানুষটি। প্রাইভেট গোয়েন্দা হিসেবে লন্ডনে প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছে। সরকারী গোয়েন্দারা যখন কোনো কেসে তল পায় না তখন তারা আমার এই বন্ধুটির শরণাপন্ন হয়। সে অনায়াসে তাদের সমস্যার সমাধান করে দেয়। তার সঙ্গেই আমার দিব্যি কেটে যায়।
–দারুণ! ওহ, দারুণ! অপরাধের গল্প আমার খুব প্রিয়।
স্টাইলস কেস তোমার মনে আছে? আমি জানতে চেয়েছিলাম।
একটু ভেবে নিয়ে সে জানায়, সাসেক্সের সেই বিষ খাইয়ে এক বৃদ্ধাকে হত্যার মামলা তো
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে গর্বের সঙ্গে জানালাম, সেটাই হল আমার বন্ধু এরকুল পোয়ারোর প্রথম বড় কেস।
এরপর পোয়ারার কীর্তিকাহিনী তাকে সবিস্তারে শোনাতে হয়েছিল। আর সে শুনেছিল তন্ময় হয়ে।
ক্যালাইন স্টেশনে ট্রেন থামলে প্ল্যাটফর্মে নেমে আমার সঙ্গিনী করমর্দন করে বলল, বিদায় বন্ধু। ডোভার থেকে জাহাজে যাওয়া হবে কিনা বলতে পারছি না, তাই এখানেই তোমাকে বিদায় জানাতে হচ্ছে। এখানে আমার বোনের সন্ধান একবার নিতে হবে।
বিদায়ক্ষণে আমার এই নতুন বন্ধুটির নাম জানতে চাইলে সে হেসে জানাল, সিনডেরেলা।
.
০২.
পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের টেবিলে বসে আছি আমি আর পোয়ারো।
–আজকের ডাকে এই চিঠিটা এসেছে। বলে পোয়ারো চিঠির কাগজটা বাড়িয়ে দিল। বেশ দামি বিদেশী কাগজে হাতে লেখা চিঠিটা সাগ্রহে চোখের সামনে মেলে ধরলাম।
ভিলা জেনেভিয়েভ,
মারলিনভিল সুরসার
ফ্রান্স
প্রিয় মহাশয়,
যে কোনো মুহূর্তে আমার জীবনের আশঙ্কা নিয়ে দিন গুণছি। তাই এই মুহূর্তে একজন গোয়েন্দা আমার প্রয়োজন। বিভিন্ন সূত্রে আপনার সুখ্যাতি আমার কানে এসেছে। আমি শুনেছি অপরাধ-তদন্ত বিষয়ে আপনি একজন দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি।
আমি নিশ্চিত, আমার বিপদ আসন্ন। এই পরিস্থিতিতে আমার অনুরোধ, আপনি আপনার হাতের সমস্ত কেস ফেলে রেখে এখুনি একবার ফ্রান্সে চলে আসুন। আমার জীবনরক্ষার স্বার্থে আপনার প্রয়োজনীয় অর্থসহ যাবতীয় কিছুর ব্যবস্থা আমি করব। বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ না করে আমার অনুরোধ রক্ষা করলে বাধিত হব।
আমার জীবনের বেশ কয়েক বছর স্যান্টিয়াগোয় কাটিয়েছি। সেখানেও কিছু সময়ের জন্য আপনাকে যেতে হতে পারে। আপনার পারিশ্রমিক কত জানাবেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী বিবেচনা করবেন।
আপনার তারবার্তা পেলে আমি ক্যালাইনে আপনার জন্য গাড়ি পাঠাব।
আপনার বিশ্বস্ত
পি. টি. রেনাল্ড
পুনশ্চ : ঈশ্বরের দোহাই আপনি আসুন।
–অদ্ভুত চিঠি। তুমি কি ঠিক করলে?
চিঠিটা পোয়ারোর হাতে ফেরত দিয়ে জানতে চাইলাম।
–এখুনি রওনা হতে হবে, তুমি সঙ্গে যাবে। ভিক্টোরিয়া থেকে এগারোটায় কন্টিনেন্টাল এক্সপ্রেস ধরব।
ব্যস্ততার সঙ্গেই বলল পোয়ারো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মিনিট দশেকের মধ্যেই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে।
-আমি রেডি। কিন্তু মিঃ রেনাল্ড নামটা যেন চেনা মনে হচ্ছে।
–তুমি যার নাম মনে আনবার চেষ্টা করছ তিনি দক্ষিণ আমেরিকার সুপরিচিত কোটিপতি। এই ভদ্রলোকই সেই রেনাল্ড কিনা বুঝতে পারছি না। বললাম আমি।
–একই লোক, বুঝতে পারছি। চিঠিতে স্যান্টিয়াগোর উল্লেখ রয়েছে, জায়গাটা চিলিতে, আর চিলি হল দক্ষিণ আমেরিকায়। মারলিনভিল সুরসার নামটা আমার শোনা।
-বোলোন আর ক্যালাইনের মাঝামাঝি একটা ছোট্ট জায়গা। কোটিপতি মিঃ রেনাল্ডের একটা বাড়ি ইংলন্ডেও আছে বলে শুনেছি। বলল পোয়ারো।
–হ্যাঁ, আমি সায় জানালাম, রুটল্যান্ড গেটে।
তাড়াতাড়ি দুজনের দুটো স্যুটকেসে নিজেদের জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিলাম। তারপর ট্যাক্সি ধরে এগারোটার ট্রেন ধরবার জন্য ভিক্টোরিয়ায় উপস্থিত হলাম।
ডোভারের পথে সমুদ্রযাত্রায় রওনা হবার আগে আমাদের পৌঁছানর সময় জানিয়ে পোয়ারো মিঃ রেনল্ড কে একটা তারবার্তা পাঠিয়ে দিল।
আবহাওয়া চমৎকার ছিল। তাই সমুদ্রযাত্রাটা উপভোগ্যই হল। তবে পোয়ারোর সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। নিজের ধ্যানে চুপচাপ ছিল।
ক্যালাইনে জাহাজ থেকে নেমে হতাশ হতে হল। আমাদের জন্য কোনো গাড়ি পাঠানো হয়নি।
যাইহোক, সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া ট্যাক্সি নিয়ে মারলিনভিলের দিকে রওনা হয়ে পড়লাম আমরা।
ভিলা জেনেভিয়েভ খুঁজে পেতে অবশ্য একটু বেগ পেতে হল। রাস্তায় কয়েক জনের কাছে পথের নির্দেশ জেনে নিয়ে একসময় আমরা একটা বিরাট গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
এই সময় লক্ষ্য করলাম রাস্তার ডান দিকে একটা সুন্দর ছোট্ট ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে আমাদের দেখছে।
প্রথম দর্শনেই মেয়েটির অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করল। যৌবনের ঢল নামা দীর্ঘাঙ্গী মূর্তিটিকে কোনো দেবীমূর্তি বলে ভ্রম হওয়া কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। এই দেবীমূর্তির রূপলাবণ্য আমার আতুর দুই চোখ বার বার তার দিকে আকর্ষণ করছিল।
–এসব কি হেস্টিংস?
পোয়ারোর বিস্মিত স্বর কানে যেতে আমার সম্বিত ফিরল। চোখ ফিরিয়ে আমিও হকচকিয়ে গেলাম।
গেটের সামনে একজন সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে। হাত তুলে সে আমাদের নিরস্ত হবার ইঙ্গিত করল।
-ভেতরে যাওয়া বারণ।
–কিন্তু মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে যে আমাদের দেখা করবার কথা ছিল। এটা তারই ভিলা তো? বলল পোয়ারো।
-হ্যাঁ মঁসিয়েরা। কিন্তু…মঁসিয়ে রেনাল্ড আজ সকালেই খুন হয়েছেন।
.
০৩.
জানা গেল পুলিস কমিশনার ভিলার ভেতরেই আছেন। পোয়ারো পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে কয়েকটা শব্দ লিখে সার্জেন্টের হাতে দিয়ে পুলিস কমিশনারকে পাঠিয়ে দেবার অনুরোধ জানাল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছোটখাট বলিষ্ঠ চেহারার গুঁফো একজন অফিসারকে প্রায় ছুটতে ছুটতে আমাদের দিকে আসতে দেখা গেল।
পোয়ারো অস্ফুটে উচ্চারণ করল, মঁসিয়ে রেক্স।
–প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো–আপনাকে পেয়ে বড় আনন্দ হল। নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল।
পোয়ারো হাসিমুখে ভদ্রলোকের সঙ্গে করমর্দন করল। আমার দিকে ফিরে পরিচয় করিয়ে দিল, ইনি আমার ইংরেজ বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আর ইনি হলেন মঁসিয়ে লুসিয়ান রেক্স।
আমরা মাথা নিচু করে পরস্পরকে অভিবাদন জানালাম।
-১৯০৯ সালের পর এই আমাদের আবার দেখা হল। বললেন কমিশনার, কিভাবে কাজে আসতে পারি বলুন?
বুঝতে পারলাম, পোয়ারোর আগমনের কারণ ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন। তবু বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে পোয়ারো মিঃ রেনাল্ডের চিঠিতে তাঁকে ডেকে পাঠানোর কথা ও কারণ জানিয়ে দিল।
ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে হয়টেটের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে আমরা জানতে পারলাম, আজ সকাল নটা নাগাদ মিঃ রেনাল্ডের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। মাদাম রেনাল্ড এবং ডাক্তারের অনুমান রাত দুটোর সময় খুনটা হয়েছে।
ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হয়টেট যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছেন এবং তদন্তের কাজে ব্যস্ত আছেন।
হলের বাঁদিকে একটা ঘরে মঁসিয়ে রেক্স ও তার সাহায্যকারী অফিসার একটা গোলটেবিলের সামনে বসেছিলেন।
তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাদের আগমনের কারণও তাকে জানিয়ে দিলেন রেক্স। মেন্টালপিসের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মাঝবয়সী ডঃ ডুরান্ড, তার সঙ্গেও আমরা পরিচিত হলাম।
রোগাটে চেহারার দীর্ঘদেহী ম্যাজিস্ট্রেট, সমস্ত শুনে বিস্মিত স্বরে বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার, মিঃ রেনাল্ড দেখছি আগেই দুর্ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন।
তিনি পোয়ারোর কাছ থেকে মিঃ রেনাল্ডের চিঠিটা চেয়ে নিয়ে পড়লেন।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, এই চিঠিটার জন্য আপনার কাছে আমরা ঋণী। আমাদের ধারণা বদলে গেল। একটা গোপন খবর পেলাম। আশাকরি আপনি ইংলন্ডে ফিরে যাবার কথা ভাবছেন না।
-না মঁসিয়ে, বলল পোয়ারো, আমার নিয়োগকর্তাকে বাঁচাবার সময় আমি পাইনি, কিন্তু তার খুনীকে খুঁজে বার করা আমার কর্তব্য।
মাদাম রোনাল্ডও নিশ্চয় তার স্বামীর নিয়োগ অনুমোদন করবেন। প্যারিস থেকে মঁসিয়ে জিরয়েডও আসছেন।
তদন্তের কাজে আপনারা পরস্পরকে সাহায্য করবেন আশা করি। আমাদের তরফ থেকে প্রয়োজন মতো সবরকম সহযোগিতাই পাবেন।
পোয়ারো মঁসিয়ে হয়টেটকে ধন্যবাদ জানিয়ে এখানকার ঘটনার বিবরণ জানতে চাইল। তাঁর নির্দেশে কমিশনার বলতে শুরু করলেন, আজ সকালে বাড়ির কাজ করার সময় বৃদ্ধা পরিচারিকা ফ্রাঙ্কেইস দেখতে পায় বাড়ি সদর দরজা ভেজানো। মনিব কোথাও বেড়াতে গেছেন ধারণা করে সে এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি।
বাড়ির যুবতী পরিচারিকা লিওনি ওদিকে গৃহকর্ত্রীকে জাগাতে গিয়ে বীভৎস এক ঘটনার মুখোমুখি হয়। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার ঘরে পড়ে ছিলেন অচৈতন্য মিসেস রেনাল্ড।
এদিকে প্রায় একই সময়ে মিঃ রেনাল্ডের মৃতদেহও আবিষ্কার হয় এক গর্তের মধ্যে। ভিলার সীমানার বাইরে কয়েক গজ দূরে উন্মুক্ত কবরের মতো সেই গর্তে মুখ নিচুকরা অবস্থায় পড়েছিল দেহটা।
পেছনে ছোরার আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে তাঁকে।
–কতক্ষণ আগে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? সঙ্কোচের সঙ্গে জানতে চাইল পোয়ারো।
ডঃ ডুরান্ড বললেন, আমার মতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে রাত তিনটের সময়। অবশ্য মাদাম রেনাল্ড জানিয়েছেন সময়টা রাত দুটো। আকস্মিক আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছিল তার। তাই কোনোভাবেই বাধা দিতে পারেননি।
-বুঝেছি। মাথা নাড়ল পোয়ারো।
–বাড়ির পরিচারকরা ছুটে এসে মাদামের বাঁধন খুলে দেয়। বলতে শুরু করলেন কমিশনার, বাড়ির চাকরবাকরদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি দুজন মুখোশধারী লোক আচমকা শোবার ঘরে ঢুকে প্রথমে তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে। পরে তারা তার স্বামীকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সেই সময়ই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার সঙ্গে অবশ্য এখনো পর্যন্ত আমরা কথা বলিনি।
–মঁসিয়ে রেনাল্ড ও মাদাম বাদে বাড়িতে আর কে কে আছে? জানতে চাইল পোয়ারো।
–পরিচারিকাদের মধ্যে বৃদ্ধা ফ্রাঙ্কেইস, যুবতী দুই বোন ডেনিস ও লিওনি অও লমবার্ড। এছাড়া বাড়ির পুরনো মালিকের বহুবছরের পুরনো হাউসকিপার আর সোফার। তাকে মঁসিয়ে রেনাল্ড ইংলন্ড থেকে এনেছিলেন। মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ড–সঁসিয়ে রেনাল্ডের পুত্রও এবাড়িতে থাকেন। বর্তমানে তিনি বাইরে আছেন।
কমিশনারের বিবরণ শেষ হলে মঁসিয়ে হয়টেট জিজ্ঞাসাবাদের কাজ শুরু করলেন। তার নির্দেশ পেয়ে সার্জেন্ট প্রথম হাজির করল বৃদ্ধা ফ্রাঙ্কেইসকে।
মঁসিয়ে হয়টেটের প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতে জানাল, বাড়ির পূর্বতন মালকিন লা ভিকসটির-এর কাছে এগারো বছর ছিল। গত বসন্তে নতুন ইংরেজ মালিক বাড়িটা কিনে নিলে সে এখানেই থেকে যায়।
-খুব ভালো কথা। এবারে বলল, রাতে সদর বন্ধ করে কে? ম্যাজিস্ট্রেট জানতে চাইলেন।
প্রতিদিন আমিই দরজা বন্ধ করি মঁসিয়ে। গতকালও রাত সাড়ে দশটায় বন্ধ করেছিলাম।
–তখন বাড়ির অন্যান্যরা কে কোথায় ছিল বলতে পারবে?
-মঁসিয়ে রেনাল্ড তার পড়ার ঘরে ছিলেন। মাদাম কিছুক্ষণ আগেই শোবার ঘরে চলে যান। ডেনিস আর লিওনি আমার সঙ্গেই চলে আসে।
-তাহলে বোঝা যাচ্ছে মঁসিয়ে রেনাল্ডই রাতে দরজা খুলে থাকবেন।
-একাজ তিনি করতে পারেন না সিয়ে। প্রতিবাদ করে উঠল ফ্রাঙ্কেইস, চোর-ডাকাত সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায় বাড়ির বাইরে, তা তিনি ভালোই জানতেন। অত রাতে সেই লেডিকেও তিনি বাড়ির বাইরে যেতে দেননি
–কোনো লেডির কথা বলছ তুমি? তার নাম কি? তীব্র স্বরে জিজ্ঞেস করলেন ম্যাজিস্ট্রেট।
একটু ইতস্ততঃ করে বৃদ্ধা জানাল, প্রায় সন্ধ্যাতেই তো তিনি আসেন। তাঁর নাম মাদাম ডওব্রেইল।
–ওহো, পাশের ভিলা মারগুয়েরিটে যিনি থাকেন? ঠিক বলছ?
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে, তার কথাই বলছি। আপনি তাকে জানেন দেখছি। খুবই সুন্দরী তিনি।
–অদ্ভুত ব্যাপার, বিস্ময় প্রকাশ করলেন ম্যাজিস্ট্রেট, গত সন্ধ্যায় তাহলে তাঁরা দুজন একসঙ্গে ছিলেন–
কথা থামিয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন বৃদ্ধার দিকে।
দেখা গেল খোঁচাটা ঠিক জায়গাতেই পড়েছে। ফ্রাঙ্কেইস গড়গড় করে বলতে শুরু করল, ওদের দুজনের মধ্যে কি সম্পর্ক তা আমি জানি না। সকলেই জানে মাদাম ডওব্রেয়ুইল অত্যন্ত গরীব, মেয়েকে নিয়ে থাকেন। অসাধারণ সুন্দরী তিনি যদিও এখন আর যুবতী নন। সম্প্রতি গ্রামে অনেক কথাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তিনি দেদার খরচপত্র করছেন। অত টাকা কোথা থেকে পাচ্ছেন সেটা সকলের কাছেই রহস্য।
–এঁদের এই বন্ধুত্বের কথা মাদাম রেনাল্ড জানতেন?
–জানতেন সবই মঁসিয়ে। কিন্তু অত্যন্ত নম্র ভদ্র মহিলা তিনি। তাই স্বামীর আচরণে বুক ভেঙ্গে গেলেও মুখ বুজে সয়ে থাকেন। মানসিক যন্ত্রণায় দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছেন তিনি, আমি লক্ষ্য করেছি।
মঁসিয়ে রেনাল্ডও বুঝতেন কিন্তু গ্রাহ্য করতেন না। তিনি নেশাগ্রস্তের মতো হয়ে পড়েছিলেন-সন্ধ্যা হলেই প্রতিদিন তিনি ছটফট করতে থাকতেন।
মঁসিয়ে, আমি জানি, মাদাম ডওব্রেয়ুইল খুবই খারাপ স্বভাবের মহিলা। সে গ্রাস করেছিল মঁসিয়েকে।
-তাহলে তুমি বলছ, কাল সন্ধ্যায় ভদ্রমহিলা যথারীতি এসেছিলেন। তিনি কি রাতে চলে গিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ মঁসিয়ে। পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে মঁসিয়ে তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন আর ভদ্রমহিলা শুভরাত্রি জানিয়েছিলেন। আমি শুনতে পেয়েছিলাম। এরপর মঁসিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন।
–তখন সময় কত হবে?
–তখন রাত দশটা পঁচিশ হবে।
–আচ্ছা, এ ব্যাপারে তোমার কাউকে সন্দেহ হয়?
–না মঁসিয়ে।
ম্যাজিস্ট্রেট এরপর বিদায় দিলেন বৃদ্ধাকে। তার ডাক পেয়ে ঘরে উপস্থিত হল লিওনি অও লমবার্ড। লিওনি হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতেই ঘরে ঢুকল।
এই যুবতী পরিচারিকাটিই প্রথম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাদাম রেনাল্ডকে দেখতে পেয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের জিজ্ঞাসার উত্তরে সে পুনর্বার সেই বর্ণনা শোনালো। রাতেও কোনো অস্বাভাবিক শব্দ সে শুনতে পায়নি। তার বোন ডেনিসও জানাল তার মনিবের চালচলন ইদানীং কেমন বদলে গিয়েছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট ডেনিসকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল রাতে মাদাম ও ডওব্রেয়ুইলকে কি তুমিই দরজা খুলে দিয়েছিলে?
–গতরাতে নয় মঁসিয়ে, তার আগের দিন। গতরাতে তিনি আসেননি।
–ফ্রাঙ্কেইস যে বলল, তিনি গতকাল রাতেও এসেছিলেন?
–না, মঁসিয়ে, গতকাল রাতে অন্য এক মহিলা সিয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
–অদ্ভুত ব্যাপার! বেশ, আগে কখনো এই মহিলাকে তুমি দেখেছো?
–না, মঁসিয়ে। কাল যিনি এসেছিলেন, আমার মনে হয় তিনি একজন ইংরেজ মহিলা।
–ইংরেজ?
–হ্যাঁ মঁসিয়ে। তবে তিনি মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে ফরাসি ভাষাতেই কথা বলেছিলেন। তাছাড়া যাবার সময় তিনি ইংরাজিতেই কথা বলেন। আমি ইংরাজিতে ভালোই কথা বলতে পারি। ভদ্রমহিলাকে বিদায় দেবার সময় মঁসিয়ে রেনাল্ড বলেছিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন তুমি বিদেয় হও। ইংরাজি কথাগুলি আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম।
মেয়েটিকে বিদায় দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট দুজন পরিচারিকার পরস্পর বিরোধী সাক্ষ্য নিয়ে খুবই ভাবিত হয়ে পড়লেন।
পোয়ারো এই সময় কমিশনার রেক্সের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, মাপ করবেন, মঁসিয়ে রেক্স, আমার ধারণা মঁসিয়ে রেনাল্ড নিজে গাড়ি চালাতে পারতেন।
পোয়ারোর কুঞ্চিত ভ্রূ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, কোনো চিন্তার গভীরে ডুবে আছে ওর মন।
কমিশনার বললেন, আমি খবর নিয়ে জেনেছি, তিনি নিজে কখনো গাড়ি চালাতেন না।
–একথা মাথায় এলো কেন তোমার? আমি জিজ্ঞেস করলাম পোয়ারোকে।
-কেন, তিনি তোত চিঠিতে আমার জন্য ক্যালাইনে গাড়ি পাঠাবার কথা লিখেছিলেন, তুমি দেখতে পাওনি?
–তিনি নিশ্চয় ভাড়া গাড়ির কথাই বলে থাকবেন। বললাম আমি।
–আমার তা মনে হয় না। নিজের গাড়ি থাকতে তিনি কেন ভাড়া গাড়ির কথা ভাববেন?
-মঁসিয়ে রেক্স, ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, তাহলে কার কথা বিশ্বাস করব আমরা? ডেনিস না ফ্রাঙ্কেইস?
–নিঃসন্দেহে ডেনিস, তার সিদ্ধান্ত জানালেন কমিশনার, গতকাল সন্ধ্যায় এই মেয়েটিই অতিথিকে দরজা খুলে দিয়েছিল। মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে যে ফ্রাঙ্কেইস পছন্দ করে না তা তার কথাতেই পরিষ্কার। তাছাড়া, আমরা জানি অন্য একটি মহিলার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল মঁসিয়ে রেনাল্ডের।
–ওহো, তাই তো, ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট বলে উঠলেন, মঁসিয়ে পোয়ারোকে তো খবরটা দেওয়াই হয়নি।
বলতে বলতে তিনি টেবিলের ওপরে রাখা কাগজের ভেতর থেকে তুলে একটা কাগজ পোয়ারোর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, এই চিঠিটা মৃতের কোটের পকেটে পাওয়া গেছে।
ভাঁজ করা চিঠিটা খুলে ধরল পোয়ারো :
প্রিয়তম,
অনেকদিন তোমার চিঠি পাচ্ছি না। তুমি আমায় ভুলে গেছ কিংবা ভালোবাসো না–আমি বোকা নই যে এমন অসম্ভব কথা ভাবব। যদি ভালোইবাস তাহলে এমনভাবে নীরব হয়ে আছ কেন? ইদানীংকার চিঠিগুলোতে তোমার ভাষাও কেমন প্রাণহীন নিরস হয়ে আসছিল। এখন আবার চিঠিই বন্ধ করে দিলে। তোমাকে ছাড়া বাঁচার কথা আমি ভাবতে পারি না। যদি সত্যিই আমায় আর ভালো না বাসো, তাহলে নির্ঘাৎ আমি আত্মহত্যা করব, জেনো।
আমার আর তোমার মাঝখানে অন্য কোনো নারীর ছায়া পড়েছে, মাঝে মাঝে এমন কথাও মনে হতে চায় আমার। অন্য নারীর যদি হতে চাও তুমি, তাহলে তার আগে তোমাকেই খুন করে আমি জ্বালা জুড়ব। আমার হাত দিয়ে কী কথা বেরিয়ে গেল প্রিয়? আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাস। হ্যাঁ আমিও ভালোবাসি…ভালোবাসি তোমাকে।
তোমার আদরের
বেলা
ঠিকানা, তারিখবিহীন চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে সেটা ফেরত দিল পোয়ারো।
চিঠিটা একটু রহস্যময়
-ওই বেলা নামে ইংরেজ মহিলার সঙ্গেও সঁসিয়ে রেনাল্ডের ঘনিষ্ঠ প্রেম ছিল বোঝা যাচ্ছে। এখানে এসে মাদাম ডওব্রেয়ুইল-এর সংস্পর্শে আসার পর তিনি বেলা নামের মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
ব্যাপারটা অনুমান করেই চিঠিতে তাকে এরকম একটা হুমকি দেওয়া হয়। কেসটা ক্রমশই বেশ জটিল হয়ে পড়ছে। মঁসিয়ে পোয়ারো, মঁসিয়ে রেনাল্ডকে যেভাবে পিঠে ছোরা বসিয়ে হত্যা করা হয়, সেটা কোনো মহিলার কাজ হওয়া অসম্ভব নয়।
-কিন্তু সদ্য সদ্য কবর খনন করা কোনো মহিলার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজটা নিঃসন্দেহ কোনো পুরুষের। বলল পোয়ারো।
–হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। বললেন কমিশনার।
–এই বেলার চিঠির সঙ্গে আপনাকে মঁসিয়ে রেনাল্ডের চিঠি লেখা–এ দুয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে যেন। বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।
–আপনি বলতে চাইছেন চিঠির হুমকিতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন? আমার তা মনে হয় না। বহু নারী ঘেঁটে বেড়ানো পুরুষরা এমন ভীতু হন বলে আমি মনে করি না।
-মঁসিয়ে রেনাল্ডের অতীত জীবনের ইতিহাস পাওয়া গেলে তার কোনো শত্রু ছিল কিনা, কিংবা প্রেমঘটিত আরো কোনো ব্যাপার সবই জানা সম্ভব হবে–স্যাণ্টিয়াপোর পুলিসকে খোঁজ নিতে অনুরোধ জানাব।
-এই মহিলার অন্য কোনো চিঠি বা অন্য জরুরী নথিপত্র কিছু কি পাওয়া গেছে?
–প্রয়োজনীয় বলতে মঁসিয়ে রেনাল্ডের একটা দলিল পাওয়া গেছে। এই সেই উইল–
উইলে চোখ বুলিয়ে পোয়ারো বলল, মিঃ স্টোনি ব্যক্তিটি কে? দেখছি এই উইলে তাকে হাজার পাউণ্ড দেওয়া হয়েছে।
–সঁসিয়ে রৈনাল্ডের সেক্রেটারি, বর্তমানে ইংলন্ডে আছেন।
–উইলটা গুরুত্বপূর্ণ–ছেলেকে পুরোপুরি বঞ্চিত রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি পাচ্ছেন তার স্ত্রী এলোইস। ডেনিস ও ফ্রাঙ্কেইস-এর দুই পরিচারিকা উইলের সাক্ষী।
-তারিখটা লক্ষ্য করেছেন? বললেন কমিশনার।
-হ্যাঁ, নজর পড়েছে, বলল পোয়ারো, পনেরো দিন আগের তারিখ রয়েছে। সম্ভবতঃ বিপদের আভাষ পেয়েই তড়িঘড়ি-যাইহোক, ঘটনাস্থল একবার ঘুরে আসা দরকার সঁসিয়ে রেক্স।
হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।
.
ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে মঁসিয়ে রেনাল্ডের পড়ার ঘরে ঢুকল পোয়ারো। পরিপাটি সাজানো একটা ছোটঘর।
ঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিলের দুপাশে দুটো চামড়া মোড়ানো হাতলওয়ালা চেয়ার। কিছু বই ও ম্যাগাজিন রাখা আছে টেবিলে।
ঘরটা একপাক ঘুরে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
–এটা কি বস্তু…দেখো তো হেস্টিংস
ফায়ারপ্লেসের সামনে পাতা মাদুরের কোণে পড়ে থাকা কয়েকটুকরো ফ্যাকাসে রঙের কাগজ তুলে নিল।
–একটা চেকের ছেঁড়া অংশ, নিজেই বলল পোয়ারো, দু ইঞ্চি পরিমাণ কাগজের টুকরোতে কালি দিয়ে লেখা রয়েছে ডুবিন।
কমিশনার রেক্স বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ডুবিন নামে কোনো ব্যক্তিকে মনে হয় চেকটা দেওয়া হয়েছিল?
–আমারও তাই অনুমান, বলল পোয়ারো, হাতের লেখাটা মঁসিয়ে রেনাল্ডের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
–অদ্ভুতভাবে জিনিসটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে
বলে উঠলেন কমিশনার।
-ঘর যারা সাফ করেছে তারাও লক্ষ্য করেনি, বলল পোয়ারো, সম্ভবতঃ গতকাল রাতে ডুবিন নামে কোনো লোক নিজের নামে চেকটা মঁসিয়ে রেনাল্ডের কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে
গোল টেবিলের ড্রয়ারে সন্ধান করে কমিশনার মঁসিয়ে রেনাল্ডের চেকবই বার করেন। দেখা গেল শেষ চেকের কাউন্টার ফয়েল একেবারে ফাঁকা।
-মাদাম রেনাল্ড হয়তো ডুবিন নামের লোকটির সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারবেন; চলুন তার কাছেই যাওয়া যাক। বললেন কমিশনার।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মুখে একটা লম্বা কালো চুল আঙুলে চেপে তুলে ধরল পোয়ারো।
–চামড়া মোড়ানো চেয়ারের পেছনে পাওয়া গেল মঁসিয়ে রেক্স সম্ভবতঃ এই ঘরেই গতকাল রাতে অতিথির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন গৃহস্বামী।
.
মঁসিয়ে রেনান্ডের মৃতদেহ নিয়ে এসে রাখা হয়েছিল বাড়ির পেছনে দেয়াল ঘেঁষে টিনের শেড দেওয়া একটা ঘরে। মঁসিয়ে রেক্স আমাদের সেখানে নিয়ে এলেন।
দেখা গেল মাঝারি উচ্চতার মানুষ ছিলেন আঁসিয়ে রেনাল্ড। তামাটে গায়ের রঙ। মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
পোয়ারো বলল, এ থেকেই বোঝা যায়, পেছন থেকে অতর্কিতে ছোরা মারা হয়েছে। মঁসিয়ে রেক্স, অস্ত্রটা কি ধরনের ছিল?
একটা বড় কাচের ট্রেতে অস্ত্রটা রাখা ছিল। কমিশনার সেটা দেখিয়ে বললেন, পেপার কাটার একটা–ছুরি মতো দেখতে। বাঁট সমেত ইঞ্চি দশেক হবে।
রক্তের দাগ শুকিয়ে ছিল গায়ে, ছুরিটা পরীক্ষা করল পোয়ারো। বলল, খুন করার পক্ষে যথেষ্ট।
-খুনী হাতে গ্লাভস ব্যবহার করেছিল, তাই কোনো হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি। বললেন কমিশনার।
–খুবই সতর্ক কাজ-ক্লু রাখতে চায়নি। বলল পোয়ারো, কিন্তু খুঁজে ঠিক বার করব। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখছি, মঁসিয়ে রেনাল্ড তার ওভার কোটের তলায় শুধু আন্ডারওয়ার পরে ছিলেন।
-হ্যাঁ, ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাপারটাকে রহস্যজনক মনে করেছেন।
এই সময় দরজা ঠেলে ফ্রাঙ্কেইস ঘরে ঢুকল। জানাল, মাদাম সুস্থ বোধ করছেন, কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
–আমরা এখুনি আসছি, তুমি সঁসিয়ে হয়টেটকে খবরটা দাও।
ফ্রাঙ্কেইস বিদায় নিলে কমিশনার বললেন, চলুন যাওয়া যাক।
পোয়ারো নিবিষ্ট চোখে মৃতদেহের দিকে তাকিয়েছিল। আচমকা বিড়বিড় করে বলে উঠল, ওভারকোটটা বেমানান লম্বা।
.
ওপরতলায় সিঁড়ির শেষ ধাপে একটা প্যাসেজ, প্রশস্ত করিডর। একপাশে চাকরবাকরদের ঘর। করিডরের শেষ প্রান্তে একটা বড় ঘরে ফ্রাঙ্কেইস আমাদের নিয়ে এলো।
দীর্ঘাঙ্গী মাঝবয়সী মাদাম রেনাল্ড একটা খাটে শুয়েছিলেন। ডাঃ ডুরান্ড তাকে পরীক্ষা করছিলেন।
সম্মানসূচক অভিবাদন জানিয়ে মাদাম আমাদের আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। দু-চার কথার পর ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট তার কাজ শুরু করলেন।
-মাদাম, গতকাল রাতের ঘটনা বিশদভাবে আমাদের বলুন।
–সবই বলব মঁসিয়ে। আমি চাই অপরাধীর শাস্তি হোক। আমার যথাসাধ্য আমি করব।
গতকাল রাতে সাড়ে নটা নাগাদ আমি শুতে যাই। আমার স্বামী পড়ার ঘরে ছিলেন। মনে হয় ঘণ্টাখানেক পরে শুতে আসেন।
অনেক রাতে কেউ হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু চিৎকার করতে পারিনি। দুজন মুখোশপরা লোক ছিল ঘরের ভেতরে।
-তাদের চেহারা আপনার মনে আছে মাদাম?
–একজন অপরজনের বিপরীত একেবারে। ঢ্যাঙা লম্বা লোকটির মুখে কালো দাড়ি, অপরজন বেঁটে গঁট্টাগোট্টা, মুখে লাল দানি। দুজনেরই মাথার টুপি টেনে চোখ আড়াল করা।
বেঁটে লোকটি আমার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলে। অন্য লোকটি আমার স্বামীর বুকের ওপর চেপে কাগজকাটা ছুরিটা উঁচিয়ে ধরেছিল।
এরপর তারা আমার স্বামীকে জোর করে পাশের ড্রেসিংরুমে নিয়ে যায়। প্রচণ্ড ভয় পেলেও সংজ্ঞা হারাইনি তখনো।
পাশের ঘর থেকে অস্পষ্ট চাপা কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। একজন স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলছিল, দক্ষিণ আমেরিকার লোকেরা যেমন বলে থাকে। সে আমার স্বামীকে বলছিল, সেই গোপন জিনিসটা আমাদের চাই। কোথায় সেটা?
কথা কাটাকাটি করে ওরা আমার স্বামীর কাছ থেকে চাবি নিয়ে ড্রয়ার খোলে, দেয়াল আলমারি খোলে। পরে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, আলমারি হাতড়ে সমস্ত টাকা তারা নিয়ে গেছে।
সেই সময় বাইরে একটা আওয়াজ হয়। তখন ওরা আমার স্বামীকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
তিনি তাদের বলেন, আমার সঙ্গে একবার কথা বলতে চান। পরক্ষণে তিনি ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে এসে বলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করোনা। সকাল হওয়ার আগেই আমি ফিরে আসব।
আমাকে অভয় দেবার চেষ্টা করছিলেন বটে, তার নিজেরই চোখেমুখে ভয়ের ছাপ ছিল। লম্বা লোকটা ঘর থেকে তাকে টেনে নিয়ে যায়। শাসিয়ে বলে, শব্দ করলে, মরবে।
এরপর সম্ভবতঃ আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আবার চোখ মেলে তাকাই দেখতে পাই লিওনি আমাকে ব্র্যাণ্ডি খাওয়াবার চেষ্টা করছে।
-খুনীরা কিসের খোঁজ করছিল বলে আপনার ধারণা?
–আমার কোনো ধারণা নেই মঁসিয়ে।
ইদানীং আপনার স্বামীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন?
-হ্যাঁ। প্রায় দিন দশেক আগে থেকেই আমি লক্ষ্য করি, তিনি কোনো দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। জিজ্ঞাসা করলেও আমাকে কিছু বলতে চাননি।
–আপনার স্বামী একজন গোয়েন্দার সাহায্য নিতে চেয়েছিলেন, একথা আপনি জানতেন?
প্রশ্নটা শুনে দারুণ চমকে উঠলেন মাদাম রোনাল্ড। তার ভ্রূ কুঞ্চিত হল।
-গোয়েন্দার সাহায্য?
–হ্যাঁ, এই ভদ্রলোক, মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো
পোয়ারো মৃদুহাস্যে মাথা নুইয়ে তাকে সম্ভাষণ জানালো।
ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট আবার বলতে শুরু করলেন, আপনার স্বামীর চিঠি পেয়ে আজই তিনি এখানে উপস্থিত হয়েছেন। যাইহোক, আপনি সর্বতোভাবে আমাদের সহযোগিতা করবেন, এটাই আমার প্রত্যাশা মাদাম।
আচ্ছা, দক্ষিণ আমেরিকায় আপনার স্বামীর কোনো শত্রু ছিল বলে আপনি মনে করেন?
নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারব না। তবে তার অনেক শত্রু ছিল।
–এই দুর্ঘটনার সময়টা আপনার মনে আছে?
সময়টা-ঘড়িতে ঢং ঢং দুটো আওয়াজ শুনেছিলাম।
এই সময় কমিশনার রেক্স একটা কাচভাঙ্গা হাতঘড়ি মেঝেয় কুড়িয়ে পেলেন।
–অদ্ভুত কাণ্ড! ঘড়িটা হাতে নিয়ে বলে উঠলেন তিনি, আততায়ীরা হয়তো ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এতে যে সাতটা বেজে আছে।
পোয়ারো ঘড়িটা কমিশনারের হাত থেকে নিয়ে কান লাগিয়ে পরীক্ষা করল।
-না, বিকল হয়নি, চলছে। কিন্তু এখন তো পাঁচটা বেজে কয়েক মিনিট, দুঘন্টা ফাস্ট হয়ে আছে এটা। বলে মাদাম রেনাল্ডের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
-ঘড়িটা ফাস্ট যায় বটে কিন্তু এত ব্যতিক্রম তো হয় না। বললেন মাদাম।
যাইহোক, মাদামকে ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্ন করলেন, শোবার ঘরের দরজাটা ভেজানো অবস্থায় দেখা গেছে, এ সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
–সম্ভবতঃ আমার স্বামী বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।
কমিশনার বললেন, গোপন একটা জিনিসের খোঁজ করছিল আততায়ীরা, আমার মনে হয়, মঁসিয়ে রেনাল্ডকে কাছেই কোথাও তারা নিয়ে গিয়ে থাকবে।
–হ্যাঁ, তিনি সকালের আগেই ফিরে আসার কথা বলেছিলেন। সায় জানালেন ম্যাজিস্ট্রেট।
পোয়ারো জানতে চাইল, মারলিনভিল স্টেশন থেকে শেষ গাড়ি কখন ছাড়ে?
-ডাউনে এগারোটা পঞ্চাশ আর আপে বারোটা সতেরোয়। আমার ধারণা তারা মোটর গাড়িতেই গিয়ে থাকবে।
–হুঁ। মাথা ঝাঁকালো পোয়ারো।
–মাদাম আর একটা প্রশ্ন, ডুবিন নামে কাউকে আপনি জানেন?
–ডুবিন? ঠিক খেয়াল করতে পারছি না।
–বেলা, এই খ্রিস্টান নামের কোনো মহিলাকে?
–না, মঁসিয়ে।
-আপনি কি জানেন, গতকাল রাতে একজন মহিলা অতিথি আপনার স্বামীর কাছে এসেছিলেন?
–তা হবে। নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন তিনি।
নিচে থেকে ছুরিটা নিয়ে আসা হয়েছিল। এবারে সেটা তুলে ধরে ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি চিনতে পারেন মাদাম?
–হ্যাঁ, আমারই ছুরি। আমার ছেলে-ওটা কি রক্তের দাগ?
ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলেন মাদাম রেনাল্ড।
–হ্যাঁ, মাদাম, এটা দিয়েই আপনার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট ছুরিটা সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে বললেন, গতকাল রাতে ছুরিটা আপনার ড্রেসিংটেবিলের ওপরে ছিল।
-হ্যাঁ। আমার ছেলে জ্যাক ওটা যুদ্ধের স্মারক হিসেবে আমাকে উপহার দিয়েছিল। গতযুদ্ধে ও বিমানবাহিনীতে ছিল। ওটা স্ট্রিমলাইন বিমানের স্টিলের পাত থেকে তৈরি।
–আপনার ছেলে এখন কোথায়?
-জ্যাক বুয়েনস আয়ার্সে রওনা হয়ে গেছে। তাকে প্যারিসে পাঠানো হয়েছিল, আমার স্বামী গতকালই আবার তার পাঠিয়ে তাকে দক্ষিণ আমেরিকায় যাওয়ার কথা জানিয়ে দেন। সেখান থেকে তার যাওয়ার কথা স্যান্টিয়াগোয়।
–আবার স্যান্টিয়াগো।
ম্যাজিস্ট্রেট এবং কমিশনার রেক্স দুজনেই একসঙ্গে শব্দটা উচ্চারণ করে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
এই অবসরে পোয়ারো চেয়ার থেকে উঠে মাদাম রেনাল্ডের কাছে সরে এসে অনুরোধ জানাল, ক্ষমা করবেন মাদাম, আপনার হাতের কব্জিতেই তো ওরা বেঁধেছিল?
-হ্যাঁ, অবাক হয়ে তাকালেন মাদাম, পোয়ারোর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তিনি দুটো হাত বাড়িয়ে ধরলেন।
পোয়ারো উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করল। কব্জির ওপরে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে।
বেশ শক্ত বাঁধনই পড়েছিল, আপনাকে নিদারুণ কষ্টই সইতে হয়েছে।
ধন্যবাদ জানিয়ে পোয়ারো আসনে ফিরে এলো।
–কিন্তু মাদাম, আপনার ছেলের উপস্থিতি খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।
–আমি বুঝতে পারছি সিয়ে, বললেন মাদাম রোনাল্ড, নারী হলেও আমার মন যথেষ্ট শক্ত। আমার স্বামীর মৃতদেহ আমিই সনাক্ত করতে পারব।
ডাঃ ডুরান্ডের হাত ধরেই মাদাম রেনাল্ড নিচে এলেন। কিন্তু মৃতদেহ দেখেই, হায় ঈশ্বর, আমার স্বামী…আর্তনাদ করে জ্ঞান হারালেন তিনি।
পড়েই যাচ্ছিলেন, পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল। মাদাম রেনাল্ডের চোখের পাতা পরীক্ষা করে পোয়ারো নিশ্চিত হল।
–মাদাম রেনাল্ডের কণ্ঠস্বরে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। আমার পাশে সরে এসে বলল পোয়ারো, আমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হল হেস্টিংস।
.
এরপর আমরা সকলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলাম। বাগান থেকে দোতলার শোবার ঘরের জানালা চোখে পড়েছিল।
জানালার পাশ দিয়েই উঠে গেছে একটা গাছ। পোয়ারো সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ওপরে যাবার সহজতম পথ ওই গাছটা।
গাছটার নিচে অনুসন্ধান করে ফুলের কেয়ারিতে অনেকগুলো পায়ের ছাপ আবিষ্কার হল।
–এগুলো বাগানের মালিরই হওয়া সম্ভব। বললেন কমিশনার রেক্স।
-আমি মনে করি পায়ের ছাপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বলল পোয়ারো, ঠিক আছে এগিয়ে চলুন।
কয়েক গজ এগিয়েই সামনে উন্মুক্ত মাঠ। সেদিকে দেখিয়ে কমিশনার বললেন, গলফ খেলার মাঠ তৈরি হচ্ছে, কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।
এখানকার কিছু কাজের লোকই আজ ভোরে সামনের একটা কবরের মতো গর্ত থেকে মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছিল।
ডানপাশে মাটিতে পড়েছিল একটি লোক। আমাদের দেখে উঠে বসল।
-আরে মঁসিয়ে জিরয়েড আপনি এখানে? কমিশনার চিৎকার করে উঠলেন; এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট বারবার আপনার খোঁজ নিচ্ছেন–
মঁসিয়ে জিরয়েড, প্যারিসের বিখ্যাত গোয়েন্দা। তাঁর নাম শোনা ছিল। এখন চাক্ষুষ করার সুযোগ হল।
দীর্ঘদেহ যুবা, বয়স তিরিশের বেশি হবে না। সৈনিকের মতো স্বাস্থ্য হাবভাব। চুল গোঁফ পিঙ্গল।
পারস্পরিক অভিবাদন বিনিময়ের পর গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি পায়ের দাগের কথা বলছিলেন কানে এলো, ওগুলো এখানকার শ্রমিকদেরই হওয়া সম্ভব। তারাই মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল।
দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুই গোয়েন্দার মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষির আবহাওয়া তৈরি হয়ে যেতে দেখে কিঞ্চিৎ কৌতুক অনুভব করলাম। সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম, পোয়ারোর মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে।
–সামনেই ঝোপঝাড়ে তিনজন লোকের পায়ের ছাপ আমার নজরে পড়েছে। দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন, মাঝখানের ছাপগুলো মঁসিয়ে রেনাল্ডের জুতোর। তার দুপাশের পায়ের ছাপগুলো শক্ত মাটিতে পড়েনি অথবা মুছে ফেলাও হতে পারে।
সামনেই একটা কোদাল পড়েছিল। পোয়ারো হাঁটুমুড়ে বসে কোদালের পাশে পড়ে থাকা। একটুকরো সীসের পাইপ সাবধানে তুলে আনল।
প্যারিসের গোয়েন্দা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকালো পোয়ারোর দিকে। আমারও মনে হল নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েই পোয়ারো মাথা ঘামাচ্ছে।
–মঁসিয়ে রেক্স, কবরের গর্তটার চারপাশে মোটা সাদা চুনকামের মত লাইনটা কিসের? বলে উঠল পোয়ারো।
-ওটা গলফ কোর্সের লাইন মঁসিয়ে পোয়ারো।
তাহলে বাঙ্কারের মত গর্তটা এখানে কেন? কবর দেবার উপযুক্ত জায়গা তো এটা নয়।
.
০৪.
মঁসিয়ে জিরয়েড উপস্থিত হয়েছেন, এই খবরটা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাবার জন্য কমিশনার মঁসিয়ে রেক্স চলে গেলে আমি আর পোয়ারো ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলতে লাগলাম।
শেয়াল খেদানো কুকুর দেখেছো হেস্টিংস? ওই দেখো, ছোঁক ছোঁক করে ব্লু খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কবরের মতো গর্তটার কাছে দাঁড়ানো জিরয়েডকে দেখিয়ে বলল পোয়ারো।
–কিছু একটা অবশ্যই করছেন, তোমাকে ওই তুচ্ছ সীসের টুকরো নিয়েই মনে হয় সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই খুনের সঙ্গে ওটার কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। বললাম আমি।
–জিরয়েড আমল দেয়নি বলে একথা বলছো? ওকে ওর মতোই কাজ করতে দাও। কেসটা সরল মনে হলেও নিতান্তই সরল বলে আমি মনে করতে পারি না। ভেবে দেখেছো, ওই কাচভাঙা হাতঘড়িটা দুঘন্টা ফাস্ট হয়ে ছিল কেন?
তারপর খুনীদের যদি প্রতিশোধ নেওয়াই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে বিছানাতেই ঘুমন্ত অবস্থায় রেনাল্ডকে খুন করল না কেন তারা?
তারা গোপন কিছু খুঁজতে বা জানতে এসেছিল। মনে করিয়ে দিলাম আমি।
–তাহলে সেই গোপন জিনিসটা কি বাড়ির সীমানার মাত্র কয়েক গজের মধ্যেই ছিল? তাহলে তারা তাকে শোওয়ার পোশাক বদলে নিতে বলেছিল কেন? আবার, ওপরে ওঠার সময় তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো, চাকরবাকরদের কোনো শব্দ শোনা উচিত ছিল। কিন্তু তারা কিছু শুনতে পায়নি কেন? রাতে কি কোনো অতিথি এসেছিল? সামনের দরজা সেই কি ইচ্ছে . করে খোলা রেখেছিল? যদি তাই
কথা বলতে বলতে আমরা বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিলাম। কথা বন্ধ করে পোয়ারো হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ডানদিকের ফুলের কেয়ারি থেকে কিছু পায়ের ছাপ এখন আমি যাচাই করে নিতে চাই।
মঁসিয়ে রেক্স বলেছেন, ওগুলো বাগানের মালির পায়ের ছাপ।
ঠিক এমনি সময়ে দেখা গেল মালি এই দিকেই আসছে। পোয়ারো ডেকে তার সঙ্গে কথা বলল, তার বাগানের কাজের প্রশংসা করল।
বৃদ্ধ অগাস্টিন জানাল, সে গত চব্বিশ বছর এই বাগানে কাজ করছে।
জেরনিয়ামের কিছু নতুন চারা দেখিয়ে পোয়ারো জানাল, একটা কাটিং পেলে সে খুব খুশি হয়।
নিশ্চয় মঁসিয়ে। এখুনি দিচ্ছি।
বৃদ্ধ মালি ফুলের কেয়ারিতে পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে একটা চারার ডগা নিয়ে এসে হাসিমুখে পোয়ারোর হাতে তুলে দিল।
বারবার করে ধন্যবাদ জানিয়ে পোয়ারো চমৎকার কাটিংটার প্রশংসা করল। মালি চলে গেল।
এবারে আগের পায়ের ছাপগুলোর সঙ্গে অগাস্টিনের পায়ের ছাপ মেলাতে গিয়ে আমি দেখলাম ফুলের কেয়ারির পুরনো সব ছাপই বুটের।
পোয়ারো হেসে বলল, আমি আগেই তা লক্ষ্য করে বলেছিলাম, এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কমিশনার তা মানতে চায়নি।
একটু থেমে পোয়ারো আবার বলতে শুরু করল, তাহলে নিশ্চয়ই এবার স্বীকার করবে আমি ঠিক পথেই চলেছি। তবে ওই শেয়াল তাড়ানো জিরয়েড এই ছাপগুলো যদি লক্ষ্য না করে, আমি বিস্মিত হব না।
এমনি সময়ে দরজা খুলে বাড়ি থেকে ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট আর কমিশনার বেরিয়ে এলেন।
-আপনারা এখানে। আমরা খুঁজছিলাম, বললেন হয়টেট, মাদাম ডওব্রেয়ুইল-এর বাড়িতে যেতে চাই। মঁসিয়ে রেনাল্ড তার স্ত্রীকে জানাননি এমন কোনো তথ্য তার প্রেমিকাকে জানিয়ে থাকতে পারেন।
পোয়ারো মাথা নাড়ল। আমরা দুই অফিসারকে পেছনে থেকে অনুসরণ করে চললাম।
চলতে চলতে পোয়ারো বলল, ফ্রাঙ্কেইস সত্য কথাই বলেছে। মঁসিয়ে রেনাল্ড মারলিনভিলে আসার পর গত ছয় সপ্তাহে মাদাম ডওব্রেয়ুইল সর্বমোট দু লক্ষ ফ্রাঙ্ক তিন দফায় জমা দিয়েছেন। সিয়ের হৃদয়দৌর্বল্যের বহর একবার ভেবে দেখো হেস্টিংস। কিন্তু তাই বলে আমি মনে করি না, মঁসিয়ে হয়টেট যাই আশা করে থাকুন না কেন, মঁসিয়ে রেনাল্ড তার কোনো গোপন কথাও সেখানে প্রকাশ করেছিলেন।
কথা বলতে বলতে যে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম, আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম এই ভিলা মারগুয়েরিটের সামনেই সেই সুন্দরী অপরূপা মেয়েটিকে আমি দেখেছিলাম।
কমিশনার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, মাদাম ডওব্রেয়ুইল এখানে অনেকদিন থেকেই আছেন। কিন্তু তার সম্পর্কে এখানে কেউ কিছু জানে না। এমনকি তার স্বামী, তিনি জীবিত কি মৃত, সেসবও না। এখানে তিনি রীতিমত এক রহস্যময়ী নারী।
মঁসিয়ে হয়টেট বেল টিপলেন। দরজা খুলে দাঁড়াল আমার দেখা সেই দেবীমূর্তিটি। মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।
-মাদমোয়াজেল ডওব্রেয়ুইল, আপনার মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলার প্রয়োজন
মুহূর্তের জন্য চমকে উঠেছিল মেয়েটি। সামলে নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে বসার ঘরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেল।
সেই রহস্যময়ী নারীমূর্তির আবির্ভাব হল কিছুক্ষণের মধ্যেই। গোলগাল ভরাট চেহারা তার। মেয়ের মতো অতটা লম্বা নন। নীল দুটি চোখে বাঙ্য় ঔজ্জ্বল্য। যুবতী নন, কিন্তু যৌবনের আকর্ষণ অটুট।
ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেট সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলেন, মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনের ব্যাপারে আমরা তদন্তে এসেছি, আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি, যদি কোনো সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
–খুনের ব্যাপারে আমাকে—
বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত হল তার।
-হ্যাঁ, মাদাম, আমি যতদূর জানি, অন্যান্য দিনের মতে, গতকাল রাতেও আপনি মঁসিয়ে রেনাল্ডের ভিলায় গিয়েছিলেন।
–মঁসিয়ে রেনাল্ডের ভিলায়–অসম্ভব,
-মাদাম, আপনি হয়তো জানেন, একটা খুনের তদন্তে অনেক বিষয়ই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করার প্রয়োজন থাকে। আপনাকে আমি কোনো অভিযোগ করছি না, কেবল জানতে চাই, তিনি বিশ্বাস করে আপনাকে কোনো গোপন কথা বলেছেন কিনা। যেমন মনে করুন, তার কোনো শত্রুর কথা, স্যান্টিয়াগোর জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনার কথা–
–না, না, ওসব আমাকে কেন বলতে যাবেন, মাথা ঝাঁকালেন ডওব্রেয়ুইল, এসব প্রশ্ন আমাকে কেন? তার স্ত্রীই তো বলতে পারবেন।
–তিনি যা বলার বলেছেন, বললেন মঁসিয়ে হয়টেট, তাহলে বলছেন মঁসিয়ে রেনাল্ড আপনাকে কোনো গোপন কথা বলেননি?
–এসব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করার কোনো কারণ আমি বুঝতে পারছি না।
–কারণ হল, সাধারণত দেখা যায়, স্ত্রীকে বলা চলে না এমন অনেক কথা স্বামীরা তাদের রক্ষিতার কাছে ব্যক্ত করে।
সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন মাদাম ডওব্রেয়ুইল, তার চোখ ক্রোধে জ্বলে উঠল।
–আমার মেয়ের সামনে আপনি আমাকে অপমান করলেন মঁসিয়ে। আমি আর একটা কথাও আপনাকে বলব না।
এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেই শেষ পর্যন্ত আমাদের ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হল ভিলা মারগুয়েরিট থেকে।
.
আমাদের আর কিছুই করার ছিল না সেখানে। তাই মঁসিয়ে হয়টেটের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা মারলিনভিলের দিকে চলতে লাগলাম।
ভিলা জেনেভিয়েভ থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরেই ডেস বেনস। আপাততঃ সেখানেই আস্তানা নেবার ইচ্ছা আমাদের।
চলতে চলতে পোয়ারো বলল, যাই বল হেস্টিংস, ফরাসি পুলিসের তৎপরতা সত্যিই প্রশংসা করার মতো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখ, মাদাম ডওব্রেযুইলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কবে কত টাকা জমা পড়েছে সব খবর সংগ্রহ করে ফেলেছে।
হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ হতে দুজনেই ফিরে তাকালাম। আশ্চর্য হলাম দেখে মার্থা ডওব্রেয়ুইল আমাদের দিকেই ছুটে আসছে।
–মাকে না বলে চলে এসেছি, হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে বলল মেয়েটি, শুনলাম মৃত্যুর আগে মঁসিয়ে রেনাল্ড একজন গোয়েন্দাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, আপনি সেই গোয়েন্দা?
–হ্যাঁ, মাদমোয়াজেল, সংযত কণ্ঠে বলল পোয়ারো।
-আমি জানতে চাইছি, কাউকে সন্দেহ করছেন খুনের ব্যাপারে?
গভীর দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখল পোয়ারো। বলল, আপনি একথা জানতে চাইছেন কেন? মেয়েটির সুন্দর চোখ দুটি সহসা ভয়ার্ত হয়ে উঠল।
-মঁসিয়ে রেনাল্ড আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
–তাই বুঝি, বলল পোয়ারো, আপনি সুন্দরী এবং যুবতী, তাই আপনার কৌতূহল না মিটিয়ে পারছি না।
পোয়ারো মেয়েটিকে জানাল, সে দুজন লোককে সন্দেহ করছে তবে তারা বহিরাগত।
পোয়ারোর প্রশংসায় খুশি হয়েছিল মেয়েটি। এবারে সানন্দে ধন্যবাদ জানিয়ে ছুটে চলে গেল।
মার্থার চলে যাওয়াটাও ছিল মাধুর্যময়। আমি তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম। চমক ভাঙ্গল পোয়ারোর ডাকে।
আমি জানি, হেস্টিংস, তুমি সৌন্দর্যের পূজারী। কিন্তু বন্ধু ভুল করে যেন মার্থা ডওব্রেয়ুইলকে তোমার হৃদয় দিয়ে বসো না। ও মেয়ে তোমার জন্য নয়।
–এমন নিখুঁত সুন্দর মেয়ে
হেসে উঠলো পোয়ারো। উল্লাসের সঙ্গে বলতে লাগল, সুন্দর মুখ দেখলেই পুরুষের মাথা ঘুরে যায়। কিন্তু এমন অনেক ভয়ঙ্কর অপরাধীদের আমি জানি যাদের মুখ দেখতে ছিল দেবদূতের মতো।
–তাই বলে এমন নিষ্পাপ একটি মেয়েকেও–তুমি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে পার না।
-ওকে সন্দেহ করি এমন কথা বলিনি, বলল পোয়ারো, কিন্তু তার কেস সম্পর্কে এমন কৌতূহল খুবই অস্বাভাবিক, তাই না?
-মায়ের জন্য মেয়ের দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কি।
–হ্যাঁ, মা, চিন্তিতভাবে বলল পোয়ারো, কিন্তু বন্ধু, এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না, কিন্তু ওই মুখটা মনে হয় পরিচিত–কোথায় দেখেছি। তাই বলছি, হৃদয়ের দুর্বলতা সংযত কর। এটা বন্ধু হিসেবে তোমাকে আমার পরামর্শ।
–মেয়েটির মায়ের মুখ তোমার চেনা বলছ? আমি থমকে গেলাম পোয়ারোর কথা শুনে।
–অনেকদিন আগে যখন বেলজিয়াম পুলিসে কাজ করতাম-হ্যাঁ-একটা কেসের ব্যাপারে আমার মনে হয় ওই মুখের ছবি আমি দেখেছিলাম। একটা খুনের কেস
.
০৫.
পরদিন সকালে ভিলা জেনেভিয়েভে উপস্থিত হলাম আমরা। পরিচারিকা লিওনি ওপরতলা থেকে নেমে আসছিল।
পোয়ারো তার কাছে মাদাম রেনাল্ডের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিল। মেয়েটা যেন ক্ষোভে টগবগ করে ফুটছিল।
ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল, যে স্বামী অন্য মেয়েমানুষের জন্য স্ত্রীকে ঠকায় তার জন্য আমি হলে একফেঁটা চোখের জল ফেলতাম না।
একটা দুটো খোঁচা দিতেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, প্যারিস যাবার দিন বাপ ছেলেতে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। তবে ঝগড়ার কারণটা সে বলতে পারল না।
খবর নিয়ে জানা গেল খুনের দিন কোনো গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা ম্যাজিস্ট্রেট সেই তদন্তের জন্য গ্যারাজে গেছেন।
পোয়ারো তার জন্য অপেক্ষা করবে জানাল। আমি বললাম, তাহলে ততক্ষণে আমি একবার জিরয়েডের সঙ্গে কথা বলে আসি, দেখি কতদূর এগোলেন তিনি।
পোয়ারো হেসে সম্মতি জানাল।
.
বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের মনে ঘুরতে ঘুরতে গলফ খেলার মাঠের কাছে এলাম। সহসা চোখে পড়ল, পাশে ফুলের বাগানের কাছে একটি যুবতী দাঁড়িয়ে। তাকে চিনতে পেরে সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, সিনডেরেলা…তুমি?
-আমিও অবাক হয়েছি তোমাকে দেখে, আমার ট্রেনের বান্ধবীটি বলল, আমি পিসীর বাড়ি এসেছি, কিন্তু তুমি?
–আমার সেই গোয়েন্দা বন্ধুর কথা তোমাকে বলেছিলাম। ভিলা জেনেভিয়েভে একটা খুনের ঘটনা ঘটেছে
বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকালো ও।
-তোমরা তদন্তে এসেছো? ওহ, খুব ভালো, ক্রাইম আমার ভালো লাগে। কিন্তু ওসব নিজের চোখে কখনো দেখিনি। তুমি ঘটনাগুলো আমাকে দেখাও।
–কিন্তু প্রিয়, ঘটনাস্থল বাইরের কাউকে দেখানো নিষেধ।
–তুমি আমার বন্ধু। আমি দেখতে চাইলেও—
তোমার এতো আগ্রহ কেন? কি দেখবে বলতো?
–কোনো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হল, কোথায় খুনটা হল, মৃতদেহ, হাতের ছাপ কিংবা এমনি কিছু আবিষ্কার হয়ে থাকলে–এসবই আমি দেখতে চাই।
-কী সর্বনাশ। খুনের ঘটনার মুখোমুখি হতে তোমার ভয় করবে না?
–আমাকে যদি ঘটনাস্থল দেখার সুযোগ দাও তাহলে নিজেই দেখতে পাবে ভয় পাই কিনা। প্লিজ
বলতে বলতে সিনডেরেলা তার কোমল পেলব হাত আমার হাতের ওপরে রাখল।
কি যেন হয়ে গেল মুহূর্তে। আমার অধিকার বোধ সজাগ হয়ে উঠল। বলে উঠলাম, বেশ দেখি চেষ্টা করে।
সিনডেরেলাকে আমি ঘটনাস্থলে নিয়ে চললাম। যে লোকটি পাহারায় ছিল আমাকে স্যালুট করে সম্মান দেখাল; সঙ্গিনীর ব্যাপারে কোনো আপত্তি তুলল না।
ঘটনার বিবরণ শোনাতে শোনাতে তাকে নিয়ে আমি বাড়ির পেছনে শেডের সামনে উপস্থিত হলাম। এর ভেতরেই মঁসিয়ে রেনাল্ডের মৃতদেহ রাখা আছে।
শেডের চাবিটা ছিল সার্জেন্ট ডি. ভিলা মারকয়ডের কাছে। ভিলার ভেতরে গিয়ে তার কাছে চাবি চেয়ে নিয়ে এলাম।
–ওহ, তুমি আমার বন্ধু, প্রেমিক, চাবি দেখে উল্লসিত হয়ে বলে উঠল সিনডেরেলা, তোমার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।
বললাম, মৃতদেহ না দেখাই ভালো, ওই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না তুমি।
কিছু ভেবো না, আমার ওতে কিছু হবে না। চলো বাড়ি থেকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না তো?
নিঃশব্দে তালা খুলে শেডের ভেতরে ঢুকলাম আমরা। এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহের মুখ থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলাম।
আঁতকে ওঠার মতো শব্দ করে উঠল মেয়েটি। তাকিয়ে দেখি আতঙ্কে স্থির হয়ে গেছে তার চোখ। মুখ ফ্যাকাসে।
মৃতদেহটা আবার ঢেকে দিলাম।
–পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছিল। বললাম আমি।
–কোনো ছুরি দিয়ে? জানতে চাইল ও।
একটা কাচের ট্রেতে ছুরিটা রাখা ছিল। সেদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
–ওহ!
অস্ফুট একটা শব্দ করে চোখ বন্ধ করল সে। টলতে লাগল দেহটা। আমি তাকে ধরে ফেললাম।
–অনেক হয়েছে। বাইরে চল।
জল। একটু জল নিয়ে এসো প্রিয়
তাকে শেডের বাইরে ছেড়ে বাড়ির ভেতরে ছুটলাম আমি। তাড়াতাড়ি একগ্লাস জল এনে তাকে দিলাম। এক চুমুকে সবটা জল টেনে নিয়ে স্বাভাবিক হলো সে।
-চল, এখানে আর দাঁড়াব না। বলল মেয়েটি, আমাকে ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্য কেন দেখতে দিলে তুমি?
–তুমি তো আমার কথা শুনলে না, আমি তো তোমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছি।
ফুলবাগানের কাছে এসে আমি বললাম, জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে না তো? চল তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
দরকার হবে না। আমি ঠিক আছি। এবারে যাই। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। বিদায় –
তোমার ঠিকানা তো আমাকে দিলে না। আমি বললাম।
–হোটেল ডু-ফের-এ উঠেছি। কাল আমাকে দেখে যেও।
–হ্যাঁ যাব অবশ্যই। বিদায়।
মেয়েটির গমন পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পরে শেডের তালা বন্ধ করে সার্জেন্টকে চাবি ফিরিয়ে দিলাম।
.
ভিলার ভেতরে গিয়ে দেখলাম সেলুনে সকলেই উপস্থিত হয়েছেন। জিরয়েড তার তদন্তের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছেন।
একটা পোড়া সিগারেট আর একটা অব্যবহৃত দেশলাই কাঠি টেবিলে ওপর রেখে জিরয়েড বলছেন, খুনীরা কোথা থেকে এসেছে, এই দুটি সামান্য জিনিসই আমাকে বলে দিয়েছে। দেশলাই কাঠিটা এদেশে তৈরি নয়।
আমার ধারণা দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে। পোড়া সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে খুনীদের একজন নতুন একটা সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করেছিল, সেই সময়েই কাঠিটা পড়ে গিয়ে থাকবে।
–তাহলে ব্যবহৃত কাঠিটাও তো পাওয়ার কথা, যেটা দিয়ে সে সিগারেটটা ধরিয়েছিল। বলল পোয়ারো।
–সেটা পাওয়া যায়নি, বললেন জিরয়েড, তবে গুরুত্বপূর্ণ হল পোড়া সিগারেটের টুকরোটা। ওটা দক্ষিণ আমেরিকায় তৈরি।
–এই দুটো বস্তু তাহলে মঁসিয়ে রেনাল্ডের হতে পারে, বললেন কমিশনার, দুবছর আগে তিনি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরেছেন।
জিরয়েড প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, না, আমি অনুসন্ধান করেছি, তিনি অন্য ধরনের বিড়ি ও সিগারেট ব্যবহার করতেন। আমার বক্তব্য হল, আততায়ীরা বহিরাগত ছিল। বাড়ির অথবা বাইরের কেউ তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল। তবে সেটা এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।
–আচ্ছা মঁসিয়ে, পোয়ারো অধৈর্যভাবে বলে উঠল, এই কেসের মতো অন্য কোনো কেসের কথা কি আপনি মনে করতে পারছেন?
-সে রকম কিছু থাকলেও আমার মনে পড়ছে না।
-আমার ধারণা, একই ধরনের অপরাধের কোনো ঘটনা স্মরণ করলে অপরাধের মনস্তত্ত্বের দিকটা আমরা বুঝতে পারব। মানুষ স্বভাবতঃ নকলনবিশ। কোনো মানুষ যখন একটা অপরাধ করে, ঠিক একই পদ্ধতি সে পরবর্তী অপরাধগুলোর ক্ষেত্রেও অনুসরণ করে থাকে। কারণ, একটা অপরাধ করে যখন সে সফলতা পায় তখন আবার সফল হবার জন্য সে একই পদ্ধতি অবলম্বন করে।
এইভাবেই সে বারবার একই পদ্ধতিতে অপরাধ করতে থাকে এবং পদ্ধতির এই ধারাই তাকে পরিণামে পাপের বেতন গুণতে বাধ্য করে।
–আপনার এই বক্তৃতার উদ্দেশ্য? জিরয়েডের গলায় অবজ্ঞার স্বর শোনা গেল।
–মঁসিয়ে জিরয়েড, দুটি অপরাধ যখন একই ধরনের হয়, তখন বুঝতে হবে–পেছনে একটি মস্তিষ্কই কাজ করছে। আমি তাকে বলি মনস্তত্ত্বমূলক-সূত্র। আমি এই সূত্রই অনুসরণ করে থাকি।
মাদাম রেনাল্ডের সেই কাচ ভাঙ্গা হাতঘড়িটার কথা মনে করুন, সেটার সময় দুঘণ্টা এগিয়ে চলেছিল।
কেন ঘড়িটা ফাস্ট করে রাখা হয়েছিল জানেন? ওই দুঘণ্টায় অনেক ঘটনা ঘটানো যায়। তারপর ফুলের কেয়ারিতে ওই পায়ের ছাপগুলো
–কিন্তু আমার চোখে তা কিছু পড়েনি। বলে উঠলেন জিরয়েড।
–চোখ বন্ধ করে রাখলে কিছুই দেখা যায় না মঁসিয়ে—
চিড়বিড় করে লাফিয়ে উঠলেন জিরয়েড।
ঠিক সেই মুহূর্তেই মারকয়ড ঘরে ঢুকে জানাল, সেক্রেটারি মঁসিয়ে স্টোনর ইংলন্ড থেকে ফিরেছেন।
.
গ্যাব্রিয়েল স্টোনর ইংরেজ যুবক। বেশ আকর্ষণীয় চেহারা। ব্যায়ামপুষ্ট শরীর।
ম্যাজিস্ট্রেটের জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি জানালেন, মঁসিয়ে দুবছর হল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এখানে এসেছেন। সেই সময় থেকেই আমি তার সেক্রেটারির পদে বহাল আছি।
–মঁসিয়ে স্টোনর, স্যান্টিয়াগোয় তার জীবনের কোনো বিশেষ ঘটনা কিংবা শত্রুভাবাপন্ন কোনো লোকের কথা কি তিনি কখনো বলেছিলেন? :
–না মঁসিয়ে। তার অতীত জীবনের কথা, এমন কি ছেলেবেলার কথাও কখনো তিনি বলতেন না। আমার ধারণা তার জীবন খুবই রহস্যময় ছিল।
-ডুবিন নামে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের সম্পর্কের কথা আপনি শুনেছেন?
–মনে হয় না। তবে নামটা চেনা মনে হচ্ছে।
–বেলা–এই খ্রিস্টান নামের কোনো বান্ধবীর
মাথা নাড়ল স্টোনর। বলল, সম্পূর্ণ নামটা কি বেলা ডুবিন? নামটা আমি জানি।
–মঁসিয়ে রেনাল্ডকে লেখা ওই বেলা নামের মেয়েটির একটি প্রেমপত্র আমাদের হাতে এসেছে। চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেছেন, মঁসিয়ে রেনাল্ড তাকে অবহেলা করছেন। এছাড়া মাদাম ডওব্রেয়ুইল নামে একজন ফরাসী মহিলার সঙ্গেও যে মঁসিয়ে রেনাল্ডের অবৈধ গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই প্রমাণও আমরা পেয়েছি।
ভদ্রমহিলা কাছেই একটা ভিলায় থাকেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি মঁসিয়ে রেনাল্ডের ভিলায় আসতেন। আর ভিলা জেনেভিয়েভে মঁসিয়ে রেনাল্ডের আসার পর থেকে বেশ মোটা টাকাই ভদ্রমহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে।
হ্যাঁ মঁসিয়ে, ওই টাকা আমিই কয়েক দফায় ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে দিয়েছি। তবে আমার ধারণা, গুপ্ত প্রণয় নয়, এর পেছনে রয়েছে ব্ল্যাকমেল। মঁসিয়ে রেনাল্ডের রহস্যময় জীবনের কোনো গুপ্ত বিষয় নিশ্চয় ভদ্রমহিলা জানতেন।
–হ্যাঁ, এটা সম্পূর্ণ সম্ভব, বললেন কমিশনার।
–মঁসিয়ে স্টোনর, মঁসিয়ে রেনাল্ডের উইলের কথা আপনি নিশ্চয়ই জানতেন?
এক পক্ষকাল আগে যে উইল তিনি করেছিলেন তার কথা আমি জানতে চাইছি।
অবাক চোখে তাকালেন স্টোনর। ধীরে ধীরে বললেন, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
–উইলের শর্ত অনুযায়ী, স্বামীর সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির মালিক হবেন মাদাম রেনাল্ড। উইলে তার ছেলে জ্যাক রেনাল্ডের কোনো নাম নেই।
–এটা খুবই দুঃখজনক মঁসিয়ে।
জিজ্ঞাসাবাদ এখানেই শেষ হল। স্টোনর, মাদাম রেনাল্ডের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট মারকয়ডকে ডেকে নিচু স্বরে কিছু বললেন, তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
.
মঁসিয়ে স্টোনরের হাতে ভর দিয়ে মাদাম রেনাল্ড ধীর পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলেন। স্বামীর মৃত্যুশোকে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন ভদ্রমহিলা।
তাকে বসতে বলে মঁসিয়ে হয়টেট বললেন, মাপ করবেন মাদাম, নিয়মমাফিক কতগুলো কাজ আমাদের করতেই হয়।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, কয়েকটি বিষয় আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার করে নিতে চাই।
আপনার স্বামীর ছেলেবেলার কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা আপনি আমাদের জানাতে পারেন?
-না, মঁসিয়ে, এসব বিষয়ে তিনি কখনো কিছু বলতেন না। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ফরাসি-কানাডিও এটুকুই কেবল জানি।
–তার অতীত জীবনে রহস্য ছিল বলে আপনার মনে হয়? কোনো রোমান্টিক ঘটনা?
–আমার কোনো ধারণা নেই।
–মাদাম ডওব্রেয়ুইলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক ছিল বলে আমরা জেনেছি–আপনাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য আমরা লজ্জিত মাদাম।
মাদাম রেনাল্ডের মুখে লাল আভা ফুটে উঠল। তিনি দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। মাথা নেড়ে কোনোমতে উচ্চারণ করলেন, আমি জানতাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন দীর্ঘদেহী এক যুবক। তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। মৃত মঁসিয়ে রেনাল্ডেরই যেন জীবন্ত রূপ।
-জ্যাক! আমার প্রিয় খোকা।
আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলেন মাদাম রেনাল্ড।
এরপর তিনি উপস্থিত সকলের সঙ্গে তার ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
এরপর জানা গেল, দুদিন আগে চেরবর্গ থেকে আনজেরা জাহাজে তার সমুদ্রযাত্রার কথা ছিল। কিন্তু ইঞ্জিনের গোলযোগ দেখা দেওয়ায় যাত্রার দিন পিছিয়ে গিয়েছিল। গতকাল সান্ধ্যপত্রিকায় পরিবারের বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরে বাড়ি ফিরে এসেছেন।
মঁসিয়ে হয়টেট জ্যাক রেনাল্ডকে বসতে অনুরোধ করে জানতে চাইলেন, আপনার বাবা কি উদ্দেশ্যে আপনাকে এই ভ্রমণে পাঠিয়েছিলেন?
–আমার কোনো ধারণা নেই মঁসিয়ে।
পকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বার করে টেবিলে রেখে জ্যাক বললেন, এই তারবার্তাটা পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চস্বরে তারবার্তাটা পড়লেন–
এখনই চেরবুর্গের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে। সেখান থেকে আজ রাতে বুয়েনস আয়ার্সের জাহাজ আনজেরা ধরে স্যান্টিয়াগোয় রওনা হবে। পরবর্তী নির্দেশ সেখানেই পাবে। কোনো অবস্থাতেই ব্যর্থ হবে না রেনাল্ড।
টেলিগ্রামটা পড়া শেষ করে ম্যাজিস্ট্রেট একে একে প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন।
তার উত্তরে জ্যাক রেনাল্ড যা বললেন তা থেকে জানা গেল, এর আগে মঁসিয়ে রেনাল্ড তাকে কখনো এভাবে বাইরে যেতে বলেননি। তার বাবার অপরাধমূলক কোনো কাজের কথা সে জানে না। তার কার্যকলাপেও কখনো সে সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করেনি। তবে অকপটে স্বীকার করল, প্যারিস রওনা হবার আগে বাবার সঙ্গে তার প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল।
সেই সময় আমি এতই রেগে গিয়েছিলাম যে চিৎকার করে বলে উঠেছিলাম, আমার ইচ্ছে তুমি মরে যাও, তাহলে আমি স্বাধীনভাবে চলতে পারব।
আমি সেই সময় এমনই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে তাকে খুন করাও অসম্ভব ছিল না। বলল জ্যাক রেনাল্ড।
–সেই ঝগড়ার বিষয়টা আমি শুনতে পারি? জিজ্ঞেস করলেন ম্যাজিস্ট্রেট।
-সেকথা আমি বলতে পারব না।
-কিন্তু আইন আপনি নিজের হাতে নিতে পারেন না আঁসিয়ে, উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন ম্যাজিস্ট্রেট, কি নিয়ে আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল আপনাকে বলতে হবে।
থমথমে মুখে নিরুত্তর রইল জ্যাক।
পোয়ারো এই সময় বলে উঠল, আপনি চাইলে আমি বিষয়টা বলতে পারি মঁসিয়ে।
–আপনি জানেন?
–জানি। মাদমোয়াজেল মার্থা উওব্রেযুইলকে কেন্দ্র করেই ঝগড়াটা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত তরুণ রেনাল্ড স্বীকার করল, সে মাথা ডওব্রেয়ুইলকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু যে মেয়ের বংশপরিচয় জানা নেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার পরামর্শ তার বাবা দিয়েছিলেন ছেলেকে। মা ও মেয়ের চরিত্র সম্পর্কেও তিনি কটুক্তি করেন। ফলে পিতাপুত্রে তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায়। সেই সময় মঁসিয়ে রেনাল্ড ছেলেকে স্মরণ করিয়ে দেন যে সে তার ওপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
–এই কথার জবাবেই আমি বলি তুমি মর আমি চাই, তাহলে স্বাধীনভাবে চলতে পারব। বলল জ্যাক রেনাল্ড।
–তাহলে আপনার বাবার উইলের কথা আপনি জানতেন? প্রশ্ন করল পোয়ারো।
–হ্যাঁ, জানতাম তাঁর বিষয় সম্পত্তির অর্ধেক আমার, বাকি অর্ধেকের মালিকানা পাব মায়ের মৃত্যুর পরে।
–বেশ এরপর বলে যান। বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।
প্যারিসের ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছিল বলে আমি নিজেকে সংবরণ করি। সংক্ষেপে মার্থাকে সব লিখে জানিয়ে আমি স্টেশনে চলে যাই। আমার চিঠির উত্তরে মার্থা চমৎকার পরামর্শ দিয়েছিল আমাকে।
সব রকম বিরোধিতা এড়িয়ে থেকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার কথা জানিয়েছিল আমাকে। আমি তার পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম।
–মঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনার বাবার এই চিঠিটা পাওয়া গেছে–আপনি পড়ে বলুন কে এই চিঠি তাকে লিখতে পারে।
কোটের পকেট থেকে চিঠিটা বার করে তিনি এগিয়ে দিলেন। জ্যাক চিঠিটা পড়ে ফেরত দিয়ে বলল, না, এসম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
আর একটা কথা, সঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনি যুদ্ধের স্মারক হিসেবে আপনার মাকে একটা ছুরি উপহার দিয়েছিলেন। আপনি বেদনা পাবেন জেনেও বলতে হচ্ছে খুনী সেই ছুরি দিয়েই মঁসিয়ে রেনাল্ডকে হত্যা করেছে।
মুহূর্তে জ্যাকের মুখ ব্লটিংপেপারের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুষ্ককণ্ঠে বলল, সেটা তো একটা কাগজ-কাটা ছুরি–ছুরিটা কোথায়? আমি সেটা দেখতে চাই।
ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে রেক্সকে অনুরোধ জানালেন শেড থেকে ছুরিটা নিয়ে আসার জন্য। কমিশনার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমরা অপেক্ষা করেত লাগলাম। মিনিট দুয়েক পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন কমিশনার।
-মঁসিয়ে জর্জ–সেই ছুরিটা কাচের ট্রেতে নেই।
–অসম্ভব, আমি বলে উঠলাম, আজ সকালেই সেটা আমি দেখে এসেছি—
অবশিষ্ট কথা আমার গলায় আটকে গেল।
–আপনি দেখে এসেছেন, চাবি পেলেন কোথায়?
নিজেকে খুবই অপরাধী বোধ হতে লাগল। সব কথাই অকপটে খুলে জানালাম আমি। ম্যাজিস্ট্রেটের মৃদু ভর্ৎসনাও আমাকে কৃতকর্মের জন্য শুনতে হল। তবে তিনি প্রসঙ্গটা হাল্কা করে দিলেন রোমান্টিক রসিকতার প্রলেপ দিয়ে।
–তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আপনার বান্ধবীকে এগিয়ে দিয়ে এসে শেডের দরজায় তালা লাগাতে কুড়ি মিনিট অন্ততঃ খোলা ছিল ঘরটা–খুবই শোচনীয় ব্যাপার।
-হত্যাকারী বা হত্যাকারীর সহযোগী আশপাশেই ছিল ছুরিটা পুনরুদ্ধারে জন্য। ছুরির বাঁটে হাতের ছাপ পাওয়া যেতে পারে, নিশ্চয়ই এই ভয় ছিল। বললেন কমিশনার।
পোয়ারো বলে উঠলো, আপনি তো বলেছিলেন, ছুরির ওপর কোনো হাতের ছাপ ছিল না।
জিরয়েড বললেন, সম্ভবতঃ সে নিশ্চিত ছিল না।
-খুনী হাতে গ্লাভস পরে ছিল, কাজেই সে নিশ্চিত ছিল বলা যায়। বলল পোয়ারো।
–আমি বলছি খুনীর সহযোগীর কথা। বললেন জিরয়েড।
–আপাততঃ আমাদের তদন্তের কাজ এখানেই শেষ হল। ঘোষণা করলেন মঁসিয়ে হয়টেট, মঁসিয়ে জিরয়েডের হাতেই আমরা কেসের দায়িত্ব তুলে দিলাম। আশা করি তিনি তাঁর দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারবেন, খুনীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে পারবেন। মাদাম, আপনাকে আমার আন্তরিক সহানুভূতি জানাচ্ছি।
ম্যাজিস্ট্রেটের কেরানী টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে নিলেন। তারপর কমিশনারসহ তিনজনে প্রস্থান করলেন।
–চল বন্ধু, আমরাও তাহলে হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিই।
বলে আমার হাত ধরে উঠে পড়ল পোয়ারো।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পোয়ারো উদ্ভট কাণ্ড করল। হলের কোণায় হ্যাঁঙ্গারে একটা ওভারকোট ঝোলানো ছিল। মিঃ স্টোনার কিংবা জ্যাক রেনাল্ডেরই হবে। হঠাৎ ভেতরে ঢুকে পোয়ারো কোটের মাপ নিয়ে একটা কাগজে টুকে নিল।
কাজটা আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকলেও দেখলাম, পোয়ারোর মুখে তৃপ্তির হাসি। বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, চল, এবারে যাওয়া যাক।
২. হোটেলের পথে চলতে চলতে
০৬.
হোটেলের পথে চলতে চলতে পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, আজ সকালে যা যা ঘটলো, আমাকে সব খুলে বল।
-মাদাম রেনাল্ডের কথাই মাথায় ঘুরছে। তার স্বামী যে ছেলেকে একটা রহস্যময় সমুদ্রযাত্রায় পাঠাচ্ছেন, মনে হচ্ছে এবিষয়টা তার অজানা ছিল না। খুনের কারণটাও সম্ভবতঃ তিনি জানেন–কিন্তু কি এক অজ্ঞাতকারণে গোপন করে যাচ্ছেন। বললাম আমি।
-তুমি ঠিকই অনুমান করেছে, মাথা নেড়ে সমর্থন জানাল পোয়ারো, আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি মাদাম রেনাল্ড কিছু গোপন করতে চাইছেন। খুনের ব্যাপারে তার ওপরেই প্রথম সন্দেহ পড়েছিল আমার।
-তুমি ওঁকে সন্দেহ করেছিলে?
-হ্যাঁ, উইলের শর্ত একমাত্র তারই অনুকূল ছিল। এই কারণেই আমি তাঁর কব্জি পরীক্ষা করে দেখি। নিশ্চিত হই তিনি নিজেই দড়ি দিয়ে হাত বাঁধেননি।
তারপর তিনি মুখোশপরা লোকের যে কাহিনী শোনান, তা আমার পরিচিত। ওসব আগেই আমি শুনেছি কিংবা পড়েছি কোথাও।
সেই কব্জিঘড়ির কথাটা মনে কর, তিনি যা বললেন তা সত্যি ছিল না।
–তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না পোয়ারো। তুমি পরিষ্কার করে বলো।
–বেশ, তাহলে ভেঙ্গেই বলছি। খুনের ঘটনাটা কখন ঘটেছিল বলে তোমার মনে হয়?
-মাদাম রেনাল্ড তো বললেন, ঘড়িতে সেই সময় দুবার ঘণ্টা বেজেছিল–মানে রাত দুটো
-আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তার এই বক্তব্য সবাই বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি জানি তিনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। ঘটনা ঘটেছিল আরো দুঘণ্টা আগে। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি ঘড়িটার কাচ ভাঙ্গলেও বিকল হয়নি। নির্দিষ্ট কোনো কারণেই কেউ ঘড়ির কাঁটা দুটো স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মাদাম রেনাল্ড ব্যাপারটা জানতেন বলেই আমার বিশ্বাস।
-সেই কারণটা কি হতে পারে?
–তা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাচ্ছি। মারলিনভিল স্টেশন থেকে শেষ ট্রেনটা রাত বারোটা সতেরোয় ছেড়ে যায়–একথাই আমি ভাবছি।
–বুঝতে পারছি, বললাম আমি, তুমি বলতে চাইছ, সেই ট্রেনে কেউ চলে গেছে আর ঘড়ির দুঘণ্টা পরের সময়টাই তার অ্যালিবাই।
-তুমি ঠিক ধরেছ হেস্টিংস।
–তাহলে তো স্টেশনে খোঁজ নিলেই জানা যাবে দুজন বিদেশীকে কেউ ট্রেনে উঠতে দেখেছে কিনা।
পোয়ারো আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলতে লাগল, তোমাকে আগেও বলেছি এ অপরাধের পদ্ধতি আমার পরিচিত। এই ঘটনার সঙ্গে আগের একটি ঘটনার এমনই মিল যে আমার অনুমান দুটি ঘটনার পেছনে একই মস্তিষ্ক কাজ করেছে। অথবা এমন হতে পারে, অপরাধের পূর্ব স্মৃতি মনে জেগে ওঠায় খুনী দ্বিতীয় অপরাধটি করে বসে। অপরাধী কে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ–তবে ক্রমশ প্রকাশ্য।
–কিন্তু ডুবিনের সেই চিঠিটা–সঁসিয়ে রেনাল্ডের স্যান্টিয়াগোর জীবনের একটা গোপন তথ্যের পরিষ্কার আভাস পাওয়া যায়।
মূল ঘটনা থেকে সন্দেহ সরিয়ে দেবার ওটা একটা কৌশলমাত্র। হেস্টিংস, আমি নিশ্চিত, মঁসিয়ে রেনাল্ডের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চিঠিটা লেখা হয়েছে স্যান্টিয়াগো থেকে নয়, ফ্রান্স থেকেই।
-তাহলে মৃতদেহের পাশ থেকে পাওয়া সেই দেশলাই কাঠি আর পোড়া সিগারেটের টুকরো–ওগুলো সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কি?
–জিরয়েডের মতো গোয়েন্দাদের চোখে ফেলার জন্য ওগুলো ইচ্ছে করেই ফেলে রাখা হয়েছিল। আর মূর্খ জিরয়েড তা নিয়েই মেতে আছে।
–তাহলে মুখোশধারী লোকগুলো দৃশ্যপটে আসছে কেন?
–ওরা অস্তিত্বহীন–কল্পনা মাত্র।
–তাহলে আসল ঘটনা কি ছিল?
–সেকথা বলতে পারেন একমাত্র মাদাম রেনাল্ড। অথচ, কোনো অবস্থাতেই ওই মহিলার মুখ থেকে একটি কথা বার করা যাবে না, আমি জানি। একটি অস্বাভাবিক চরিত্র মাদাম রেনাল্ড স্বামীর মৃতদেহ দেখার পর নির্ভেজাল শোক প্রকাশ করতে দেখেছি তাকে। আমি নিশ্চিত হয়েছি তিনি খুনী নন।
কিন্তু তবু কেন তিনি একের পর এক মিথ্যা বলেছেন তার ব্যাখ্যা এখনো আমার কাছে নেই। সেই কব্জিঘড়ির ব্যাপারে তিনি মিথ্যা বলেছেন, সেই মুখোশধারী লোকদুটির ব্যাপারে, দরজা খোলা অবস্থায় ছিল তার ব্যাপারে তিনি সত্য কথা বলেননি।
যাইহোক, হেস্টিংস, এখনো আমাদের অনেক কিছু জানার বাকি রয়ে গেছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা আমার মাথায় খেলে গেল। বললাম, পোয়ারো, আমার মনে হয়, মাদাম রেনাল্ড কাউকে আড়াল করতে চাইছেন।
–আমারও তাই ধারণা, বলল পোয়ারো, অথবা কাউকে যাচাই করার উদ্দেশ্যে তিনি মুখে চাবি আটকে রেখেছেন।
কথা বলতে বলতে আমরা হোটেলে প্রবেশ করলাম।
.
০৭.
–তা এই সুন্দরী তরুণীটির নাম কি? কৌতুকতরল কণ্ঠে প্রশ্ন করল পোয়ারো।
খাবার টেবিলে বসে আজ সকালের ঘটনাটা শোনার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া তার।
অদূরদর্শী কাজটার জন্য আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়েছিলাম। পোয়ারো চিপটেন কাটতে ছাড়বে না তা-ও জানতাম। সৌভাগ্য যে অল্পেতেই রেহাই দিল এযাত্রা।
–তাহলে হোটেল ডি অ্যাঙ্গলেটরে সুন্দরীকে দেখতে তুমি যাচ্ছ?.
হোটেল ডি অ্যাঙ্গলেট নয়, ডু ফেরয়ে আছে ও।
–ওঃ হাঁ, আমিই গুলিয়ে ফেলেছিলাম।
আহার পর্ব শেষ করে কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে পোয়ারো বলল, আমাকে এখুনি স্টেশনে ছুটতে হবে। প্যারিসের ট্রেন ছাড়বে দুটো পঁচিশে।
–তুমি এখন প্যারিস যাচ্ছ? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি, কি ব্যাপার বলতো?
–মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনীর সন্ধানে। সবই তুমি জানতে পারবে, একটু ধৈর্য ধরো। কালই ফিরে আসছি। তুমি মঁসিয়ে রেনাল্ডের বাড়ির লোকজনের ওপর নজর রেখো।
–ওদের দুজনের কথা তুমি জানলে কি করে?
–দুয়ে দুয়ে চার হয়, এই হিসেবটা আমার জানা আছে বলে। তরুণ রেনাল্ডের মতো একজন যুবক মাদমোয়াজেল মাথার মতো সুন্দরীকে একজায়গায় রাখলে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কি দাঁড়াবে–প্রেম বিবাহ, তারপর কলহ। টাকা অথবা নারীঘটিত কোনো কারণে, ফলে ক্রোধ এবং নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?
আমি মেয়েটির চোখে উদ্বেগের ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। আর সেটাই আমাকে দিক নির্দেশ করেছে।
তার মানে তুমি বলতে চাও
মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল পোয়ারো।
.
একা একা সমুদ্রতীরে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম। তারপর একসময় হোটেল ডু ফেরয়ে এসে উপস্থিত হলাম। সিনডেরেলার পুরো নাম তো জানা নেই। কি নামে তাকে খোঁজ করব?
লাউঞ্জে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম যদি দেখা হয়ে যায়। পরে দরোয়ানের হাতে কিছু টিপস দিয়ে বললাম, একজন ইংরেজ মহিলা থাকেন, সুন্দরী যুবতী, তার নাম জানি না–তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।
লোকটি হেসে জানালো, ওইরকম কাউকে সে এখানে দেখেনি। আরো জানালো, বেঁটেখাটো চেহারার গোঁফওয়ালা, সবুজ চোখ এক ভদ্রলোকও ওই রকম বর্ণনার একটি মহিলার খোঁজ করতে এসেছিলেন।
সন্দেহ হল, আমাকে গোপন করে পোয়ারোই এসেছিল। সেই কারণেই আমাকে সে স্টেশনে তার সঙ্গী করতে চায়নি।
পোয়ারোর উদ্দেশ্যটা ঠিক বোধগম্য হল না। ওর সব কাজ আমি ধরতে পারি না।
–নিজেকে সে সবসময়ই রহস্যের মোড়কে গোপন রাখতে পছন্দ করে।
কিন্তু সিনডেরেলা কি আমাকে ভুল ঠিকানা দিল? নাকি হোটেলের নাম বলতে ভুল করেছে? অথবা সে আমার বন্ধুত্ব চাইছে না?
এমনি নানা কথা ভেবে মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠল।
হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিলা জেনেভিয়েভের দিকে চললাম। ভিলার কাছাকাছি এসে পথের ধারে ঝোপের পাশে একটা বেঞ্চিতে বসলাম।
কিছুক্ষণ পরেই খুব কাছে ভিলা মারগুয়েরিটের বাগান থেকে পরিচিত নারীকণ্ঠ ভেসে এল। চিনতে পারলাম–মার্থা ডওব্রেয়ুইল।
একজন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পুরুষ সঙ্গীটি জ্যাক রেনাল্ড।
–তাহলে বলছ, আর কোনো বাধা নেই, বলল মার্থা।
–প্রিয়তমা, তুমি কি বুঝতে পারছ না? আমাদের মিলতে বাধা দেবার আর কেউ নেই।
–ওঃ জ্যাক–কিন্তু আমার বড় ভয় করছে যে
পাতার আড়াল থেকে নজরে পড়ল–ওরা দুজন আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় পরস্পরকে নিরীক্ষণ করছে।
–আর কেন মিছে ভয় প্রিয়তমা?
–ভয় আমার তোমার জন্যে প্রিয়
থেমে থেমে আবেগজড়িত কণ্ঠে উচ্চারণ করল মার্থা।
আর কিছু শোনা সম্ভব হল না। একজোড়া পায়ের শব্দ কানে এলো। আমি সেখান থেকে সরে এলাম।
অপ্রত্যাশিতভাবেই দেখা পেয়ে গেলাম জিরয়েডের।
–আপনি এখানে? বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম।
-আপনি যে কারণে, জিরয়েড বলল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। তা আপনার সেই প্রাচীন বন্ধুটি কোথায়? প্যারিসে খুনীর সন্ধানে নাকি? শ্লেষ মিশ্রিত স্বরে বলল জিরয়েড।
কথা শেষ করে পেছন ফিরে চলে গেল সে। আমিও হাজারো জট মাথায় নিয়ে হোটলে ফিরে এলাম।
.
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলেই সাংঘাতিক খবরটা পেলাম। ভিলা জেনেভিয়েভে আর একটা খুন হয়েছে। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে দুঃসংবাদটা।
ব্রেকফাস্ট শেষ করা হল না। তখনই ছুটতে হল ভিলার দিকে।
পোয়ারো এখানে নেই। এর মধ্যে কে খুন হয়ে গেল? আমাকে ও বলে গিয়েছিল ভিলার লোকজনের ওপর নজর রাখতে।
গেট খুলে ভেতরে ঢুকেই চাকরবাকরদের জটলা চোখে পড়ল। ফাঙ্কেইসকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি শুনছি এসব?
-হ্যাঁ মঁসিয়ে। সাংঘাতিক ব্যাপার, ফ্রাঙ্কেইস হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগল, আর একজন খুন হয়েছে।
-কে খুন হলো?
–তা বলতে পারব না মঁসিয়ে। অজানা একজন লোককে শেডের মধ্যে পাওয়া গেছে। মঁসিয়ের মৃতদেহের মাত্র একশোগজ দূরে। বুকে ছুরি বিধিয়ে মারা হয়েছে।
.
০৮.
দ্রুতপদক্ষেপে শেডে চলে এলাম। প্রবল উত্তেজনায় বুক কাঁপছে আমার।
পকেট টর্চ জ্বেলে মেঝের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলাম।
মঁসিয়ে জিরয়েড এককোণে টর্চের আলো ফেলল। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সটান পড়ে আছে মৃতদেহ।
মাঝারি উচ্চতার মাঝবয়সী মানুষ, গায়ের রঙ ময়লা। পরনে নীল রঙের দামি কিন্তু পুরনো স্যুট। মুখে আতঙ্কের ছাপ।
বুকের ডানদিকে যে ছুরিটা বিদ্ধ হয়ে আছে–দেখে আগের দিনের খোয়া যাওয়া ছুরিটার কথা আমার মনে পড়ে গেল।
–উনি ফিরলেন?
ঠাট্টার সুরে জানতে চাইল জিরয়েড।
আমি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কখন খুন হল?
–ডাক্তারের অভিমত আমি জানি না। আমার বিশ্বাস অন্তত বারো ঘন্টা আগে মৃত্যু হয়েছে। আপনি ছুরিটা কখন শেষ দেখেছিলেন?
গতকাল সকাল দশটা হবে।
–সকাল দশটা। তাহলে খুনটা খুব একটা পরে হয়নি।
–কিন্তু এই শেডের ভেতরে
–চমৎকার! মৃতদেহ তাহলে কি পর্যবেক্ষণ করলেন? এই আপনার গোয়েন্দাগিরি? পা-দুটো কেমন জড়ো করা দেখেছেন? হৃদপিণ্ডে ছুরিকাঘাত হলে কেউ এভাবে পড়ে থাকে না। আর হাত দুটোও কেমন দুপাশে ছড়িয়ে আছে–এসব অস্বাভাবিক নয়? আর ওই দিকে তাকিয়ে দেখুন
জিরয়েড শেডের কোণায় টর্চের আলো ফেলল। একরাশ ধুলো পড়ে আছে মেঝের ওপর। দেখেই বোঝা যায় লোকটাকে বাইরে থেকে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে।
ছুরিকাঘাতের পরে নিয়ে আসা হয়েছে–দুজন লোক—
হ্যাঁ, বলল জিরয়েড, একজন স্ত্রীলোক। পায়ের ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা হলেও দু-একটা জুতোর ছাপ রয়ে গেছে।
মৃতদেহে বিদ্ধ ছুরির গা থেকে মেয়েদের একটা লম্বা চুল টেনে তুলে আবার বলল–এটাও সেকথা বলে।
মনে পড়ল, ঠিক এরকম একটা চুল পোয়ারো পড়ার ঘরের চেয়ারে পিঠ থেকে সংগ্রহ করেছিল।
লোকটার হাতের নখগুলোর দিকে তাকিয়ে কি মনে হয়? বলল জিরয়েড।
স্বীকার করতে হল নজর আছে বটে তার। কেন না মৃতলোকটির হাতের নখগুলো ভাঙ্গা এবং বিবর্ণ চামড়াও রুক্ষ।
-ওই হাত কোনো ভদ্রলোকের হাত হতে পারে না, বলে চলল জিরয়েড, অথচ গায়ে দেখুন দামী সুট। বিসদৃশ নয়?
–খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। আমি বললাম।
–পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, লোকটা পরিচয় গোপন করে এসেছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য কি? এব্যাপারে এখনো কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তবে সে যে নিজের পরিচয় গোপন করতে চেয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আরো মজা হল, এবারেও খুনী আগের মতই হাতে গ্লাভস পরে কোনো রকম ক্লু না রেখেই কাজ সমাধা করেছে।
–দুটি খুন একই ব্যক্তির বলে আপনি সন্দেহ করছেন? জানতে চাইলাম আমি।
–আমার ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, আমরা এবার মারকয়ডের সঙ্গে দেখা করব। বলতে বলতেই দরজার সামনে ডি. ভিলা মারকয়ডকে দেখা গেল। জিরয়েড তাকে বলল, মাদাম রেনাল্ডকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য। একটু পরেই সে মাদামকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো।
টর্চের আলো ধরে মৃতদেহের কাছাকাছি নিয়ে এলো জিরয়েড তাকে।
-এই যে দেখুন মাদাম, লোকটাকে চিনতে পারছেন আপনি?
মৃতদেহ দেখে কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পেল না মাদাম রেনাল্ডের মুখে। নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, এই লোককে জীবনে কখনো দেখিনি–বহিরাগত।
–সে-রাতে যে দুজন লোক আপনাকে আক্রমণ করেছিল, এই লোকটি কি তাদের মধ্যে ছিল? ভালো করে দেখে বলুন।
-না, মঁসিয়ে, আমি নিশ্চিত, এই লোক তাদের মধ্যে ছিল না।
–বেশ, ধন্যবাদ, মাদাম।
মাদাম রেনাল্ডের পর জ্যাক রেনাল্ডকে ডেকে দেখানো হল। সে-ও মৃতদেহ সনাক্ত করতে পারল না।
মাদাম ডওব্রেইল এলেন তার পরে। তিনি তো রেগে খাপ্পা।
–এসব কি ছেলেখেলা হচ্ছে মঁসিয়ে। খুনের ঘটনার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
–ধৈর্য হারাবেন না মাদাম, কর্কশ শোনাল জিরয়েডে স্বর, তদন্তে আমি যা জেনেছি…তা হলো দুটো খুনই আপনি করেছেন।
–আপনি আমাকে অপমান করছেন, চিৎকার করে উঠলেন ডওব্রেয়ুইল, এ অত্যন্ত অন্যায়।
ছুরির হাতল থেকে কালো লম্বা চুলটা এবারে টেনে তুলল জিরয়েড।
-এটা নিশ্চয়ই চিনতে ভুল করবেন না। মাদাম, সুযোগ পেলে এটা আপনার কিনা আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারব।
–এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি কোনো অপরাধের বিষয়েই কিছু জানি না। তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলেন মাদাম ডওব্রেয়ুইল।
–অপরাধের বিষয়ে আপনাকে এখনো কেউ অভিযুক্ত করেনি মাদাম। আপনি এবারে শান্ত হয়ে আমার কথার জবাব দিন। মৃত লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখুন তো তাকে চিনতে পারেন কি না?
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকালেন ডওব্রেয়ুইল। জিরয়েডের দিকে চোখ তুলে সহজকণ্ঠে বললেন, না, একে কখনো দেখিনি।
যথেষ্ট ধন্যবাদ।
মাদাম ডওব্রেয়ুইল দ্রুতপদে প্রস্থান করলেন।
আমাকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে জিরয়েড বলে উঠল, আপাততঃ মহিলাকে গ্রেপ্তার না করে নজরে রাখাই আমার ইচ্ছা। লোকটাকে কি মনে হয় আপনার, স্প্যানিশ?
–না, ফরাসি বলেই মনে হচ্ছে। জবাব দিলাম আমি।
এই সময় বাইরে অনেক মানুষের গলা পাওয়া গেল। একে একে ঘরে ঢুকলেন ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে হয়টেট, তার কেরানী এবং কমিশনার মঁসিয়ে রেক্স।
-আমরা কেসের গভীরে যেতে পারিনি মঁসিয়ে জিরয়েড, তা না হলে দ্বিতীয় খুনের আভাস পাওয়া যেত। লোকটিকে সনাক্ত করা গেছে? বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।
–কেউ চিনতে পারেনি, জিরয়েড বলল, আপনারা একবার দেখুন।
সকলে ঘরের কোণে গিয়ে মৃতদেহের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন।
গতকালের চুরি যাওয়া ছুরিটাই লোকটির বুকে বিদ্ধ করা হয়েছে। খুনী কোনো হাতের ছাপ রেখে যায়নি, বলল জিরয়েড, খুবই রহস্যময় কেস
ডাঃ ডুরান্ড মৃতদেহ পরীক্ষা করতে থাকেন। সকলের দৃষ্টি তার দিকে। ডাঃ সরে এসে জানালেন, আমি নিশ্চিত, লোকটি কম করেও আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে মারা গেছে।
জিরয়েডের চোয়াল ঝুলে পড়ল। আমরা সকলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে রইলাম।
.
০৯.
আমরা বিস্ময়ে স্তব্ধ হতবাক হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ডাক্তারের কথায় গোটা ব্যাপারটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠল।
ছুরিটা চুরি গেছে চব্বিশ ঘণ্টা আগে, তাহলে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে সেই ছুরি লোকটির বুকে বিদ্ধ হয় কি করে? বিস্ময়কর এই ব্যাপারটা যখন সকলকে চিন্তাক্লিষ্ট করে তুলেছে, সেই সময় পোয়ারোর তারবার্তা হোটেলের লোক আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল।
পোয়ারো জানিয়েছে বারোটা আঠাশে মারলিনভিল স্টেশনে পৌঁছচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি স্টেশনের দিকে রওনা হলাম।
স্টেশনে পৌঁছে জানা গেল ট্রেন লেটে আসছে। খানিকটা সময় হাতে পেয়ে স্টেশনের কয়েকজন পোর্টারের সঙ্গে কথা বললাম। দুর্ঘটনার রাত্রে শেষ ট্রেনে স্টেশন ছাড়তে কোনো যাত্রীকে তারা দেখেছে কিনা জানতে চাইলাম।
পোর্টারদের প্রধান জানাল, সে-রাতে শেষ ট্রেনে জনাকুড়ি যাত্রী মারলিনভিল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিল। তাদের মধ্যে দুজন বিদেশীও ছিল।
খবরটা পেয়েও ঠিক স্বস্তি পেলাম না। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তরুণ মঁসিয়ে রেনাল্ড সে-রাতে ট্রেন ধরতে পেরেছিলেন তো?
–সেকি বলছেন সিয়ে? সেই দিনই মাত্র আধঘন্টা আগে তিনি পৌঁছেছেন, তারপর আর শেষ ট্রেন ধরা যায় কখনো?
-ওহো, দুর্ঘটনার রাত্রেই তাহলে জ্যাক রেনাল্ড মারলিনভিলেয় পৌঁছেছিলেন?
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে। অন্য পথের শেষ ট্রেনটা পৌঁছেছিল এগারোটা চল্লিশে।
এই সংবাদে একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। দুর্ঘটনার রাতে জ্যাক রেনাল্ড মারলিনভিলেয় ছিল, সেই কারণেই তাকে নিয়ে মার্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
কিন্তু জ্যাক একথা স্বীকার না করে চেরবুর্গে থাকার কথা আমাদের বলেছিল কেন? কিন্তু এই খুনের ঘটনার সঙ্গে তার কোনো যোগ আছে, এমন কথাও ভাবা যাচ্ছে না।
মার্থা জ্যাকের জন্য উদ্বিগ্ন, কাউকে সন্দেহ করা হচ্ছে কিনা পোয়ারোকে ডেকে ও জানতে চেয়েছিল…তার মানে বোঝা যাচ্ছে, সব ঘটনার কথাই মার্থা জানে। তা না হলে এমন উদ্বিগ্ন কেন হবে?
একটু পরেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। চিন্তাভারাক্রান্ত মাথা নিয়েই পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানালাম।
ট্রেন থেকে নেমে আমার প্রশ্ন করার আগেই পোয়ারো বলল, আমার অভিযান সম্পূর্ণ সফল হেস্টিংস।
–নিঃসন্দেহে আনন্দ সংবাদ। এদিককার খবর যে
আমাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, কি জিরয়েড কাউকে গ্রেপ্তার করেছে? লোকটা যে একটা গণ্ডমূর্খ আমি প্রমাণ করে ছাড়ব।
-শোন পোয়ারো, খুব খারাপ খবর। ভিলায় আর একটা খুন হয়েছে। আমাদের সেখানে যেতে হবে।
পোয়ারোর চোখ নিষ্প্রভ হয়ে গেল। চোয়াল ঝুলে পড়ল। বিহ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
–আর একটা খুন, বিড়বিড় করে বলল পোয়ারো, আমার সব ধারণাই কি তবে ভুল হল…হ্যাঁ, অসম্ভব নয় যদি…আচ্ছা হেস্টিংস, নিহত লোকটি কি মাঝবয়সী? তালাবন্ধ শেডের ভেতরেই মৃতদেহটা পাওয়া গেছে?
আরো হতে পারে…আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে খুনটা হয়ে থাকতে পারে…তাকেও ছুরিবিদ্ধ করা হয়েছে…অবশ্য পিঠে না-ও হতে পারে…
আমি থ হয়ে পোয়ারোর অত্যদ্ভুত কথা শুনে গেলাম।
-তুমি তো দেখছি হুবহু বর্ণনা দিয়ে গেলে। নিশ্চয় আগে কিছু শুনে থাকবে। অবাক হয়ে বললাম আমি।
-না, বন্ধু, সে সুযোগ আমার ছিল না। সদ্য ট্রেন থেকে নেমেছি। সংবাদটা শুনে তাই প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
–তাহলে এতসব জানলে কি করে তুমি?
এবারে মদগর্বী পোয়ারো স্বরূপে ফিরে গেল। বলল, মস্তিষ্কের সেই ধূসর কোষগুলোর ক্রিয়া বন্ধু, আর কিছু না। দ্বিতীয় খুনের সম্ভাবনা তারাই আমাকে জানিয়েছিল। তাহলে চল আর দেরি করে কাজ নেই।
.
ভিলা জেনেভিয়েভের দিকে যেতে যেতে দ্বিতীয় খুনের ঘটনার কথা পোয়ারোকে জানালাম। সব শুনে সে বলল, কিন্তু বলছ একই ছুরি দিয়ে দুটো খুন হয়েছে?
-হ্যাঁ। ব্যাপারটা রহস্যময়। বললাম আমি।
–কিছুই রহস্যময় নয় ভায়া। দুটো ছুরি থাকা অসম্ভব নয়। জ্যাক রেনাল্ড ছুরিগুলো তৈরি করিয়ে একটা হয়তো নিজের ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছিল।
–কিন্তু সেকথা তো আগে বোঝা যায়নি।
–সবই কি আর বোঝা যায়, উপলব্ধি করে নিতে হয়।
.
শেডে ঢুকে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে পোয়ারোর সর্বপ্রথম নজরে পড়ল পোশাকের দিকে।
-একি, কোট ট্রাউজার-সবই দেখছি বাগানের মালির ব্যবহার করা—
ঠিকই ধরেছেন।
পাশ থেকে জিরয়েড বলে উঠল।
মৃতদেহের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে পর্যবেক্ষণ করল পোয়ারো।
-নখগুলো লক্ষ্য করেছেন। বলল পোয়ারো।
–হ্যাঁ। চোখে পড়েছে সবই। বলল জিরয়েড।
–ডাঃ ডুরান্ড। কঠিন মুখে ডাকল পোয়ারো।
সাড়া দিয়ে এগিয়ে গেলেন ডাক্তার।
-মৃতব্যক্তির মুখে গাঁজলা লক্ষ্য করেছেন?
ডাক্তার স্বীকার করলেন তিনি লক্ষ্য করেননি।
–তাহলে এবারে দেখে কি মনে হচ্ছে? উঁহুমৃত্যু ছুরির আঘাতে হয়নি। পোশাকেও রক্তের দাগ নেই
ছুরির ফলাটাও সামান্য বেঁধানো—
হ্যাঁ, মঁসিয়ে খুবই অস্বাভাবিক।
-না, মঁসিয়ে ডুরান্ড, অস্বাভাবিক মোটেও নয়। লোকটিকে মৃত্যুর পরে ছুরি মারা হয়েছে
–আমার সঙ্গে নিশ্চয় আপনি একমত হবেন?
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে আমি একমত।
-মৃত্যুর পরে ছুরি বেঁধানো–এ তো অদ্ভুত ব্যাপার, বলে উঠলেন মঁসিয়ে হয়টেট, এমন ঘটনা তো আগে শোনা যায়নি।
–খুবই ঠান্ডা মাথার কাজ বোঝা যাচ্ছে। পুলিসকে বিভ্রান্ত করার পরিকল্পনা।
–তাহলে এই লোকটা খুন হল কি করে? চিন্তিতভাবে জানতে চাইলেন কমিশনার।
-খুন নয় মঁসিয়ে। যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তাহলে বলব, লোকটা মৃগীরোগে মারা গেছে।
সকলের মুখেই বিস্ময়সূচক শব্দ ধ্বনিত হল। ডাঃ ডুরান্ড এগিয়ে গিয়ে আবার মৃতদেহ পরীক্ষা করেন।
পরে সরে এসে পোয়ারোকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, আপনার অনুমানই ঠিক সঁসিয়ে পোয়ারো। ছুরিকাঘাতের কথাটা মাথায় ছিল বলে মৃত্যুর অন্য লক্ষণগুলো আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি।
পোয়ারো সগর্বে মাথা উঁচিয়ে উপস্থিত সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল। তার চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ সকলেরই চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।
জিরয়েড এগিয়ে এলো। সংযত কণ্ঠে বলল, আর একটা বিষয় মঁসিয়ে, এই কাল লম্বা চুলটা ছুরির বাঁটে পাওয়া গেছে–কোনো মহিলার চুল।
-ওহ, মহিলার চুল, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল পোয়ারো-ভাবনার বিষয়ই বটে।
আর কোনো কথা না বলে শেড থেকে বেরিয়ে এলো পোয়ারো। হোটেলের দিকে রওনা হলাম আমরা।
-বুঝলে হেস্টিংস, জিরয়েড লোকটা মহা তাঁদড়। একটি মহিলার চুল তুলে ধরে আমাকে ভুল পথে নিয়ে যাবার তাল করছিল।
.
মধ্যাহ্ন ভোজের পরে দুজনে বসার ঘরে আরাম করে বসেছি। হোটেলে ফিরে আসার পর থেকে নিজের মনেই ডুবে আছে পোয়ারো। অথচ ওর প্যারিস ভ্রমণের খবর শোনার জন্য আমি ছটফট করছিলাম। এবারে সে প্রসঙ্গ না তুলে আর পারা গেল না।
পোয়ারো নড়েচড়ে বসল। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল।
–আমার হঠাৎ করে প্যারিসে চলে যাওয়াটা তোমার কাছে রহস্যময় হয়ে আছে বুঝতে পারছি। কিন্তু নিজে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে কিছু বলার উপায়ও ছিল না।
প্যারিস কেন গিয়েছিলাম জান? এই যে–এটার জন্য
পকেট থেকে একটা ছোট খাম বার করে আনল পোয়ারো। খামের মুখ খুলে ভেতর থেকে খবর কাগজের রঙচটা একটা কাটিং বার করে আমার হাতে তুলে দিল।
কাটিং-এ একটি মহিলার মুখের ছবি ছাপা ছিল। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, একি, এতো মাদাম ডওব্রেয়ুইল।
মৃদু হেসে মাথা নাড়ল পোয়ারো।
বেরোণ্ডি কেসের কথা আমার মুখে হয়তো শুনে থাকবে। ইনিই হলেন সেই কুখ্যাত মাদাম বেরোণ্ডি। সেই দিনগুলোতে এই ছবির মহিলা এই নামেই পরিচিত ছিলেন। এই কেসের সুবাদে বেরোণ্ডি কেস এখন আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়ে গেল।
এরপর বেরোণ্ডি মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ শোনা গেল পোয়ারোর কাছ থেকে।
বেরোণ্ডি কেস
বছর কুড়ি আগে লায়ন্স থেকে মঁসিয়ে বেরোণ্ডি তার সুন্দরী স্ত্রী এবং ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে প্যারিসে এসেছিলেন। ছোট একটি মদ তৈরির প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে তার রোজগার যা ছিল তাতে আধুনিক ফ্যাসানের বিলাসী জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ভালোভাবেই উপভোগ করতে পারছিল পরিবারটি।
মঁসিয়ে বেরোণ্ডির সুন্দরী স্ত্রী অল্পসময়ের মধ্যেই সমাজের উঁচু হলে রোমান্সের ক্ষেত্রে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করল।
ইতিমধ্যে তার জন্মকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর কিছু গুজবও ছড়িয়ে পড়ল। শোনা যায়, একজন রাশিয়ান গ্র্যান্ড ডিউকের অবৈধ কন্যা মাদাম বেরোণ্ডি।
অনেকে এমনও অনুমান করল, কোনো অস্ট্রিয়ান আর্ক-ডিউক তার জন্মদাতা-বাবা–মায়ের অবৈধ মিলনে তার জন্ম।
অসাধারণ রূপ-লাবণ্য, লাস্য এবং জন্ম ইতিহাসের রহস্য সব মিলিয়ে এক তীব্র আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন তিনি।
এক তরুণ উকিল জর্জের্স কনিউ জেনির প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগল। মাঝবয়সী স্বামীর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেই জেনিও প্রেমের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছিল।
প্যারিসে মাস তিনেক সময়ের মধ্যে জনৈক আমেরিকান মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপও রীতিমত ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে বেরোণ্ডি পরিবারের সঙ্গে।
এমনি যখন অবস্থা, সেই সময় একদিন মাদাম বেরোণ্ডি তার বন্ধুমহলে বলাবলি শুরু করলেন, তিনি স্বামীর জন্য খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ তাঁর স্বামীর হেফাজতে কতকগুলি গোপন রাজনৈতিক কাগজপত্র সে দেখেছে। সেসব নথিতে প্যারিসের কিছু উগ্রপন্থী সদস্যের নাম সে চিনতে পেরেছে। এই নামগুলোই তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। যে কোনো সময় যা কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা।
দিন কয়েক পরেই মাদাম বেরোণ্ডির আশঙ্কা যথার্থ প্রমাণ হয়ে যায়।
সেদিন পরিবারের রাঁধুনী সকালে বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয়ে বিস্মিত হয়ে যায়। সাধারণতঃ মাদাম বেরোণ্ডিই তাকে দরজা খুলে দেন। সেদিন দরজা ছিল ভোলা। তাছাড়া শোবার ঘর থেকে একটা গোঙানির শব্দও তার কানে আসছিল।
অশুভ কিছুর আশঙ্কা করে সে শোবার ঘরে ছুটে যায়। দেখতে পায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাদাম বেরোণ্ডি ঘরের মেঝেয় পড়ে গোঙাচ্ছেন। অর্ধ-অচেতন অবস্থা তার।
বিছানার ওপর বুকে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় মঁসিয়ে বেরোণ্ডির রক্তাপ্লুত দেহ পড়েছিল।
মাদাম বেরোণ্ডি যে ঘটনা ব্যক্ত করেছিল তা হল, মাঝরাতে নিঃশ্বাসের কষ্ট হতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখতে পায়, কালো মুখোশপরা দুজন লোক তার মুখ চেপে ধরে দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলছে। সে যাতে চিৎকার করতে না পারে সেজন্য তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়।
মুখে মুখোশ আঁটা থাকা সত্ত্বেও মাদাম বেরোণ্ডি বুঝতে পারে, আততায়ী দুজন রাশিয়ান। তারা তার স্বামীর কাছে গোপন নথিপত্র দাবি করে। তিনি তাদের দাবি মানতে অস্বীকার করলে একজন তার বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দেয়।
তার পকেট থেকে চাবি বার করে নিয়ে তারা আলমারি খোলে। সব কাগজপত্র ওখানেই রাখা ছিল। সমস্ত কুড়িয়ে নিয়ে তারা চলে যায়।
বেরোণ্ডি পরিবারের ওপর আঘাতের এই ঘটনা সেই সময় খুবই আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু পুলিস অনেক অনুসন্ধান করেন মুখোশধারী লোকগুলোর কোনো সন্ধান করতে পারেনি।
জনসাধারণ যখন এই ঘটনা প্রায় ভুলতে বসেছে সেই সময় হঠাৎ একদিন স্বামীকে হত্যা করার অপরাধে মাদাম বেরোণ্ডিকে গ্রেপ্তার করল পুলিস।
যথারীতি মামলা আদালতে উঠল। তখনই রহস্যময়ী জেনি বেরোণ্ডির জীবনকাহিনী জনসাধারণ জানতে পারে। জনৈক ফল ব্যবসায়ীকে জেরা করে জানা যায় লায়ন্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম।
স্বামীকে হত্যা করার উদ্দেশ্য জানা গেল মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপকে জেরা করে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট চেষ্টা করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সে স্বীকার করতে বাধ্য হল, সে জেনিকে ভালোবাসত।
কিন্তু তাকে বিয়ে করার বাধা স্বরূপ ছিল তার মাঝবয়সী স্বামী মঁসিয়ে বেরোণ্ডি। জেনি তার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে ভেবেছিল ট্রাপ।
জেরার জবাবে জেনিও স্বীকার করেছিল, বিত্তবান আমেরিকানকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে সে মঁসিয়ে বেরোণ্ডির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
বিচার চলাকালে জেনি আদালতকে তার বানানো কাহিনী শুনিয়ে গেল। সে কাহিনী সম্পূর্ণ অবাস্তব হলেও অধিকাংশ লোকই তা বিশ্বাস করল। যদিও শেষ পর্যন্ত আদালত মাদাম বেরোণ্ডিকেই অভিযুক্ত করল। আদালতের রায় ছিল, মুখোশধারী দুজন রাশিয়ানই তার স্বামীকে খুন করেছিল। এই হত্যার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল মাদাম বেরোণ্ডিও তার প্রেমিক জর্জেস কনিউ।
কনিউকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি হল, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে প্যারিসে সরকারি উকিলের নামে ডাকে একটি চিঠি এলো। চিঠি লিখেছিল জর্জেস কনিউ–কিন্তু তাতে তার কোনো ঠিকানা দেওয়া ছিল না।
কনিউ তার চিঠিতে স্বীকার করল, সে মাদাম বেরোণ্ডিকে ভালোবাসতো। তার পরামর্শ মতোই সে মঁসিয়ে বেরোণ্ডিকে হত্যা করেছিল।
মাদাম বেরোণ্ডি তাকে বুঝিয়েছিল, স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতনে সে অতিষ্ঠ। তার কবল থেকে মুক্ত হতে পারলে কনিউকে বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব হবে।
কনিউ পরে জানতে পেরেছিল, তাকে বিয়ে করার জন্য নয়, বিত্তবান আমেরিকান মিঃ হিরাম. পি. ট্রাপকে বিয়ে করার মতলবেই কনিউকে দিয়ে সে তার স্বামীকে হত্যা করিয়েছিল। জেনি আসলে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
এই চিঠির জবাবে মাদাম বেরোণ্ডি আদালতে তার নির্দোষিতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে স্পষ্টই স্বীকার করল, যদিও আদালত দুই রাশিয়ানকে তার স্বামীর হত্যাকারী বলে রায় দিয়েছে, আসলে রাশিয়ানদের কাহিনী ছিল তার মনগড়া। জর্জেস কনিউ পাছে তার স্বামীর মতো তাকেও হত্যা করে সেই ভয়ে সে আগে আদালতে তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি। তবে স্বামীকে হত্যা করার জন্য তার প্ররোচনার কথা জর্জেস তার চিঠিতে যা উল্লেখ করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এরকম কোনো বোঝাঁপড়া জর্জেসের সঙ্গে তার হয়নি।
যে তার প্রিয় স্বামীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, তাকে বিয়ে করার কথা সে কখনোই ভাবতে পারে না।
মাদাম বেরোণ্ডি কান্নাজুড়ানো গলায় এমন আবগেপূর্ণ ভঙ্গীতে তার কাহিনী ব্যক্ত করেছিল যে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও জুরিরা তা মেনে নিয়েছিল।
গভীর আবেগের সঙ্গে সে আরো বলে যে স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে আদালতে প্রথমে জর্জেসের নাম না করার জন্য সে তার অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছে।
তবে সে তার স্বামীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তাকে খুন করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সে আদালতে সত্য গোপন করার জন্য অপরাধী সত্য কথা; স্বামীর খুনের জন্য সে কখনোই দায়ী নয়।
শেষ পর্যন্ত জুরিদের রায়ে মাদাম বেরোণ্ডি এই মামলায় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
জর্জেন্স কনিউকে গত কুড়ি বছরেও পুলিস আর বার করতে পারেনি। মাদাম বেরোণ্ডিও যে তার মেয়েকে নিয়ে কোথায় চলে যায় সেখবরও কেউ জানে না।
.
পোয়ারোর মুখে পুরনো বেরোণ্ডি মামলা শোনার পর বর্তমান কেসটা যেন অনেক স্বচ্ছ হয়ে এলো আমার কাছে। আমি অনেক কিছুই এখন দেখতে পাচ্ছি।
পোয়ারো বলল, এবার তাহলে বল তুমি কি কি দেখতে পাচ্ছ।
-মাদাম ডওব্রেয়ুইলই হল সেই মহিলা জেন বেরোণ্ডি, যে মঁসিয়ে রেনাল্ডকে হত্যা করছে। বললাম আমি।
-তাহলে তুমি বলতে চাইছ, মাদাম বেরোণ্ডিই তার স্বামীকে খুন করেছিল? আদালত তাকে ভুল করেই নির্দোষ ঘোষণা করেছিল?
-আমার মত তাই। কেন, তুমি তা মনে কর না?
–আমিও অবশ্য তোমার সঙ্গে একমত। তবে আইনের চুলচেরা হিসেবে ফেলতে গেলে মাদাম বেরোণ্ডিকে নির্দোষই বলা যায়।
–সেই অপরাধের ক্ষেত্রে হলেও হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে অন্ততঃ নয়।
–অর্থাৎ মাদাম ডওব্রেযুইলই মঁসিয়ে রেনাল্ডকে খুন করেছে। কিন্তু এই খুনের মোটিভ কি? এই ক্ষেত্রে কোনো দিক থেকেই তার লাভবান হবার সম্ভাবনা নেই। আগের কেসের ক্ষেত্রে যেমন ছিল, বিত্তবান প্রেমিক তাকে বিয়ে করার জন্য তার স্বামীর মৃত্যুর অপেক্ষা করেছিল।
-খুনের মোটিভ অর্থ ছাড়া অন্য কিছু কি হতে পারে না? বললাম আমি।
–হতে পারে। যেমন, গভীর আসক্তি বা ঈর্ষা। তাছাড়া মানসিক ভারসাম্য হারালেও খুনী এধরনের অপরাধ করতে পারে। অবশ্য মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে বলা যায় সম্পূর্ণ সুস্থ মহিলা।
–গভীর আসক্তি থেকেও এই অপরাধ সংগঠিত হতে পারে। যদি ধরে নেওয়া যায় মাদাম ডওব্রেয়ুইল ছিলেন মঁসিয়ে রেনাল্ডের রক্ষিতা, সেক্ষেত্রে তার প্রতি আকর্ষণ কমে আসছে অনুভব করলে প্রবল ঈর্ষা বা ক্রোধবশতঃ সঁসিয়ে রেনাল্ডকে সে খুন করতে পারে না?
হাসল পোয়ারো। বলল, মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে নিয়ে অনেক ভেবেছ তুমি বন্ধু, কিন্তু তার সম্পর্কে আমি বলব, তোমার ধারণা ভুল।
আগের কেসে তার ধীরস্থির বুদ্ধির পরিকল্পনার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। চমৎকার একজন অভিনেত্রীও সে। বিত্তবান আমেরিকানকে পাওয়ার জন্য সে স্বামীর খুনী সেই যুবকটির সঙ্গে নিজেকে জড়ায়নি।
নিজের লাভের কথা মাথায় রেখেই তাকে অপরাধ করতে দেখি আমরা। তাছাড়া, কবর খোঁড়া পুরুষের কাজ, তার পক্ষে তা সম্ভব নয়।
মাদাম রেনাল্ড আর মাদাম বেরোণ্ডি তথা ডওব্রেয়ুইলের জীবনধারা আপাত দৃষ্টিতে একই মনে হলেও এক্ষেত্রে দুজনের ভূমিকা ভিন্ন।
মাদাম ডওব্রেয়ুইল আগে যে কাহিনী শুনিয়েছিল সে কাহিনীরই যদি পুনরাবৃত্তি ঘটত, তাহলে মামলা অত্যন্ত সরল হয়ে যেত। এক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হয়েছে মাদাম রেনাল্ডের কার্যকলাপে।
তাহলে কি তুমি বলবে মঁসিয়ে রেনাল্ডের রক্ষিতার সঙ্গে দৌড়ে তিনিও ছিলেন একজন প্রতিযোগিনী?
-তা আমি মনে করি না। বললাম আমি; তাকে আমি এমন দক্ষ অভিনেত্রী বলে মনে করি না।
হেস্টিংস, তুমি এখানে যুক্তি হারিয়ে ফেলছে। অপরাধ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভাবাবেগের স্থান নেই, মনে রেখো। একজন অপরাধীর একজন দক্ষ অভিনেত্রী হতে বাধা নেই। কিন্তু তা অপরিহার্যও নয়।
স্বামীর মনোযোগ বা ভালোবাসা পাবার ক্ষেত্রে মাদাম রেনাল্ড প্রতিযোগিনী ছিলেন আমি মনে করি না। কারণগুলো তোমাকে আগেই বলেছি। সেই ছোট্ট ধূসর কোষগুলো নাড়াচাড়া করলে তুমি অনেক তথ্য পেয়ে যাবে।
–পোয়ারো, তুমি আর কি জেনেছ?
–যা যা জানবার জন্য মঁসিয়ে রেনাল্ড আমাকে ডেকে এনেছিলেন, সবই আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি।
খুনীকে তুমি জেনেছ?
–হ্যাঁ, একজন খুনীকে আমি জেনেছি। কিন্তু এখানে দুটো খুন। দ্বিতীয় খুনের ব্যাপারে আমি এখনো নিশ্চিত নই।
–কিন্তু তুমি বলেছিলে শেডের লোকটার মৃত্যু স্বাভাবিক।
–তুমি এখনো বুঝতে পারনি দেখছি, হেসে বলল পোয়ারো, খুন না করেও খুনের অপরাধ ঘটানো সম্ভব হয়, দুটি মৃতদেহ দুটি অপরাধের কথাই বলে।
কিছুই মাথায় ঢুকল না আমার। বিহ্বল ভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পোয়ারো।
–হ্যাঁ, ওই তো জ্যাক রেনাল্ড আসছেন। তাকে আমার বলা ছিল। বলল পোয়ারো।
–আশ্চর্য ঘটনা জানো, বললাম আমি, জ্যাক রেনাল্ড, ঘটনার দিন রাত্রে মারলিনভিলেতেই ছিলেন।
–আমি জানি। মাথা নেড়ে বলল পোয়ারো।
বুঝতে পারলাম, আমার আগেই পোয়ারো স্টেশনে খবর নিয়েছে। জিরয়েডও ব্যাপার জেনে থাকতে পারে।
এই সময় জ্যাক রেনাল্ড ঘরে প্রবেশ করল। সম্ভাষণ জানিয়ে পোয়ারো তাকে বসতে বলল।
–ভিলার পরিবেশ খুবই বিশৃঙ্খল হয়ে আছে বলে আপনাকে কষ্ট দিতে হল। তাছাড়া আমার আবিষ্কারের খবর আমি জিরয়েডের জানার বাইরেই রাখার পক্ষপাতি। আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন। বলল পোয়ারো।
–জিরয়েড লোকটিকে আমারও পছন্দ নয় মঁসিয়ে। খুবই সহানুভূতিহীন। বলল জ্যাক।
–আমাকে একটা সাহায্যের জন্য আপনাকে অনুরোধ করব মঁসিয়ে। পরবর্তী স্টেশনই হল আবালা, এখুনি একবার সেখানে গিয়ে ক্লোকরুমে খবর নিয়ে জেনে আসতে হবে ঘটনার দিন রাত্রে দুজন বিদেশী কোনো ব্যাগ জমা রেখেছিল কিনা। দয়া করে এই উপকারটুকু আপনি করুন।
নিশ্চয়ই করব, মঁসিয়ে, আমি এখুনি যাচ্ছি।
–মিনিট পনেরোর মধ্যেই ট্রেন পেয়ে যাবেন।
জিরয়েড আপনার গতিবিধি জানতে না পারলেই ভালো।
–খুব ভালো কথা। আমি তাহলে যাচ্ছি—
জ্যাক রেনাল্ড উঠে দাঁড়ালে, পোয়ারো তাকে বসতে ইঙ্গিত করল।
–এক মিনিট মঁসিয়ে রেনাল্ড, দুর্ঘটনার রাত্রে আপনি যে মারলিনভিলে উপস্থিত ছিলেন, আজ সকালে মঁসিয়ে হয়টেটকে তা না জানিয়ে ভুল করেছেন।
–কিন্তু আমি তো চেরবুর্গেই ছিলাম মঁসিয়ে পোয়ারো। সামান্য ইতস্ততঃ করে বলল সে।
স্টেশনের লোকেরা তাহলে আমাকে ভুল সংবাদ দিয়ে থাকবে। তারা বলেছে, সেদিন রাতে এগারোটা চল্লিশে আপনি পৌঁছেছেন।
–সে-রাতে যদি ফিরেও থাকি, তাতে কি?
–ফিরে আসার কারণটা জানাবেন?
–এর মধ্যে লুকোছাপার কিছু নেই। আমার প্রেমিকা মাদমোয়াজেল ডওব্রেয়ুইলকে আশ্বস্ত করা দরকার মনে হয়েছিল, কোনো না কবে ফিরতে পারব তা আমার জানা ছিল না।
-তারপরই ফিরে এসে ট্রেন ধরেছিলেন আপনি?
–না, শেষ ট্রেন ধরার সময় ছিল না। আমি হেঁটে সেন্ট বিউভেসে গিয়ে গ্যারেজ থেকে একটা গাড়ি নিয়ে চেরবুর্গে চলে যাই।
–বুঝতে পেরেছি, আচ্ছা আপনি রওনা হয়ে যান।
জ্যাক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পোয়ারো লাফিয়ে উঠে বলল, চল হেস্টিংস, ভিলা জেনেভিয়েভে এখুনি যেতে হবে।
–একারণেই তুমি তাকে এখান থেকে সরিয়ে দিলে?
আমার দিকে তাকিয়ে সমর্থনসূচক হাসি হাসল পোয়ারো।
.
১০.
ভিলায় প্রবেশ না করে পোয়ারো সরাসরি শেডের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। আগের দিন ভিলা জেনেভিয়েভ এবং ভিলা মারগুয়েরিটের মধ্যবর্তী জায়গায় যে বেঞ্চিতে বসে জ্যাক রেনাল্ড ও মার্থাকে ঝোপের আড়ালে কথা বলতে দেখেছিলাম, সেখানে উপস্থিত হল।
-এখানেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে হেস্টিংস, বেঞ্চিতে বসে বলল পোয়ারো, মার্থাকে বাগানে দেখা পেয়ে যেতে পারি। আলোচনার দরকার
বলতে বলতেই দেখা গেল মাদমোয়াজেল মার্থা এদিকেই এগিয়ে আসছে। পোয়ারোর ডাক শুনে এগিয়ে এসে ঝোপের আড়ালে দাঁড়াল।
-আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই মাদমোয়াজেল। বলল পোয়ারো।
নিশ্চয়ই, মঁসিয়ে পোয়ারো।
সহজভাবে কথাটা বললেও তার চোখে প্রচ্ছন্ন উদ্বেগের ছায়া আমার চোখ এড়াল না।
–সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আপনি জানতে চেয়েছিলেন খুনের ব্যাপারে আমরা কাউকে সন্দেহ করি কিনা।
-হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন সন্দেহভাজন লোক দুজন—
কিন্তু এখন বলতে হলে আমি বলব দুজন নয়, একজন।
–কে-কে সে? সাগ্রহে জানতে চাইল মার্থা।
–মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ড।
–অসম্ভব। জেদের স্বরে বলে উঠল মার্থা, জ্যাককে কেউ সন্দেহ করতে পারে না।
–কিন্তু জিরয়েড তাই করে।
মার্থার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুষ্ক স্বরে সে বলল, জিরয়েড লোকটি অতি নিষ্ঠুর।
বলতে বলতে তার চেহারা পাল্টে গেল। যেন মুহূর্তের মধ্যেই জিরয়েডকে আক্রমণ করার সাহস সঞ্চয় করে নিয়েছে।
গভীর দৃষ্টিতে মেয়েটিকে নিরীক্ষণ করল পোয়ারো। বলল, ঘটনার রাত্রে জ্যাক এখানেই ছিল, আপনি জানেন?
–হ্যাঁ, মৃদুকণ্ঠে বলল মার্থা, সে আমাকে বলেছে।
–আজ সকালে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এ কথাটা স্বীকার না করা ঠিক কাজ হয়নি।
–গোপন না করে উপায় ছিল না। জিরয়েড় তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করত।
–কিন্তু এই ঘটনা তার বিরুদ্ধেই যাবে। আপনি নিশ্চয় তা বুঝতে পারছেন?
-সবরকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো মনোবল আমার আছে মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি জানি জ্যাক নির্দোষ। তাকে বাঁচানোর জন্য আমাদের চেষ্টার ত্রুটি হবে না।
হঠাৎ অন্তরঙ্গ সুরে সামান্য ঝুঁকে পোয়ারো বলে উঠল, মাদমোয়াজেল, একটা কথা আপনাকে আমি বলি, আপনি যা গোপন করতে চাইছেন, আমাকে তা খুলে জানালে আপনার অহিত কিছু হবে না।
অবাক চোখে পোয়ারোকে লক্ষ্য করল মেয়েটি।
–হ্যাঁ, বলার আছে মঁসিয়ে, কিন্তু আপনার কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হবে।
–তবু আপনি আমাদের বলুন।
–দ্বিতীয় মৃতদেহটা সনাক্ত করার জন্য জিরয়েড আমাকে শেডে ডেকেছিলেন। আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু শেড় থেকে বেরিয়ে আসার পরে আমার মনে পড়েছে ঘটনাটা। মঁসিয়ে রেনাল্ড যেদিন খুন হন সেদিন সকালে আমি বাগানে বেড়াবার সময় দুজন লোকের ঝগড়ার শব্দ শুনতে পাই। ঝোপের আড়াল থেকে আমার চোখে পড়ে মঁসিয়ে রেনাল্ড দাঁড়িয়ে আছেন আর অপর লোকটি ক্রুদ্ধস্বরে কথা বলছে। সে টাকা চাইছিল। কিন্তু তার পোশাক ভালো ছিল না। প্রবল রাগে ভীষণ হয়ে উঠেছিল সে।
-তারপর?
–ঠিক সেই সময়ই বাড়ির ভেতরে মা আমাকে ডাকতে থাকেন। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে যাই আমি। কিন্তু মঁসিয়ে, আমি নিশ্চিত, সেই লোকটিরই মৃতদেহ আমি শেডের ভেতরে দেখেছিলাম।
–কিন্তু একথা তো আপনি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাননি মাদমোয়াজেল?
–সেই মুহূর্তে আমি সন্দেহ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কেননা, শেডের মৃতদেহের গায়ে ছিল দামি পোশাক। দুজনের মুখ একরকম হলেও শেডের লোকটিকে আমার অভিজাত কেউ বলেই মনে হয়েছিল।
এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে মায়ের ডাক শুনে, আমি যাচ্ছি মঁসিয়ে বলে বাড়ির দিকে ছুটল মার্থা।
আমরা অতঃপর ভিলা জেনেভিয়েভের দিকে চলতে লাগলাম।
চলতে চলতে পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি যা বলল তা সত্যি বলে তুমি মনে করছ?
–আমার বিশ্বাস সে তার প্রেমিককে আড়াল করার উদ্দেশ্যে কোনো মিথ্যা গল্প শোনায়নি। আরও একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল। জ্যাক বলেছিল, মার্থা ডওব্রেযুইলকে আশ্বস্ত করবার জন্যই দুর্ঘটনার রাত্রে ফিরে এসেছিল। কথাটা যাচাই করার জন্যই তাকে সতর্ক করে দেবার সুযোগ না দিয়ে প্রকৃত সত্যটা আমি মেয়েটির কাছে জেনে নিলাম।
আমার প্রশ্নের উত্তরে মাথা কেবল বলল, সে আমাকে বলেছে, অর্থাৎ সে-রাতে জ্যাক এখানে ছিল একথা তার কাছে শুনেছে। হেস্টিংস, একটা ব্যাপার এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি, দুর্ঘটনার রাতে জ্যাক ফিরে এসে কি করেছিল, কার সঙ্গে দেখা করেছিল–এসব কিছুই আমি জানি না।
–কিন্তু জ্যাক তার বাবাকে খুন করেছে বলে আমার মনে হয় না।
আবার তুমি বাস্তব ছেড়ে ভাবপ্রবণ হয়ে পড়ছ হেস্টিংস। ছেলে বাপকে খুন করেছে। একথা তোমার বিশ্বাস করতে বাধছে, কিন্তু আমি দেখেছি জীবনবীমার মোটা টাকা পাওয়ার লোভে মা তার ছেলেমেয়েদের নিজ হাতে খুন করেছে। এমন ঘটনার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে, বল?
–কিন্তু জ্যাকের কিসের লোভ ছিল?
–সে জানত, বাবার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির অর্ধেক সে পাবে।
–তাহলে শেডের ভেতরে মৃত অবস্থায় যে লোকটিকে পাওয়া গেল সে কে?
–জ্যাকের হিসেব বলবে, লোকটা জ্যাকের সহযোগী ছিল।
–তা যদি হয়, ছুরির হাতলে মেয়েদের চুল পাওয়া যাবে কেন?
স্বভাবসুলভ অধৈর্যের সঙ্গে পোয়ারো বলে উঠল, সেটা আদৌ কোনো স্ত্রীলোকের চুল নাও হতে পারে। আজকাল অনেক যুবককেই মেয়েদের মতো চুল রাখতে দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে চুলটা কোনো মহিলারই। সে কে আমি জানি না।
পোয়ারোর বক্তব্যের উদ্দেশ্য আমি ধরতে পারছিলাম না। সে চেষ্টা না করে আমি অগত্যা জানতে চাইলাম, এখন আমরা চলেছি কেন?
–যে জন্য মঁসিয়ে জ্যাককে কয়েক ঘণ্টার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। তার ঘরটা খুঁজে দেখতে চাই।
.
অভ্যস্ত দ্রুততার সঙ্গেই পোয়ারো জ্যাক রেনাল্ডের ঘরের আলমারি, ড্রয়ার, কাগজপত্র সমস্ত কিছু আঁতিপাতি করে খুঁজল। যখন হাল ছেড়ে দিয়ে জায়গামতো সব রাখতে যাচ্ছে, তখনই একতাড়া কাগজের তলা থেকে বার করে আনল এটা ফটোগ্রাফ। সঙ্গে সঙ্গে সেটা পকেটে চালান করল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখতে পেলাম জিরয়েডের গাড়ি ভিলার সামনে এসে থামল। গাড়িতে বসে আছে জ্যাক রেনাল্ড।
দ্রুতপায়ে দুজনে নিচে এলাম।
–শুভ অপরাহু মঁসিয়ে জিরয়েড, স্বাভাবিক স্বরে বলল পোয়ারো, ব্যাপার কি?
চকিতে জ্যাক রেনাল্ডকে দেখে নিয়ে জিরয়েড বলল, ইনি জাল ছিঁড়ে পালাবার মতলব করেছিলেন। কিন্তু আমার শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে পারেননি। মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ডকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জ্যাক রেনাল্ডের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পোয়ারো সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
এব্যাপারে আপনার বক্তব্য –
কিছুই নয়।
দৃঢ়স্বরে বলল জ্যাক। সে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল পোয়ারার দিকে।
৩. ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়
১১.
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম আমি। জ্যাক রেনাল্ড তার বাবাকে খুন করেছে, মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না।
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, জ্যাক রেনাল্ডের সমর্থনে সহসা তাকে সওয়াল করতে দেখে।
জিরয়েডের কাছে পোয়ারো জানতে চাইল জ্যাককে গ্রেপ্তার করার যুক্তিগুলো কি কি?
কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থাতেই সৌজন্যের খাতিরে জিরয়েড আমাদের অন্য একটা ঘরে নিয়ে এলো। জ্যাক রেনাল্ড রইল দুজন রক্ষীর হেফাজতে।
-দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমাদের গোয়েন্দাদের কাজ যে কত আধুনিক আমার ব্যাখ্যা শুনলেই বুঝতে পারবেন।
–আমি শুনছি, আপনি বলে যান। ভাববেন না, আমি ঘুমিয়ে পড়ব না।
–প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি, দুজন বিদেশী লোকের কথাই আমি ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, তারা বিদেশী নয়।
খুবই প্রশংসনীয়, বলে উঠল পোয়ারো, আপনি সেই দেশলাই কাঠি আর পোড়া সিগারেটের চালাকিটা ভেদ করতে পেরেছেন।
জিরয়েড এক মুহূর্ত থমকাল। পরে বলতে লাগল, কবর খোঁড়ার ব্যাপারটা চিন্তা করলে বোঝা যায়, এমন একজন পুরুষই এই কেসে জড়িত, যার লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমি খবর নিয়ে জেনেছি জ্যাক রেনাল্ড আর তার বাবারমধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। খুনের মোটিভ এখানেই পাওয়া যাচ্ছে।
দ্বিতীয়তঃ খুনের রাতে জ্যাক রেনাল্ড মারলিনভিলেতেই ছিল। অথচ সে ঘুণাক্ষরেও আমাদের তা জানতে দেয়নি। এটা তার বিরুদ্ধে একটা বড় পয়েন্ট।
তারপর আসুন খুনের হাতিয়ারের কথায়। দেখা গেছে, দুটো খুনের ক্ষেত্রেই একই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ছুরিটা চুরি যাওয়াতেই আমরা ব্যাপার জানতে পেরেছি। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ছুরিটা চুরি যাওয়ার সঠিক সময়টা জানেন। এই চুরির ব্যাপারটাও একই ব্যক্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
–এতটা নিশ্চিত হওয়া কি ঠিক হচ্ছে, পোয়ারো বলে উঠল, ছুরিটা অন্য লোকও তো চুরি করতে পারে।
–আপনি নিশ্চয়ই মঁসিয়ে স্টোনারের কথা বলবেন। কিন্তু আমি ভালোভাবেই বাজিয়ে দেখেছি, এ কেসের সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন। স্টোনার এখানে এসে পৌঁছনোর একঘণ্টা পরে পৌঁছেছিলেন মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ড।
ভিলায় পৌঁছনোর মুখেই যে তিনি মঁসিয়ে হেস্টিংস ও তার সঙ্গিনীকে শেষ থেকে বেরতে দেখতে পান, এবিষয়ে আমি নিশ্চিত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। তারপর শেডের ভেতরে ঢুকে তার সঙ্গীকে ছুরিবিদ্ধ করেন।
–সঙ্গী মানে, আগেই যার মৃত্যু হয়েছিল? শ্লেষের সুরে বলল পোয়ারো।
–লোকটা যে মৃত সম্ভবতঃ তিনি বুঝতে পারেননি। ঘুমন্ত ভেবেই কাজটা সারতে চেয়েছেন তিনি।
একটু থেমে পোয়ারোর মুখে সগর্ব দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে জিরয়েড আবার বলতে লাগল, তাদের দুজনের যে এই জায়গাতেই মিলিত হবার কথা ছিল, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জ্যাক নিশ্চিত জানত, দ্বিতীয় খুনের ঘটনাটা মূল কেসে জটিলতার সৃষ্টি করবে। আর বাস্তবিক, হয়েছেও তাই।
–হ্যাঁ, মঁসিয়ে জিরয়েডের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। বলে উঠল পোয়ারো।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার কথাটাকে এত হাল্কা ভাবে না নিলেই বাধিত হব। আমার হাতে বাস্তব প্রমাণেরও অভাব নেই। আপনি জানেন, মাদাম রেনাল্ড আমাদের যে কাহিনী শুনিয়েছেন, তা আগাগোড়া কাল্পনিক। তিনি নিঃসন্দেহে তার স্বামীকে ভালোবাসতেন এবং স্বামীর হত্যাকারী কে তা-ও তিনি জানতেন। তবু কেন তিনি খুনীকে আড়াল করবার জন্য কল্পিত কাহিনীর অবতারণা করলেন?
তার কারণ, একটাই কারণ হল, প্রকৃত জননী তার সন্তানকে ভালোবাসেন। সন্তানকে বাঁচাবার জন্যই তার এই প্রয়াস।
মঁসিয়ে পোয়ারো, এর চাইতে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে, বলুন? আমার কেসের নিষ্পত্তি এখানেই। আশা করি আপনার বলার কিছু নেই।
–আমার মনে হয় মঁসিয়ে জিরয়েড, একটা ঘটনা আপনার ব্যাখ্যায় বাদ পড়ে গেছে। সেটা হল, জ্যাক রেনাল্ড জানতেন মৃতদেহ অনাবিষ্কৃত থাকবে না, এই অবস্থায় তিনি কবর খুঁড়বার চেষ্টা করলেন কেন?
জিরয়েড কেমন থতমত খেল, দেবার মতো কোনো উত্তরই তার ঝুলিতে ছিল না।
পোয়ারো ততক্ষণে উঠে দরজার দিকে এগিয়েছে, আমিও তাকে অনুসরণ করছি। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলল, আরও একটা বিষয় আপনি বিবেচনা করতে ভুলে গেছেন
–সেটা কি?
–সীসের সেই ছোট্ট নলটা।
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। জ্যাক রেনাল্ড একইভাবে হলে দাঁড়িয়ে ছিল। বোবা দৃষ্টি তুলে আমাদের দিকে তাকালো।
এই সময় মাদাম রেনাল্ডকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখা গেল। জ্যাককে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি আকুল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, জ্যাক, এসব কি শুনছি?
-মা, ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করেছে। শুষ্ক কণ্ঠে বলল জ্যাক।
–কি বললে—
বলতে বলতে সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তাকে ভোলার জন্য আমরা দুজনই ছুটে গেলাম। চেঁচামেচি শুনে ডেনিস আর ফ্রাঙ্কেইসও ছুটে এলো। মনিবপত্নীর যত্ন নেবার ভার তাদের দুজনের ওপর দিয়ে পোয়ারো আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
জিরয়েড অবশ্য রয়ে গেল মাদাম রেনাল্ডের জবানবন্দী নেওয়ার জন্য।
পাশাপাশি চলতে চলতে আমি জানতে চাইলাম, জ্যাকের বিরুদ্ধে অনেক পয়েন্ট দাঁড় করিয়েছে জিরয়েড–তুমিও তাকে অপরাধী মনে করছ?
এক মিনিট কি চিন্তা করল পোয়ারো। পরে বলল, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবে। জিরয়েড আগাগোড়াই ভুল করে চলেছে–জ্যাক নির্দোষ একথা জানলেও সব প্রমাণ এখুনি হাজির করা যাচ্ছে না।
আমি অবাক হয়ে তাকাতে চিন্তিতভাবে বলল, চল, সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসা যাক–ধূসর কোষগুলির গায়ে একটু হাওয়া লাগানো যাক।
সমুদ্রের ধারে গিয়ে পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, তোমার ধূসর কোষগুলো নাড়াচাড়া কর, তাহলেই দেখবে প্রকৃত সত্য নিজেই জেনে গেছ। তবে চিন্তাকে পরিচালনা করতে হবে সঠিক পদ্ধতিতে
আমি পোয়ারোর পাশে বসে তার পরামর্শ মতো কেসের সমস্ত ঘটনা পর্যালোচনা করতে গিয়ে সহসা বিদ্যুৎচমকের মতো একটা কথা মনে পড়ে গেল। মনে হলো যেন আলো দেখতে পেলাম।
-দেখো পোয়ারো, উৎসাহের সঙ্গে আমি বললাম, আমার মনে হচ্ছে একটা ব্যাপার আমরা দুজনেই ভুলে বসে আছি। একটা লোকের কথা আমাদের বিবেচনা করা উচিত।
–কে? কার কথা বলছ? সাগ্রহে বলে উঠল পোয়ারো।
–সেই জর্জেস কনিউ।
.
১২.
প্রবল উত্তেজনায় পোয়ারোর চোখ দুটি ঘোর সবুজবর্ণ ধারণ করল।
–চমৎকার হেস্টিংস। দুহাত বাড়িয়ে পোয়ারো আমাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করল; তুমি নিজেই ঠিক পয়েন্টে আলোকপাত করতে পেরেছ। আমি স্বীকার করছি, জর্জেস কনিউ-এর ব্যাপারে আমরা খুবই অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলাম।
পোয়ারোর নির্ভেজাল উচ্ছ্বাস দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলাম, কুড়ি বছর আগের ঘটনা, বর্তমান কেসে টেনে আনতে হচ্ছে। জর্জেস উধাও হয়ে গিয়েছিল। সে জীবিত কি মৃত, কিছুই জানা নেই। তবে এখন বলা চলে, কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সে জীবিত ছিল।
-তোমার সঙ্গে আমি একমত হেস্টিংস, বলল পোয়ারো, আমরা ধরে নিতে পারি সে অপরাধের জগৎ থেকে নিজেকে টেনে তুলতে পারেনি। এক সময় দাগী আসামী হয়ে উঠেছিল। তারপর ঘটনাক্রমে মারলিনভিলে উপস্থিত হয়ে একটি মহিলাকে দেখে স্বভাববশতঃই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
ইতিমধ্যে কুড়ি বছরে পার হয়ে গেলেও মহিলাকে চিনতে তার ভুল হয়নি।
হেস্টিংস, আমি সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখে ঘটনা পর পর সাজিয়ে যাচ্ছি বটে, আমি কতটা সঠিক কতটা ভুল বুঝতে পারছি না।
যাই হোক, মারলিনভিলে মহিলাটির অন্য নাম, অন্য পরিচয়। লোকটি দেখতে পায় এখানে একজন ইংরেজ প্রেমিকও মহিলার জুটেছে।
জর্জেস যথারীতি রেনাল্ডের মুখোমুখি হয়। দুজনের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়। রাগের মাথায় সে রেনাল্ডের পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়।
খুন করার পর নিজের অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পারে সে। আতঙ্কে কবর খুঁড়তে শুরু করে দেয়।
অনুমান করতে পারছি, মাদাম ডওব্রেয়ুইল ঠিক সেই সময়েই এসেছিল তার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে।
কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করছিল এক ভয়াবহ দৃশ্য। জর্জেস আর মাদাম ডওব্রেইল দুজনেই এই দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
জর্জেস তৎপর হয়ে ওঠে। প্রবল উত্তেজনায় সে তাকে টেনে শেডে নিয়ে যায়। আর তখনই দুর্ঘটনা ঘটে–সে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে।
-এরপর কি হতে পারে পোয়ারো? ধরা যাক আকস্মিকভাবেই জ্যাক রেনাল্ড ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। মাদাম ডওব্রেয়ুইল তাকে কজা করে ফেলে মাদাম রেনাল্ড আর জর্জেসের কল্পিত অবৈধ সম্পর্কের কথা বলে।
এই কুৎসা প্রচারিত হয়ে পড়লে তার মেয়ের পক্ষেও যে তা হানিকর হবে সেকথাও জানায়। তারপর পরামর্শ দেয়, তার বাবার খুনী যখন মৃত, তখন ব্যাপারটা জানাজানি হবার আগে মৃতদেহ সরিয়ে ফেলাই ভালো।
জ্যাক রাজি হয়ে যায়। পোয়ারো, সব ঠিক আছে? কি মনে হয় তোমার?
পোয়ারো হেসে বলল, বন্ধু, এটা জমাটি সিনেমার গল্প হয়ে গেল। বাস্তবের সঙ্গে এই ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। দুটি অদ্ভুতভাবে ঘটা ঘটনার সূক্ষ্ম দিকগুলো বিবেচনা করতে পারনি।
যেমন ধর, কনিউ আর মঁসিয়ে রেনান্ডের পোশাকের কথা। প্রতিপক্ষকে ছুরিবিদ্ধ করার পর জর্জেস নিশ্চয়ই মৃতদেহের সঙ্গে তার পোশাক বদল করে ফেলেনি? ছুরিটাও কি বদল করে ফেলেছ বলবে?
জর্জেস হয়তো আগের দিন মাদাম ডওব্রেয়ুইলকে ভয় দেখিয়ে টাকা আর পোশাক সংগ্রহ করেছিল। তার মেয়ের বিয়ের বিষয়টা টোপ করেই কাজটা সহজে করে থাকতে পারে সে।
-না হেস্টিংস, এ যুক্তি আমি মানতে পারছি না। জর্জেস নিজেই ছিল খুনের অপরাধী, এই অবস্থায় ভয় দেখিয়ে মাদাম ডওব্রেইলকে কজা করা তার পক্ষে অসম্ভব। কেন না সে জানত, মাদাম ডওব্রেয়ুইল ইচ্ছে করলেই তাকে যে কোনো মুহূর্তে ফাঁসিকাঠে ঝোলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে দিতে পারে।
–হ্যাঁ। তোমার কথায় যুক্তি আছে। স্বীকার করে নিরস্ত হলাম আমি, তাহলে তোমার সিদ্ধান্ত কি?
–আমার সিদ্ধান্ত হল সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত এবং নির্ভুল। তোমার ব্যাখ্যা শোনা গেল, এবারে আমার কিছু পয়েন্ট তোমাকে শোনাচ্ছি।
নিশ্চয়ই। বল।
-তুমি জর্জেস কনিউ-এর ঘটনা থেকে শুরু করেছিলে। আমিও সেখান থেকেই শুরু করছি। এটা বোঝা গিয়েছিল যে মাদাম বেরোণ্ডি নিখুঁত একটি গল্প ফেঁদে আদালতকে ধোঁকা দিয়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করেছিলেন। বর্তমান কেসের ক্ষেত্রেও একই কাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের।
সম্ভবতঃ জর্জেসের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল কাহিনীটি। তাকে প্রেরণা জুগিয়েছিল মাদাম ডওব্রেয়ুইল আর সহযোগিতা করেছিলেন মাদাম রেনাল্ড। কিন্তু ঘটনাচক্রে কেবল তাকেই আমরা সামনে দেখতে পাচ্ছি।
যাইহোক, তুমি বরং তোমার নোটবুকে পয়েন্টগুলো টুকে নাও। আমি শুরু থেকেই আরম্ভ করছি।
–শুরু বলতে তোমাকে লেখা মঁসিয়ে রেনাল্ডের চিঠির কথা বলছ তো?
–আমরা প্রথমে এই চিঠি থেকেই কেসটা জানতে পারি বটে, কিন্তু আসলে এর শুরু আরো আগে থেকে–যখন থেকে মঁসিয়ে রেনাল্ড মারলিনভিলেয় এসে বসবাস শুরু করেন। মাদাম ডওব্রেয়ুইলের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্রপাত…যার পরিণতি রেনাল্ডের কাছ থেকে মহিলার কয়েক দফায় মোটা অর্থলাভ।
এমনি কিছু টুকরো ঘটনার পর আমরা চলে আসব সরাসরি ২৩শে মে তারিখের ঘটনায়।
পোয়ারোর ইঙ্গিত পেয়ে আমি তার বক্তব্য লিখে নিতে লাগলাম।
২৩শে মে জ্যাক রেনাল্ড তার বাবার নির্দেশ পেয়ে প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। সেদিনই যাত্রার আগে মার্থা ডওব্রেয়ুইলকে বিয়ে করার প্রশ্ন নিয়ে জ্যাকের সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের তুমুল ঝগড়া হয়ে যায়।
২৪শে মে মঁসিয়ে রেনাল্ড তার আগের উইল পরিবর্তন করেন। নতুন উইলে জ্যাক রেনাল্ডের নামের উল্লেখ পর্যন্ত থাকে না। তিনি তাঁর মৃত্যুর পর সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির মালিকানা দিয়ে যান স্ত্রীকে।
এরপর, ৭ই জুন, জর্জেস আর মঁসিয়ে রেনাল্ডের মধ্যে বাগানে ঝগড়া হয়। ঝোপের আড়াল থেকে মার্থা ডওব্রেয়ুইল এই ঘটনার সাক্ষী হয়।
এই ঘটনার পরেই মঁসিয়ে রেনাল্ড পোয়ারোকে চিঠি লেখেন তার সাহায্য চেয়ে। জ্যাক রেনাল্ডকে তারবার্তা পাঠিয়ে বুয়েনস এয়ার্স যাবার কথা জানানো হয়। তারপর সোফার মাস্টার্সকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন রাতেই মঁসিয়ে রেনাল্ডের ভিলায় একজন মহিলার আগমন ঘটে। তাকে বিদায় জানাবার সময় মঁসিয়ে রেনাল্ডকে বলতে শোনা যায়, হ্যাঁ…হ্যাঁ…তুমি এখন বিদেয় হও…
এই পর্যন্ত বলে থামল পোয়ারো, পরে বলল, হেস্টিংস, মূল ব্যাপারগুলোই তুমি লিপিবদ্ধ করলে। চেষ্টা করে দেখো ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে নতুন কিছু আলোকপাত করতে পার কিনা।
আমি জানতে চাইলাম, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটাকে আমরা বিচার করব–ব্ল্যাকমেল না নারীর প্রতি আসক্তি
-অবশ্যই ব্ল্যাকমেল, বলল পোয়ারো। কেননা, মহিলার সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্টোনর কথাটা স্পষ্টই উচ্চারণ করেছিল।
–কিন্তু মাদাম রেনাল্ডের কথায় তো স্টোনরের কথার সমর্থন পাওয়া যায়নি, আমি বললাম, অবশ্য এটা ঠিক যে তিনি সব মিথ্যা কথা শুনিয়েছিলেন আমাদের।
যাই হোক, এই প্রসঙ্গে বেলা নামের মেয়েটির কথা আমরা আনতে পারি। তার সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা আমরা জানতে পেরেছি। এই সম্পর্ক সত্ত্বেও তিনি এখানে মাদাম ডওব্রেয়ুইলের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। এই সূত্রেই হুঁশিয়ারি দিয়ে মেয়েটি মঁসিয়ে রেনাল্ডকে চিঠি লিখেছিল।
–একটা প্রশ্ন এখানে হেস্টিংস, এই চিঠিতে প্রাপকের কোনো নাম ছিল না, আর সেটা পাওয়া গিয়েছিল মৃতদেহের পকেট থেকে। এই কারণে আমরা ধরে নিয়েছি যে চিঠিটা মঁসিয়ে রেনান্ডের উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই সেটা তাকে লেখা হয়েছিল কিনা এ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই।
এই বিষয়ে প্রথম আমার মনে সন্দেহ দেখা দেয় তার গায়ের ওভারকোটটা দেখে। সেটা তার দেহের তুলনায় বড় মাপের ছিল। কাজেই এই কোটটা তার না-ও হতে পারে। এই বিষয়টাও বিবেচনা করা উচিত।
তুমি দেখেছ, আমি পরে, জ্যাক রেনাল্ডের ওভারকোটেরও মাপ নিয়ে দেখেছি। সেটা তার দেহের তুলনায় ছোটই ছিল। এই দুটো ব্যাপারের যোগৃসত্র হিসেবে তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, সেদিন পিতা-পুত্রের ঝগড়ার মধ্যে প্যারিসে যাওয়ার ট্রেন ধরার সময় হয়ে গিয়েছিল বলে জ্যাক তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আশাকরি, ব্যাপারটা তোমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
বুঝতে পেরেছি, আমি বললাম, চিঠিটা লেখা হয়েছিল জ্যাক রেনাল্ডকে, তার বাবাকে নয়। সেটা তার পকেটেই ছিল। উত্তেজনার মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় জ্যাক ভুল ওভারকোট পরেছিল।
মাথা নেড়ে আমাকে সমর্থন জানাল পোয়ারো।
ওসব বিষয় নিয়ে পরে আমি আলোচনা করব। এখন ধরে নেওয়া যাক, ওই চিঠির সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের কোনো সম্পর্ক ছিল না। যাক এবারে তুমি এগিয়ে যেতে থাক।
পোয়ারোর পূর্ববর্তী নোট দেখে নিয়ে আমি বললাম, এর পর মার্থা ডওব্রেইলকে বিয়ে করার ব্যাপার নিয়ে পিতা-পুত্রের ঝগড়া, জ্যাকের প্যারিস যাত্রা, তারপর মঁসিয়ে রেনাল্ডের উইল পরিবর্তন–এসব নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। তারপরেই সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা–দেখা যাচ্ছে সেদিন সকালের সমস্ত ঘটনা পর পর সাজানো হয়েছে
-হ্যাঁ। তবে প্রথম ঘটনাটা হবে, বাগানে জর্জেস আর মঁসিয়ে রেনান্ডের বিবাদ। সেই থেকেই তার বিপদের আশঙ্কা যার জন্য আমাকে চিঠি লেখেন, ছেলেকে তারবার্তা পাঠান আর সোফারকে ছুটি দেন।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। বললাম আমি।
–মঁসিয়ে রেনাল্ডের চিঠিতে কয়েকটা বিষয় পাওয়া যায়। যে কোনো মুহূর্তে তিনি বিপদের আশঙ্কা করেছেন, স্যান্টিয়াগোর নামও উল্লেখ করেছিলেন। সেখান থেকে যদি কোনো বিপদের আশঙ্কা তার থাকতো, তাহলে সে-নাম উল্লেখ করলেন কেন? আবার ছেলেকেও সেখানে পাঠালেন-ব্যাপারটা যে অদ্ভুত তা নিশ্চয় তুমিও স্বীকার করবে। আবার এই যে বিপদের আশঙ্কা–যে কোনো মুহূর্তে জীবনহানির ভয়–ভেবে দেখো এসবেরই যেন অভিব্যক্তি ঘটেছে মাদাম রেনাল্ডের বলা কাহিনীর মধ্যে।
–সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন পরস্পরবিরোধী। যাইহোক, এগুলো নিয়ে পরে না হয় চিন্তা করা যাবে। এখন দুর্ঘটনার রাতে যে মহিলা অতিথিকে মঁসিয়ে রেনাল্ড বিদায় জানাতে এসে বিরক্তিসূচক মন্তব্য করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক।
ফ্রাঙ্কেইস বলেছে, সেই রহস্যময়ী মহিলা হলো মাদাম ডওব্রেয়ুইল। আবার ডেনিস বলেছে সে অন্য মহিলা।
মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে পোয়ারো বলল, এবারে তাহলে সেই ছেঁড়া চেকটার কথা মনে করবার চেষ্টা কর। স্টোনর বেলা ডুবিন নামটা সনাক্ত করেছিল কিন্তু তার ধারণা স্পষ্ট ছিল না। তাহলে ভিলা জেনেভিয়েভে মেয়েটি এসেছিল কার কাছে? বাড়িতে পুরুষ বলতে দুজন, জ্যাক ও তার বাবা। এদের কার কাছে মেয়েটি এসেছিল আমরা এ বিষয়টা কেবল অনুমান করতে পারি।
এমন হতে পারে, মেয়েটি জ্যাকের কাছেই তার ভালোবাসার দাবি নিয়ে এসে থাকতে পারে। মঁসিয়ে রেনাল্ড হয়তো তাকে টাকা নিয়ে খুশি থেকে ফিরে যেতে বলে থাকবেন। মেয়েটি অপমানিত বোধ করে এবং চেকটা টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে।
যাইহোক, তাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্য তিনি বলেছিলেন ঠিক আছে বিদেয় হও, তখন তিনি এরকম করেছিলেন কেন? তার হাতে কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল? তার সময়ের অপচয় হচ্ছিল? সেই কব্জিঘড়ির ক্ষেত্রেও দেখ দুঘণ্টার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ফারাক রাখা হয়েছে।
আমরা জানতে পেরেছি, মঁসিয়ে রেনাল্ড রাত বারোটার আগেই খুন হয়েছিলেন। অবশ্য ডাক্তারে অভিমত, মৃতদেহ পরীক্ষা করার সময় থেকে অন্ততঃ চব্বিশ ঘন্টা আগে তার মৃত্যু হয়ে থাকবে।
-তুমি আমার মাথা গুলিয়ে দিচ্ছ পোয়ারো, নতুন নতুন তথ্য এভাবে হাজির না করে মঁসিয়ে রেনাল্ডকে কে খুন করেছিল তাই বল। তুমি তো বলেছিলে খুনীর পরিচয় জানতে পেরেছ।
–বলতে হয় তাই ওকথা বলা হেস্টিংস। খুনীর ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। খুন দুটো ভুলে যেও না। প্রথম খুনের কারণ হিসেবে দুটি কারণ দাঁড় করানো চলে।
প্রথম ধরো, মাদাম ডওব্রেয়ুইলের সঙ্গে মঁসিয়ে রেনান্ডের ঘনিষ্ঠতা, দ্বিতীয় মার্থা ডওব্রেয়ুইলকে জ্যাক রেনাল্ডের বিয়ে করার ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া। আমার অনুমান আরও একটা কারণ থাকা সম্ভব, আমি সেটাই নির্ধারণ করার চেষ্টা করছি। আচ্ছা হেস্টিংস, এই খুনের পরিকল্পনাটা কার বলে তোমার ধারণা হয়?
–পরিকল্পনা…জর্জেস কনিউ কি?
একটু দ্বিধার সঙ্গেই বললাম আমি।
–জিরয়েডেরও তাই মত। মহিলা তার পুত্রও ভালোবাসেন এমন কোনো পুরুষকে আড়াল করবার জন্য মিথ্যা কাহিনী শুনিয়েছিলেন। তবে ওপরের কারণগুলো পর্যালোচনা করে অনুমান করতে পারছি মহিলা জর্জেসের জন্যই এবং জর্জেসের নির্দেশেই মিথ্যা গল্পের অবতারণা করেছিলেন।
–হ্যাঁ, তোমার কথায় যুক্তি আছে। স্বীকার করলাম আমি।
–তাহলে এই জর্জেস কনিউ কোনো লোকটি?
-কেন, সেই ভবঘুরে লোকটি
-ধরেছ ঠিক, কিন্তু মাদাম রেনাল্ড যে এই লোকটিকেই ভালোবাসতেন তার কোনো প্রমাণ কি আছে?
-প্রমাণ? না নেই
-কেন নেই? তুমি তো জান লোকটিকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন বলেই তো তার মৃতদেহ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
–তিনি তো স্বামীর-তবে কি তার স্বামীই জর্জেস কনিউ?
হতভম্ব হয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম পোয়ারের দিকে।
–তাঁর স্বামী কিংবা জর্জেস কনিউ যা কিছু সম্বোধন করতে পার।
–কিন্তু তা কি করে হয়?
-কেন নয়? কিছুক্ষণ আগেই তো আমরা দেখলাম জর্জেস কনিউকে ব্ল্যাকমেল করার পূর্ণ সুযোগ ছিল মাদাম ডওব্রেয়ুইলের। মঁসিয়ে রেনাল্ডের ক্ষেত্রেও একই সুযোগ ছিল তার।
–তা ছিল কিন্তু তাহলে তো নতুন একটা পয়েন্ট সামনে এসে যাচ্ছে।
–কোনো পয়েন্ট? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল পোয়ারো।
-খুনের পরিকল্পনাটা ছিল জর্জেসের একথা আমরা মেনে নিয়েছি, তাহলে দাঁড়াচ্ছে কি-জর্জেস নিজেই নিজের খুনের পরিকল্পনা করেছিল?
–এতক্ষণে মূল পয়েন্টে পৌঁছলে। সেটাই সে করেছিল। অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা সত্য।
.
১৩.
আমি বোবা চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এবারে আমার ব্যাখ্যা শোন, বলতে লাগল পোয়ারো, মানুষ কি করে নিজের খুনের পরিকল্পনা নিজে করে, একথাটা মেনে নিতে পারছ না, তাই না? কিন্তু মঁসিয়ে রেনাল্ড ঠিক তাই করেছিলেন।
তবে তিনি কিন্তু মরতে চাননি। আর যে খুনের পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন তার জন্য কোনো খুনীর প্রয়োজন ছিল না। কেবল প্রয়োজন ছিল একটা মৃতদেহ।
দেখ, কুড়ি বছর আগের সেই কুখ্যাত বেরোণ্ডি মামলার পর জর্জেস কনিউ ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকায় উপস্থিত হয়। সেখানেই তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয় সে, বিয়ে থাও করে সেখানে। দীর্ঘ কুড়ি বছরে তার চেহারাও যথেষ্ট পরিবর্তন হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কর্মফল তার পেছনেই লেগে ছিল। তাই একসময় কি করে সে মারলিনভিলে উপস্থিত হয়।
চেহারা জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলেও ফ্রান্সে তাকে একজন ঠিক চিনতে পেরেছিল। সেই ব্যক্তি হল মাদাম ডওব্রেয়ুইল। এমন শাঁসালো শিকারের সন্ধান পেয়ে সে-ও মনের সুখে দোহন শুরু করে।
নিয়তির প্রহসনে এর পরেই সেই অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। মঁসিয়ে রেনাল্ডের ছেলে জ্যাক ভালোবাসল মাদাম ডওব্রেয়ুইলের মেয়ে মার্থাকে। এই মেয়েকে বিয়ে করবে বলেই সে স্থির করে।
মঁসিয়ে রেনাল্ডের অতীতের কলঙ্কজনক ইতিহাস তার ছেলে জ্যাক জানত না। কিন্তু মাদাম রেনাল্ড তা জানতেন। অত্যন্ত রাশভারী প্রকৃতির এই মহিলা ছিলেন স্বামীর অত্যন্ত অনুগত। এই দুজনের কারোরই ইচ্ছা ছিল না তাদের ছেলে মার্থাকে বিয়ে করে। তাই বিয়েটা ঠেকানোর জন্য দুজনে মিলে পরামর্শ করে স্থির হয়, মঁসিয়ে রেনাল্ড মৃতের অভিনয় করে এখান থেকে অন্যত্র সরে থাকবেন।
তার আগে তিনি উইল করে তার ধনসম্পদ স্ত্রীকে দিয়ে যাবেন। পরে নির্দিষ্ট সময়ে মাদাম রেনাল্ড তার স্বামীর সঙ্গে মিলিত হবেন।
এই পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য দরকার হয়ে পড়ল একটি মৃতদেহ। ঘটনাক্রমে তাও জোগাড় হয়ে গেল। এক ভবঘুরে তোক একদিন তাদের ভিলায় এসে উপস্থিত হয়। বাগানে তার সঙ্গে ঝগড়া হয় মঁসিয়ে রেনাল্ডের।
দুজনে ধস্তাধস্তির ফলে লোকটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং মারা যায়। রেনাল্ড দম্পত্তি পরামর্শ করে লোকটির মৃতদেহ শেডের ভেতরে নিয়ে যান। লোকটা ছিল ফরাসি, আর মাঝবয়সী। তার মত দেখতে না হলেও তাকে দিয়েই কার্যসিদ্ধির মতলব করেন মঁসিয়ে রেনাল্ড।
স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করে উপায়ও বার করে ফেলেন। ছুরির আঘাতে লোকটার মুখ বিকৃত করে দেওয়া হবে, মাদাম রেনাল্ড তাকে মঁসিয়ে রেনাল্ড বলে সনাক্ত করবেন।
সোফার মাস্টারস এবং মঁসিয়ে জ্যাক রেনাল্ডকে নিয়ে ছিল সমস্যা। তারা উপস্থিত থাকলে আগের মৃতদেহটিকে মঁসিয়ে রেনাল্ড বলে সনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। সেই বাধা অপসারণ করা হবে সোফারকে ছুটিতে পাঠিয়ে আর জ্যাককে ব্যবসার কাজে বুয়েনস এয়ার্সে পাঠিয়ে।
পরামর্শে এই সিদ্ধান্ত স্থির হলে সাহায্য চেয়ে আমাকে একটা চিঠি লিখলেন। এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য হল, পুলিসকে নিঃসন্দেহ করা যে সত্যিই তার জীবন বিপন্ন ছিল।
এরপর মৃতদেহের গায়ের পোশাক বদল করে তার পোশাকগুলো শেডের ভেতরেই কোথাও রেখে দিন মঁসিয়ে রেনাল্ড।
মাদাম রেনান্ডের কাছে জ্যাকের দেওয়া যে ছুরিটা ছিল এরপর সেটা মৃতদেহের পিঠে বিদ্ধ করে খুনটাকে নিখুঁত রূপ দেওয়া হল।
সেই সঙ্গে লোকটার মুখও বিকৃত করে দেওয়া হল। আর সেই রাতেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মঁসিয়ে রেনাল্ড বাড়ির সংলগ্ন জমিতে একটা কবরও খুঁড়ে ফেললেন। অবশ্য তার আগে বেলা ডুবিনের ব্যাপারটা আছে।
প্রতিবেশিনী মাদাম উওব্রেযুইলের যাতে কোনোরকম সন্দেহ না জাগে সেজন্য রেনাল্ড দম্পতি চেয়েছিলেন ভবঘুরে লোকটির মৃতদেহ যাতে তাদের চোখে পড়ে।
সব ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর মঁসিয়ে রেনাল্ড অপেক্ষা করতে থাকেন রাতের অন্ধকারে স্টেশন থেকে বারোটা দশের শেষ ট্রেনটা ধরবেন বলে।
এই অবস্থায় রাতে ভিলায় উপস্থিত হয় বেলা নামে একটি মেয়ে। শেষ ট্রেনটা ধরার তাগিদ ছিল বলে মঁসিয়ে রেনাল্ড কোনো রকমে মেয়েটির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তার সেই মনোভাবই প্রকাশ পায় ওই কথায়, ঠিক আছে…এখন তুমি যাও।
মেয়েটি চলে গেলে ঘরের দরজাটা ইচ্ছে করেই একটু ফাঁক করে ভেজিয়ে রাখেন। উদ্দেশ্য, পরদিন যাতে পুলিস বুঝতে পারে খুনী এই পথেই পালিয়ে গেছে।
এরপরই ঘটল সেই অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। গলফ লিঙ্কে যখন মঁসিয়ে রেনাল্ড কবর খোঁড়েন সেই সময় অদৃশ্য মহাবিচারকের শেষ আঘাত অলক্ষ্যে নেমে আসে তার ওপর। একটা অজানা হাত পেছন থেকে তার পিঠে ছুরি গেঁথে দিল…।
একটু থেমে পরে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল। হেস্টিংস, দুটো খুনের কথা তোমাকে বলেছিলাম, কেন বলেছিলাম এবারে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?
প্রথম খুন বা অপরাধের তদন্তের জন্য মঁসিয়ে রেনাল্ড আমাকে আগ বাড়িয়ে চিঠি লিখেছিলেন, তার সমাধান পেয়ে গেলে। নিখুঁত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করবার জন্য যিনি নিজের কবর নিজেই আগে থেকে খুঁড়ে রেখেছিলেন, অদৃশ্য নিয়ন্তার কী নিদারুণ ব্যবস্থা, সেই তিনিই অজ্ঞাত হাতের ছুরিকাঘাতে শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই খুন হলেন। হেস্টিংস এমন এক রহস্যময় খুনের ঘটনা যে তার সমাধান বড় সহজ কথা নয়।
–তোমার তুলনা হয় না পোয়ারো। অভিভূত স্বরে বলে উঠলাম আমি, এমন দুরূহ জট মোচন করা তুমি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
–বেচারা জিরয়েডের জন্য দুঃখ হয় আমার, আমার প্রশংসা হজম করে নির্বিকার কণ্ঠে বলল পোয়ারো, সত্যকে জানবার সুযোগ কয়েকবারই পেয়েছে সে বিশেষ করে ছুরির বাঁট থেকে চুলটা নিজের হাতে তুলে এনেছে, তবু আত্মবিশ্বাসের অভাবে সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি।
–হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করছ, ওই চুলটা কার ছিল বলে তুমি মনে করো?
–নিঃসন্দেহে মাদাম রেনাল্ডের। ওই একটি বিষয় নিয়েই অপরাধীকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করতে পারত জিরয়েড। কিন্তু পারেনি সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি বলে।
মাদাম রেনান্ডের কথাটা একবার ভেবে দেখ, হেস্টিংস, কী অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে তিনি নিজেকে ধরে রেখেছেন, তার মনের খবর বাইরের কেউ বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারছে না। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি তার ছেলে জ্যাক খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। কেন না তিনি নিশ্চিত ছিলেন, বিদেশে নিরাপদ দূরত্বেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্যাককে ফিরে আসতে দেখেও তিনি বিচলিত হননি, কেননা তার ধারণা ছিল এ কেসে জ্যাকের জড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সেকারণেই তিনি তখন বলেছিলেন, এখন তাতে কিছু এসে যায় না। কথাটার অর্থ কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি।
মাদাম রেনান্ডের নার্ভের বিস্ময়কর ক্ষমতা স্বীকার না করে উপায় নেই। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জর্জেস কনিউর মৃতদেহ নিজের স্বামী বলে সনাক্ত করতে গিয়ে তিনি যখন দেখতে পান, মৃতদেহটা সত্যি সত্যিই মঁসিয়ে রেনাল্ডের–এটা সত্যিই যে, ওই অভাবনীয় মর্মান্তিক দৃশ্য তিনি সইতে পারেননি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে তার আচরণে কোনো ভাবে প্রকাশ পায়নি যে তার স্বামী মঁসিয়ে রেনাল্ড ছিলেন অতীতের পলাতক অপরাধী জর্জেস কেনিউ।
উপরন্তু তিনি প্রকারান্তরে প্রকাশ করেন মাদাম ডওব্রেয়ুইল ছিলেন তার স্বামীর রক্ষিতা–মহিলার পক্ষে তার স্বামীকে ব্ল্যাকমেল করা অসম্ভব নয়।
এই অসাধারণ মহিলার প্রশংসা না করে উপায় নেই। কোনো অপরাধীকেও যখন ভালোবাসেন, আন্তরিকভাবেই বাসেন।
পোয়ারোর বিশ্লেষণ আমার কাছে ছিল চমকপ্রদ। রহস্যের জট ছাড়ানোয় কী নিপুণ দক্ষতা তার।
–এবারে তোমার সেই সীসের পাইপের রহস্যটা পরিষ্কার কর। বললাম আমি।
–সেটা ধরতে পারনি? বলল পোয়ারো, মঁসিয়ে রেনাল্ড ভবঘুরের মৃতদেহটাকে নিজের বলে চালাবার মতলবে তার মুখটা বিকৃত করেছিলেন ওই বস্তুটা ব্যবহার করে। অকিঞ্চিৎকর হলেও ব্রুটা ছিল খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কিন্তু হাতের কাছে পেয়ে জিরয়েড সেটা কাজে লাগাতে পারেনি। বুঝলে হেস্টিংস, অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে প্রমাণ বা ঘটনা যত সামান্যই হোক না কেন, তার যথাযথ বিশ্লেষণ করতে হয়।
যাইহোক, এবারে গোটা কেসটা নতুন করে আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। প্রথমে খুঁজে বার করতে হবে, মঁসিয়ে রেনাল্ডকে কে খুন করে থাকতে পারে? এই ব্যক্তিটি কি ভিলার কাছাকাছি থাকে এমন কেউ, মঁসিয়ে রেনাল্ডের মৃত্যু যার স্বার্থ চরিতার্থ করবে? এরকম যে ব্যক্তিটিকে আমরা পাচ্ছি সে হল জ্যাক রেনাল্ড। কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ছুরিটা ব্যবহার করে কাজটা করেছিল সে।
যদিও পোয়ারোর বক্তব্য বুঝতে পারছিলাম না, তবুও বললাম হ্যাঁ, মাদাম রেনাল্ডের ছুরি। সেটাকেই দ্বিতীয়বার ভবঘুরে লোকটার বুকে বিধে থাকতে দেখেছি আমরা। ছুরি তাহলে দুটি না একটি?
-অনেক ভাবতে হয়েছে আমাকে ছুরির বিষয়টা নিয়ে। ছুরি দুটি। তবে মালিক একজন জ্যাক রেনাল্ড। অথচ হেস্টিংস, সত্যিকথাটা হল, জ্যাক রেনাল্ডকে অভিযুক্ত করা এক মস্ত বড় ভুল। যদিও জর্জেস কনিউ-এরই ছেলে সে, ছেলে বাপের মতো হবে বংশানুক্রমিক ধারার এমন কথা লোককে বলতে শোনা যায়–কিন্তু
আমি হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম, এ আবার কি কথা বলছ তুমি
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে পোয়ারো জানতে চাইল, ক্যালাইনে যাওয়ার জাহাজ কটায় বলতে পার?
–বিকেল পাঁচটায় বলে মনে হয়। বললাম আমি।
–তাহলে এখনো সময় পাওয়া যাবে। একজন সাক্ষীর খোঁজে ইংলন্ড যেতে হবে।
–সাক্ষী? কে সে? জানতে চাইলাম আমি।
রহস্যময় হাসি হেসে পোয়ারো বলল, মিস বেলা ডুবিন। রেনাল্ড পরিবারের সঙ্গে মেয়েটির অবশ্য কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে স্টোনর নামটা শুনেছে। ভুলে যেও না বন্ধু, জ্যাক রেনাল্ড বিত্তবান তার ওপর কুড়ি বছরের যুবক।
একজন তরুণীর প্রেমের পক্ষে আদর্শ পাত্র। মোটা টাকার চেক দিয়ে মেয়েটিকে মঁসিয়ে রেনাল্ড কেনার চেষ্টা করেছিলেন–এই বিষয়টাকে আমি অবহেলা করতে পারি না। যে করে হোক মেয়েটিকে খুঁজে বার করতে হবে।
তোমার মনে থাকার কথা, জ্যাক রেনাল্ডের ঘরে কাগজপত্রের ভেতর থেকে একটা ফোটোগ্রাফ এনেছিলাম, তাতে লেখা ছিল আমার ভালোবাসা জেনো-বেলা। এই যে দেখে রাখো।
কোটের পকেট থেকে ছবিটা বার করে আমার হাতে দিল।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম ছবির মুখটা দেখে– আমার সিনডেরেলা।
.
১৪.
চকিতে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম আমার মুখভাব লক্ষ্য করেনি সে। নির্বিকার মুখে ছবিটা ফিরিয়ে দিলাম।
–চল, এখুনি বেরিয়ে পড়া যাক।
অগত্যা তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে পড়তে হল।
পোয়ারোর পর্যবেক্ষণ মাথায় ঘুরছিল। সেই সঙ্গে সিনডেরেলা জুড়ল। জাহাজে ওঠার পর এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম।
পোয়ারো সাক্ষী খুঁজতে চলেছে। পোয়ারো কি ভাবছে মেয়েটি জ্যাক রেনাল্ডকে খুনের অবস্থায় দেখেছে?
না কি তাকেই খুনী বলে ভাবছে? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? মঁসিয়ে রেনাল্ডকে খুন করার কোনো মোটিভ তার থাকতে পারে না।
কিন্তু মেয়েটি খুনের জায়গায় উপস্থিত হল কি করে? ক্যালাইনে দুজনেই ট্রেন ছেড়েছি। জাহাজে উঠে থাকলে আমার চোখে পড়ত নিশ্চয়। এক হতে পারে যদি ট্রেনে চেপে মারলিনভিলে ফিরে আসে। তাহলে ফ্রাঙ্কেইস যে সময়টা বলেছে, ভিলা জেনেভিয়েভে তার ফিরে আসা সম্ভব হতে পারে।
কিন্তু বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল রাত দশটার পর…তারপর? এরপর কি সে হোটেলে কিংবা ক্যালাইনে ফিরে গিয়েছিল?
খুনটা হয় মঙ্গলবার। তার সঙ্গে আমার দেখা হয় বৃহস্পতিবার সকালে। আদৌ সে ফ্রান্স ছেড়ে গিয়েছিল বলে আমার মনে হয় না।
মেয়েটি কি জ্যাক রেনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল? কিন্তু আমি তো তাকে বলেছিলাম, জ্যাক ঘটনাস্থলে নেই, বুয়েনস এয়ার্সে চলে গেছে। সম্ভবতঃ সে জানত জ্যাক মারলিনভিলেই রয়েছে…সমুদ্রযাত্রা করেনি। জ্যাকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পোয়ারোর সম্ভবতঃ সেটাই জানা উদ্দেশ্য।
এমন হওয়াও অসম্ভব নয় মার্থা উওব্রেয়ুইলের সঙ্গে দেখা করতে এসে বেলা ডুবিনের মুখোমুখি হয়েছিল জ্যাক। অথচ তাকে অবহেলা করেই মার্থা ডওব্রেয়ুইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে বিত্তবান পরিবারের ছেলে জ্যাক কিছুতেই কপর্দকহীন মেয়েকে নিজের যোগ্য বলে মনে করতে পারে না।
ভাবনাচিন্তার ছাঁকুনি দিয়ে নিজের কর্তব্য নিরূপণ করবার চেষ্টা করছিলাম। পোয়ারোর কথায় সম্বিৎ ফিরল।
–গ্রেপ্তারের খবরটা ইংরাজি কাগজগুলোতে ছাপা হবে আগামী পরশু, পোয়ারো বলল, তার আগেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে।
পোয়ারোর পরিকল্পনা বোঝা দুষ্কর। তাই আমি জানতে চাইলাম, ইংলন্ডের জনারণ্যে কেবল একটি ছবি সম্বল করে মেয়েটিকে খুঁজে বার করবে তুমি?
পোয়ারো হাসল। বলল, থিয়েটারের এজেন্ট সেই জোসেফ অ্যারোসকে নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার? একজন কুস্তিগিরের ব্যাপারে একবার আমাকে সাহায্য করেছিল সে। তার সাহায্যেই মেয়েটিকে খুঁজে বার করব।
.
ফটোগ্রাফ দেখেই মিঃ অ্যারোস বলে উঠল, এতো ডুলসিবেলা বোনেদের একজন। দুই বোনই গায়িকা ও নর্তকী। ঠিক আছে আপনারা আজ চলে যান আমি খবর পাঠিয়ে দেব।
পরদিন সকালেই ভদ্রলোক একটা চিরকূট পাঠিয়ে আমাদের জানাল, ডুলসিবেলা বোনেদের কভেন্ট্রির প্যালেসে পাওয়া যাবে।
সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কভেন্ট্রির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
থিয়েটারে কোনোরকম খোঁজখবর না নিয়ে সেদিনের প্রোগ্রাম দেখে পোয়ারো টিকিট কেটে ফেলল।
শো-এর সর্বশেষ প্রোগ্রাম ছিল ডুলসিবেলা বোনেদের গান ও নাচ।
ঘোষকের ঘোষণা শেষ হতেই দুই বোন মঞ্চে উপস্থিত হল। বুক কাঁপছিল আমার। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম।
দেখে দুই বোনকে যমজ বলেই মনে হল। অবশ্য একজনের চুলের রঙ হালকা হলুদ, আরেকজনের ঘন কাল। দুজনেরই মিষ্টি সুন্দর চেহারা। গানের গলাও সুন্দর। গানের সঙ্গে মানানসই নাচও করল তারা।
একসময় শো শেষ হল। দর্শক-শ্রোতার আনন্দোচ্ছ্বাস আর করতালিধ্বনিতে হল মুখরিত হয়ে উঠল।
আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। দমফাটা হৈ-হট্টগোল অসহনীয় হয়ে উঠল। বাইরে গিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে না পারলে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। পোয়ারোকে রেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
আমাদের হোটেলের কাছেই থিয়েটার। ঘরে এসে খানিকটা হুইস্কি নিয়ে বসলাম।
হঠাৎ দরজা ঠেলে ঘরে যে ঢুকল, তার দিকে চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম।
সিনডেরেলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
–হলে সামনের সারিতে তোমাকে আর তোমার বন্ধুকে দেখতে পেলাম। এই তোমার সেই গোয়েন্দা বন্ধু? কভেন্ট্রিতে তোমরা কেন এসেছ বলো তো?
থেমে থেমে কথাগুলো বলল মেয়েটি।
মঞ্চের পোশাক তখনো গায়ে চাপানো ছিল। একটা ক্রোক দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। আমি ভাবছি, একটু কি ভয়ার্ত শোনাল তার স্বর? যেজন্য সে ভয় পাচ্ছে নিশ্চয় তা জানে পোয়ারো-বুঝতে পারছি।
কিন্তু আমার সিনডেরেলা…আমার হৃদয়ও তো আকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেবল তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো কথা আমি বলতে পারছি না।
-তোমার গোয়েন্দা বন্ধু কি আমার খোঁজ করছে? অস্ফুটে বলল সে।
আমি তেমনি বাক্যহারা। সে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল, তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আমি হাঁটু মুড়ে বসে তার দুহাত জড়িয়ে ধরলাম। হৃদয়ের সমস্ত আবেগ জড়ো করে বলতে লাগলাম, কেঁদো না প্রিয়তমা, তোমার কোনো ভয় নেই, আমি তোমাকে রক্ষা করব। সব কিছুই আমি জানি।
কান্না থামিয়ে সে আমার চোখে চোখ রাখল। জল টলটল করছে।
সেদিন তুমিই তো ছুরিটা নিয়ে এসেছিলে? বললাম আমি।
–হ্যাঁ। অস্ফুটে উচ্চারণ করল সে।
–কেন এনেছিলে?
–আমার ভয় ছিল ওটার গায়ে হাতের ছাপ যদি পাওয়া যায়?
–কিন্তু তুমি তো গ্লাভস পরেছিলে। তবু ভয় ছিল?
–তুমি কি আমাকে পুলিসের হাতে দেবে?
–না।
–দেবে না কেন?
–সিনডেরেলা–আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কোনোদিন কাউকে ভালোবাসার কথা চিন্তাও করিনি আমি। কিন্তু আজ এই অদ্ভুত পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে সেই কথাটাই না জানি কেন না বলে পারলাম না তাকে।
সে মুখ নিচু করল। বিড়বিড় করে বলল, ওহ না। আমাকে ভালোবাসা যায় না–আমার সম্পর্কে কিছুই জান না তুমি
–জানি সবই। সে-রাতে তুমি মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে। তোমাকে খুশি করার জন্য তিনি মোটা অঙ্কের একটা চেক দিয়েছিলেন। তুমি ঘৃণাভরে সেটা টুকরো করে ছিঁড়ে ফেল। তারপর তুমি তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আস। জ্যাক রেনাল্ড সমুদ্রযাত্রা না করে ফিরে এসেছিল–সেকথা তুমি জানতে কিনা বলতে পারব না। বিষাদাচ্ছন্ন মনে ফেরার পথে গলফ খেলার মাঠে রাত বারোটা নাগাদ একটি লোককে তোমার চোখে পড়ে। পেছন থেকে দেখলেও তাকে তুমি সম্ভবতঃ চিনতে পেরেছিলে। আগেই জ্যাক রেনাল্ডকে হুমকি দিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলে। লোকটাকে সামনে দেখতে পেয়ে পেছন থেকে তুমি তাকে আঘাত করেছিলে। তাকে খুন করেছিলে।
দুহাতে মুখ ঢাকল সে। অস্ফুটে বলতে লাগল, ওহঃ তুমি সব বলেছে।
একটু পরে আমার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ স্বরে বলে উঠল, আমি খুনী–একথা জেনেও তুমি আমাকে ভালোবাসবে?
-ভালোবাসা বড় অবুঝ সিনডেরেলা। বললাম আমি, জানি না কেন, প্রথম দেখা হওয়ার দিন থেকেই আমি নিজের কাছে বড় অসহায় হয়ে পড়েছি–তোমাকে ভালো না বেসে পারিনি।
আমার কথাগুলোতে কি ছিল জানি না। এমনভাবে হৃদয়ের গভীর আবেগ কখনো কারো কাছে প্রকাশ করিনি।
সিনডেরেলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মুখ ঢাকল। স্খলিত কণ্ঠে বলতে লাগল-ওহ, আমি কি করব…কি করব…কে আমাকে বলে দেবে
-শান্ত হও বেলা, তার চুলে বিলিকেটে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি প্রতিদান চাই না কিছু, কেবল তাকে ভালোবেসে আমাকে সাহায্য কর।
জ্যাক রেনাল্ডকে আমি ভালোবাসি তুমি তাই মনে করো?
ঠোঁটের কোণে হাসবার চেষ্টা করে সে আবার বলল, কিন্তু তোমাকে যেভাবে ভালোবাসি তাকে সেভাবে কখনো ভালোবাসতে পারব না।
বলতে বলতে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমার ঠোঁট লিপ্ত হল তার উপর্যুপরি উষ্ণ চুম্বনে। তার আন্তরিক ভালোবাসার বন্য প্রকাশ আমাকে অভিভূত করল।
ঠিক এই সময় দরজার দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলাম। পোয়ারো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে।
–এখুনি এখান থেকে চলে যাও তুমি, আমি ওকে আটকে রাখছি। পোয়ারোকে আমি আগলে রাখলাম। সিনডেরেলা আমাদের পাশ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
–তাকে যেতে দিয়ে ভালোই করলে, বলল পোয়ারো, তবে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। এখন শান্ত হয়ে বসো।
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তাকে ধরবার চেষ্টা করবে না?
–আমি তো জিরয়েড নই, হেস্টিংস। কিন্তু পুরনো বন্ধুর প্রতি তোমার এই ব্যবহার খুবই অস্বস্তিকর। ফটোগ্রাফ দেখে মেয়েটিকে যে তুমি চিনতে পেরেছ, সেকথা আমাকে বলনি। কিন্তু তুমি জানতে না, আমি জানতাম সেকথা। এখন আমার সামনেই তাকে তুমি পালিয়ে যেতে সাহায্য করলে।
তোমার কাছে একটা কথা আমি জানতে চাই হেস্টিংস, তুমি কি আমার সঙ্গে কাজ করবে না বিরুদ্ধাচরণ করবে?
সংযত কণ্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো কে করল পোয়ারো। প্রতিটি শব্দ যেন আমার বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হল। পোয়ারো আমার বন্ধু।
–তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য আমি দুঃখিত পোয়ারো, আমি বললাম, আমি নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে মার্জনা কর। কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
বন্ধু, মনে হয় মেয়েটিকে তুমি ভালোবাস, একথা নিজেও জানতে না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়েটিই ছুরিটা নিয়েছিল। তোমাকে আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম। যাই হোক, এখন আমাকে কিছু বল, যদি আমার চেয়ে বেশি কিছু জেনে থাক–
–চমকে দেওয়ার মতো কোনো খবর তোমার ঝুলিতে নেই পোয়ারো। মিস ডুবিনকে সন্ধানের চেষ্টা করে বৃথা সময় ব্যয় করো না। সেদিন রাতে মঁসিয়ে রেনাল্ডের সঙ্গে যে মেয়েটি দেখা করেছিল, সে এ নয়। এই অপরাধের সঙ্গেও এই মেয়েটি জড়িত নয়, তোমাকে আমি নিশ্চিত বলতে পারি। ফ্রান্স থেকে বাড়ি পর্যন্ত ট্রেন ভ্রমণে সেদিন সে আমার সঙ্গে ছিল। ভিক্টোরিয়ায় তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়। সেদিন রাতে তার পক্ষে মারলিনভিলে যাওয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়।
–একথা তুমি আদালতে শপথ নিয়ে বলতে পারবে? চিন্তিতভাবে আমার দিকে তাকাল পোয়ারো।
-নির্দ্বিধায়।
-হেস্টিংস, উঠে দাঁড়িয়ে বলল পোয়ারো, তোমার ধারণা খুবই বিস্ময়কর, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি।
.
১৫.
আমার গল্পটা পোয়ারো কতটা বিশ্বাস করল বুঝতে পারছিলাম না। বেলাকে আর কোনো ভাবে অভিযুক্ত করা যায় কিনা তাও বুঝতে পারছিলাম না। তবে পোয়ারো যে নিরস্ত হবে না সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
পরদিন সকালে একসঙ্গেই ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসলাম। ওকে জানালাম, একটা কাজে একবার বাইরে যেতে হবে।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো পোয়ারো। বলল, যে খবর জানবার জন্য বাইরে যাবার কথা ভাবছ, যদি জানতে চাও তোমাকে আমি তা জানাতে পারি।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে।
–শোন হেস্টিংস, ডুলসিবেলা বোনেরা কভেন্ট্রি ছেড়ে চলে গেছে। থিয়েটারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেই অজ্ঞাতবাসে যাত্রা করেছে তারা।
-তুমি খবর নিয়েছিলে?
–হ্যাঁ। এবং এটাই সত্য খবর। এছাড়া আর কি করতে পারত তারা?
আমিও তা বুঝতে পারছিলাম। আমার দুর্বলতার সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে পোয়ারোর নাগালের বাইরে সরে পড়েছে সে। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে বিব্রত হতে হবে আমাকেই।
বুঝতে পারছিলাম না, সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে কিনা। পোয়ারো নিশ্চয়ই কোনো পথ খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে। সেটা তার অতি নম্র সৌজন্যমূলক ব্যবহার দেখেই বুঝতে পারছিলাম।
আপাতঃ শান্ত মূর্তির আড়ালেই সে বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সবদিকে নজর রেখে সতর্ক থাকতে হবে আমাকে।
চোখের কোণে আমাকে লক্ষ্য করে পোয়ারো বলল, তাকে কেন খোঁজ করলাম না নিশ্চয় বুঝতে পারছ হেস্টিংস?
–দয়া দেখিয়েছ।
–আমার জায়গায় তুমি হলে যা করতে আমিও তাই করেছি। ছুটোছুটি করে হয়রান হবার প্রয়োজন দেখি না। বেলা ডুবিনকে যেতে যাও। প্রয়োজন হলে যথাসময়ে নিশ্চয়ই তার খোঁজ পেয়ে যাব।
পোয়ারো অভাবিত ভাবে শান্ত আর নির্লিপ্ত। আমার কাছে যা খুবই অস্বস্তিকর বোধ হতে লাগল।
–তোমার পরিকল্পনার কথা জানতে ইচ্ছে হলেও, আর জিজ্ঞেস করব না। সে অধিকার আমি হারিয়েছি পোয়ারো। মেয়েটিকে আমি পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি।
-না, বন্ধু, তোমাকে গোপন করার মতো কিছুই নেই আমার। আমরা ফ্রান্সে ফিরে যাচ্ছি।
পোয়ারোর কথা শুনে আমি বিস্ময়াহত। আমাকে পোয়ারো ত্যাগ করেনি, সর্বক্ষেত্রে তার সহচর হবার অধিকার থেকে চ্যুত করেনি আমাকে।
আমার মনোভাব বুঝতে পেরে পোয়ারো বলল, হ্যাঁ, বন্ধু। আমি জানি, তোমার পোয়ারোকে কখনোই ত্যাগ করতে পার না তুমি। তবে ইচ্ছে করলে ইংলন্ডে থেকে যেতে পার তুমি।
জবাবে আমি কেবল মাথা নাড়লাম। আমার চেতনার আলোকে নতুন করে যেন পোয়ারোকে আবিষ্কার করলাম। তবু নিঃসংশয় হতে পারছিলাম না, এমন একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার বিশ্বাস ফিরে পাব।
তবে যাই ঘটুক আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। পোয়ারোর কাছাকাছি থেকে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে। পোয়ারো যতক্ষণ আছে, বেলা বিপদমুক্ত নয়।
আমি বললাম, তুমি যেভাবে খুশি নিতে পার, সবকাজ আমরা দুজনে মিলেই করতে চাই।
-আমিও একমত, বলল পোয়ারো, তবুও তোমাকে সতর্ক করে দেওয়া আমি কর্তব্য বলে মনে করি।
-তোমাকে আমার শত্রুর ভূমিকা নিতে দেখলে কিছুমাত্র বিচলিত হব না পোয়ারো। তবু আমি
আমাকে বাধা দিয়ে পোয়ারো বলল, তবু তুমি যে কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছ তা নিয়েই সন্তুষ্ট। কিন্তু বন্ধু, আমি আপাততঃ জ্যাক রেনাল্ডকে নিয়েই ভাবতে চাই।
নামটা শুনে মনে হল আমি যেন এতক্ষণ কল্পনার জগতে ছিলাম। এ কেসের বিন্দুমাত্র ছায়া চিন্তার জগত থেকে সরে গিয়েছিল।
জ্যাক রেনাল্ড আমাকে বাস্তবের মাটিতে নিয়ে এল। বেচারা জ্যাক। সে এখন জেলে বন্দি। ফাঁসির সম্ভাবনায় প্রতিটি মুহূর্তে শঙ্কিত হচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমার ভূমিকাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। জ্যাক রেনাল্ড নিরপরাধ। বেলাকে আমি বাঁচাতে পারি, কিন্তু তার বিনিময়ে ওই নিরপরাধ মানুষটির গলায় ফাঁসির দড়ি হয়তো ঝুলিয়ে দিতে হবে।
কিন্তু এমন জঘন্য কাজ আমি কি করে করব? অসম্ভব। যে করেই হোক নিরপরাধ জ্যাক রেনাল্ডকে জেলের দরজার বাইরে মুক্ত আকাশের তলায় বার করে নিয়ে আসতে হবে। যে কোনো মূল্যে।
পরমুহূর্তেই শঙ্কায় দুলে উঠল বুক। যদি সে খালাস না পায়? তাহলে? তাহলে অভিযুক্ত হবে বেলা? যেকোন মূল্যে আমি যাকে ভালোবাসতে চাই?
কি সিদ্ধান্ত আমি নেব? আমি কি বেলাকে বাঁচাবার চেষ্টা করব না?
সম্ভবতঃ বেলা এখনো জানে না, জ্যাক রেনাল্ড গ্রেপ্তার হয়েছে। আমি তাকে কিছুই প্রকাশ করিনি। কিন্তু যখন সে জানবে, তখন সে কি করবে? সে কি নিজের জীবনের বিনিময়ে তার প্রাক্তন প্রেমিককে বাঁচাবার চেষ্টা করবে?
এমনও তো হতে পারে, সব বাধা অতিক্রম করে জ্যাক রেনাল্ড খালাস পেয়ে যাবে। তা হলে তো সবদিকই রক্ষা হয়। যদি তা না হয়–সেই সঙ্কট মোচন করবে কে?
আমাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে বেলাকে আড়ালে রাখা যায় এবং জ্যাককেও বাঁচানো যায়। যদিও জানি না, কি করে তা সম্ভবপর হবে।
পোয়ারো কোনো অন্যায় হতে দেবে না। যেকোনো ভাবেই হোক, নিরপরাধীকে সে মুক্ত করে আনবে। আমি জানি, যত কঠিনই হোক, সে কাজে সে ব্যর্থ হতে পারে না। যদি এমন হয়, বেলা সব সন্দেহের বাইরে আর জ্যাক রেনাল্ড অভিযোগমুক্ত–এমন সন্তোষজনক সমাধান কি সম্ভব হবে? কোনো পথে সম্ভব?
৪. ইংলন্ড থেকে ফিরে
১৬.
ইংলন্ড থেকে ফিরে পরদিন সকালে সেন্ট ওমরে ম্যাজিস্ট্রেট হয়টেটের ঘরে তার সঙ্গে দেখা করলাম আমরা। জ্যাক রেনাল্ডকেও সেখানে আনা হয়েছিল।
আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে মঁসিয়ে হয়টেট বললেন, আপনি আসাতে স্বস্তি ফিরে পেলাম। হতভাগা জিরয়েড যে কেলেঙ্কারি করেছে, এ মারাত্মক ভুল কি করে সংশোধন করা যাবে বুঝতে পারছি না। মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি অন্য কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না?
সেই সম্ভাবনা যথেষ্ট আছে। এখনো অনেক পয়েন্টই অস্পষ্ট রয়েছে। জ্যাক রেনাল্ডকে আমি অপরাধী ভাবতে পারছি না। কিন্তু তার সপক্ষে কি বলার আছে?
–আত্মপক্ষ সমর্থন করতে ব্যর্থ হয়েছে সে, বললেন মঁসিয়ে হয়টেট, তার কাছ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি ছাড়া কিছু পাওয়া মুশকিল। ভাবছি, আগামীকাল তাকে আমি আবার জিজ্ঞাসাবাদ করব। আপনিও উপস্থিত থাকবেন।
কথা শেষ করে সামনের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা চিঠি বার করে আনলেন মঁসিয়ে হয়টেট।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার এই চিঠিটা আমার কাছে ছিল।
ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠিটা হাতে নিল পোয়ারো। চিঠিটা তখুনি না খুলে পকেটে রেখে দিল পোয়ারো। তারপর যাওয়ার জন্য উঠল।
-তাহলে কাল আমাদের দেখা হচ্ছে মঁসিয়ে হয়টেট।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তেই জিরয়েডের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
-ওহ, মঁসিয়ে পোয়ারো, বলল জিরয়েড, আপনাকে দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আশা করতে পারি এ কেসের চূড়ান্ত রায় এবারে শিগগিরই ঘোষিত হবে।
–আমি আপনার সঙ্গে একমত মঁসিয়ে জিরয়েড।
–তরুণ রেনাল্ডকে শেষ পর্যন্ত যে আপনি দোষী সাব্যস্ত করে সন্তুষ্ট হয়েছেন, এটা খুবই আনন্দের সংবাদ।
-মাপ করবেন মঁসিয়ে, আমার মতে জ্যাক রেনা নির্দোষ।
–পাগল! তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠল জিরয়েড।
-মঁসিয়ে জিরয়েড, তদন্তের শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছি আপনি আমাকে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করে গেছেন। আপনার জন্য উপযুক্ত জবাব আমি তৈরি করে রেখেছি। আপনার আগেই মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনীকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি পাঁচশো ফ্রাঙ্ক বাজি রাখতে রাজি। আপনি প্রস্তুত?
একটু ইতস্ততঃ করে জিরয়েড বলল, বেশ, আমি প্রস্তুত।
-ধন্যবাদ মঁসিয়ে জিরয়েড। এসো হেস্টিংস যাওয়া যাক।
পোয়ারোর চ্যালেঞ্জকে জিরয়েড কিভাবে নিল বোঝা গেল না। কিন্তু পোয়ারো পরিষ্কার ঘোষণা করে ফেলেছে, মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনীকে সে খুঁজে বার করেছে। পোয়ারোর মনে কি আছে বোঝা যাচ্ছে না। বেলাকে নিয়েই চিন্তা হতে লাগল।
রাস্তায় চলতে চলতে এসব চিন্তাই মাথায় ঘুরতে লাগল। পোয়ারোর সঙ্গে কোনো কথা হল না।
হোটেলে ঢোকার মুখে গ্যাব্রিয়েল স্টোনরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। আমাদের সঙ্গে হোটেলে আসতে রাজি হয়ে গেল।
তারপর, বলুন মঁসিয়ে স্টোনর, বলল পোয়ারো, এদিকে কি মনে করে?
–একজন বন্ধুর ওপর যদি অন্যায় অবিচার হয়, তার পাশে সবারই দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করি। বলল স্টোনর।
–আপনি বিশ্বাস করেন না যে জ্যাক রেনাল্ড তার বাবাকে খুন করেছে?
নিশ্চয়ই না। জ্যাক রেনাল্ডকে আমি জানি। সে খুন করেছে একথা আমি কখনো বিশ্বাস করব না।
জেনে খুশি হবেন যে, তার খালাস পাবার সম্ভাবনাই বেশি। তার বিরুদ্ধে এমন কোনো প্রমাণ জিরয়েড উপস্থিত করতে পারেনি।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, জিজ্ঞেস করল স্টোনর, আপনি তাকে অপরাধী বলে বিশ্বাস করেন?
না। তবে তার নির্দোষিতা প্রমাণ করা খুবই কষ্টকর হবে। জিরয়েড তার ওপর যতই অবিচার করে থাক, মাদাম রেনাল্ডের শেষ জবানন্দীর ওপরই তার ভাগ্য নির্ভর করছে। তবে জ্যাকের আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা সন্তোষজনক নয়।
–সে রাতে জ্যাকের কাছে যে কোনো ছুরিই ছিল না, সেকথা মাদাম রেনাল্ড জানেন। বললাম আমি।
আমি জ্যাক রেনাল্ডের অফিসে গিয়েছিলাম, বলল পোয়ারো, আমি জানতে পারি কোম্পানির কারখানা থেকে তিনটি ছুরি তৈরি করিয়েছিল। তার একটা দিয়েছিল তার মাকে, একটা বেলা ডুবিনকে আর তৃতীয় ছুরিটা জ্যাক যে তার নিজের জন্য রেখেছিল, তা বলা যায়। অতএব ছুরির প্রশ্ন তুলে জ্যাককে নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে না।
–বিচারের এতবড় ভুল, চিৎকার করে উঠলাম আমি, পোয়ারো, তুমি ছাড়া ওকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। তাকে তুমি বাঁচাও।
–যা অসম্ভব তাই তুমি আমাকে করতে বলছ হেস্টিংস। যাক…এখন এই চিঠিটা দেখা যাক।
পোয়ারো পকেট থেকে খামটা বার করে আনল। ভেতর থেকে চিঠিটা বার করে চোখের সামনে মেলে ধরল। মুহূর্তে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
দুর্বোধ্য হাতের লেখায় চিঠিটা এরকম ছিল :
প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো,
আমি বড় অসহায় বোধ করছি। আমার সাহায্য পাওয়ার কোনো জায়গা নেই। দয়া করে আমাকে আপনি সাহায্য করুন। যেকোন মূল্যে জ্যাককে বাঁচাতে হবে। আপনি সদয় হোন।
আপনার।
মার্থা উওব্রেয়ুইল
পড়া হলে চিঠিটা পোয়ারোর হাতে ফিরিয়ে দিলাম।
–হেস্টিংস এখুনি চল মার্থার সঙ্গে কথা বলে আসা যাক। বলল পোয়ারো।
আধঘণ্টার মধ্যেই ভিলা মারগুয়েরিটা পৌঁছলাম আমরা। মার্থা ডওব্রেইল সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, আপনাদের দেখে বুকের বল ফিরে পেলাম। বড় বিপদ আমার, কি করব বুঝতে পারছি না। জেলে জ্যাকের সঙ্গে ওরা আমাকে দেখা করতে দেবে না। আমি এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করি না সে খুন করেছে।
-আমারও তাই ধারণা মাদমোয়াজেল, বলল পোয়ারো, জ্যাক রেনাল্ড কাউকে আড়াল, করতে চাইছে কিনা বুঝতে পারছি না।
মার্থা ডওব্রেইলের ভ্রুকুটি দেখা দিল।–এরকম একটা সন্দেহ আমিও করেছিলাম। তার মাকে আড়াল করার একটা সম্ভাবনা আছে। মঁসিয়ে রেনাল্ডের সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন তিনিই।
জ্যাক গ্রেপ্তার হওয়াতে তিনি দারুণ আঘাত পেয়েছেন দেখাতে চাইছেন। পাকা অভিনেত্রী তিনি। দেখলেন না কেমন অজ্ঞান হয়ে গেলেন। স্টোনার তাকে সাহায্য করছে। যদিও দুজনের বয়সের ব্যবধান অনেক, তবু বলব, তাদের সম্পর্ক সন্দেহজনক। বুঝতেই পারছেন।
–ব্যাপারটা আরও একটু প্রাঞ্জল করে নিতে চাই মাদমোয়াজেল, আমাকে আপনি সাহায্য করুন। আপনাকে আমি একটা প্রশ্ন করব।
–হ্যাঁ, বলুন মঁসিয়ে।
–আপনি আপনার মায়ের প্রকৃত নাম জানেন?
একটা ধাক্কা খেল যেন মার্থা। মুহূর্তের জন্য পোয়ারোর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
–আপনি তাহলে জানেন।
কাঁধে হাত বুলিয়ে পোয়ারো তাকে সান্ত্বনা দিল।
–শান্ত হোন। এবারে আর একটা প্রশ্নের জবাব দিন। মঁসিয়ে রেনাল্ডের প্রকৃত পরিচয় আপনি জানেন?
–মঁসিয়ে রেনাল্ড!
বুঝতে পারছি আপনি জানেন না। তাহলে এবার আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। এরপর একেবারে গোড়া থেকে সমস্ত ঘটনা একে একে বলে গেল পোয়ারো। ইংলন্ড থেকে ফেরার পথে আমাকে যা যা বলেছে সেসবও বাদ দিল না।
–আপনি অসাধারণ মঁসিয়ে পোয়ারো, পোয়ারোর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে সকাতরে মিনতি জানাল মার্থা, আমি ওকে ভালোবাসি–আপনি ওকে বাঁচান–
.
১৭.
পরদিন সকালে ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে হয়টেট শেষবারের মতো জ্যাক রেনাল্ডকে জেরা করবেন। আমরাও উপস্থিত হয়েছি যথাসময়ে।
বিধ্বস্ত চেহারার জ্যাককে দেখে স্থির থাকা যায় না। দুচোখের কোলে কালি জমেছে। চোয়াল দুটো ঝুলে পড়েছে।
–রেনাল্ড, আমার কয়েকটা প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিন, জেরা শুরু করলে ম্যাজিস্ট্রেট, আপনার বাবার খুন হওয়ার রাত্রে আপনি মারলিনভিলে ছিলেন, নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জ্যাক নিভকণ্ঠে জবাব দিল, আমি আগেই বলেছি, তখন আমি চেরবুর্গে ছিলাম।
এরপর রেল স্টেশনের দুজন সাক্ষীকে হাজির করা হল। তাদের একজনকে আমি চিনতে পারলাম। মারলিনভিল রেল স্টেশনের প্রধান পোর্টার। সে তার সাক্ষ্যে জানাল, জ্যাক রেনাল্ডকে সে ভালো ভাবেই চেনে। গত ৭ জুন রাত এগারোটা চল্লিশের ট্রেন থেকে তাকে নামতে দেখেছে।
দ্বিতীয় সাক্ষী একজন রেল কর্মচারী, পোর্টারের বক্তব্যের সমর্থন জানাল।
ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কিছু বক্তব্য আছে রেনাল্ড?
–আমার বলার কিছু নেই।
–এটা আপনি চিনতে পারেন? ম্যাজিস্ট্রেট একটা ছুরি তুলে ধরলেন।
–হ্যাঁ। ছুরিটা আমি আমার মাকে উপহার দিয়েছিলাম।
–এরকম আর কোনো ছুরি আছে বলে আপনার মনে হয়?
–আমার জানা নেই। তবে ছুরিটার নক্সা আমিই তৈরি করেছিলাম।
অপরাধীর এমন স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট একটু থমকে গেলেন।
এরকম আর একটা ছুরি যে জ্যাক বেলাকে দিয়েছিল। সেকথা সে সম্পূর্ণ চেপে গেল।
আমি বুঝতে পারলাম বেলাকে আড়াল করার জন্যই তার এই মিথ্যা স্বীকারোক্তি। একসময় মেয়েটিকে সে ভালোবাসতো, কিন্তু তার জন্য এখন এতটা আত্মত্যাগ তার কিসের জন্য? পোয়ারো ঠিকই বলেছিল, এখন বুঝতে পারছি, ছুরির প্রসঙ্গ জ্যাকের কোনো উপকার করতে পারবে না।
–রেনাল্ড, ম্যাজিস্ট্রেট আবার বলতে শুরু করলেন, মাদাম রেনাল্ডের ছুরিটা তাঁর ড্রেসিং টেবিলের ওপরে ছিল, তিনি আমাদের বলেছেন। আমরা কি ভাবব, তিনি কথাটা ভুল বলেছিলেন, অথবা ছুরিটা ভুল করে আপনি প্যারিসে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন? আপনি কি একথা অস্বীকার করবেন?
জ্যাক রেনাল্ড একমুহূর্ত ইতস্ততঃ করল পরে বলল, না, অস্বীকার করব না। এটা সম্ভব।
ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধীর সহজ স্বীকারোক্তির প্রবণতা লক্ষ্য করে তার মনোভাব পরিবর্তন করলেন সম্ভবতঃ। তিনি সামান্য ঝুঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, রেনাল্ড, আপনার বক্তব্যের গুরুত্ব আপনি বুঝতে পারছেন তো? আপনি যা বললেন, তাতে আপনার ফাঁসি রদ করা যাবে না।
মুহূর্তের মধ্যে জ্যাক রেনাল্ডের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। তার মলিন বিষণ্ণ মুখে দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ ফুটে উঠল।
–মঁসিয়ে হয়টেট, আমি শপথ নিয়ে বলছি, আমি খুনী নই, আমার বাবাকে আমি খুন। করিনি।
অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তার সেই হাসি ছিল ইঙ্গিতপূর্ণ।
–কিন্তু রেনাল্ড, আপনার স্বীকারোক্তিতে সেই ইঙ্গিত ছিল না। আপনার অপরাধের কথা আপনি স্বীকার করেছেন। আপনার সমর্থনে কোনো অ্যালিবি নেই। আপনি আপনার বাবাকে খুন করেছেন এটা পরিষ্কার। আর তা করেছেন অর্থের লোভে।
আপনার বিশ্বাস ছিল, আপনার বাবার মৃত্যুর পর তার ধনসম্পত্তির মালিক হবেন আপনি। আর এর মূলে ছিলেন আপনার মা। আদালত তার বিচার অবশ্যই করবে। কিন্তু আপনার অপরাধ বিবেচনার অযোগ্য।
ঠিক এই সময় দরজা খুলে আর্দালি ঘরে ঢুকে জানাল, একজন মহিলা তার বক্তব্য জানাতে চান।
স্বভাবতঃই ম্যাজিস্ট্রেট বিরক্তি প্রকাশ করলেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য শেষ হবার আগেই একজন মহিলা ঘরে ঢুকল।
সমস্ত আদালতের দৃষ্টি মহিলার ওপর নিবদ্ধ হল। ওড়না ঢাকা মুখ। পরনে কালো পোশাক।
এগিয়ে এসে মহিলা ওড়না সরিয়ে দিল। বিস্মিত হয়ে দেখলাম অবিকল সিনডেরেলার মুখ-কিন্তু সিনডেরেলা নয়। জ্যাক রেনাল্ডের ঘর থেকে পোয়ারো যে ফটোগ্রাফ পেয়েছিল, মহিলার মুখের সঙ্গে তার অদ্ভুত মিল।
–আমার নাম বেলা ডুবিন। আদালতে দাঁড়িয়ে আমি স্বীকার করছি, মঁসিয়ে রেনাল্ডকে আমিই খুন করেছি।
.
১৮.
হোটেলে এসে একটা চিঠি পেলাম। কাগজের ভাঁজ খুলে পড়তে লাগলাম–
বন্ধু,
সবকথা তোমাকে না জানিয়ে আর পারা গেল না। চিঠিটা পড়লেই বুঝতে পারবে।
বেলাকে ঠেকানো গেল না। খুনের অপরাধে নিজেকে জড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নিশ্চয় বুঝতে পারছ, তোমাকে আমি সত্য কথা বলিনি। কিন্তু কেন তা করতে হল, তোমার জীবন থেকে চিরতরে সরে যাওয়ার আগে তা জানিয়ে যেতে চাই। নিজের স্বার্থের কথা ভেবে কোনো অন্যায় কাজ আমি করিনি। তাই আমার বিশ্বাস, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে।
তোমার সঙ্গে প্যারিসে যেদিন প্রথম দেখা হল, তখন আমার মন জুড়ে ছিল বেলার জন্য প্রচণ্ড অস্বস্তি। মারলিনভিলে গিয়ে জ্যাক রেনাল্ডের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল সে।
জ্যাকের প্রতি তার ভালোবাসায় আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু তার সন্দেহ হয়েছিল, জ্যাক অন্য মেয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তাই মরিয়া হয়েই সে চলে এসেছিল।
বোনকে রুখবার জন্য ছুটতে হল আমাকে। ক্যালাইনের ট্রেনে ওকে পেলাম না। প্যারিস থেকে আসা পরবর্তী ট্রেনে ওর দেখা পেলাম। কিন্তু আমার কোনো কথা সে শুনল না। কিছুতেই ইংলন্ডে ফিরে যেতে রাজি হল না।
আমি হোটেলেই রইলাম, বেলা রওনা হয়ে গেল মারলিনভিলের উদ্দেশ্যে। তবে কথা দিয়ে গেল হোটেলে ফিরে আসবে। পরদিন বেলা হোটেলে ফিরে না আসায় আমি ভাবলাম, জ্যাকের ব্যাপারে ও হয়তো তার বাবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেখানে সে বিশ্রীভাবে অপমানিত হয়ে থাকবে।
কিছু করা যায় কিনা ভেবে সকালেই আমি ভিলায় খোঁজ নেবার জন্য এলাম। সেখানেই তোমার সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়ে গেল। তারপরের ঘটনা তো সবই তুমি জান।…সেই শেডের ভেতরে জ্যাকের ওভারকোট পরা জ্যাকের মতো দেখতে মৃত ব্যক্তি, সেই কাগজকাটা ছুরি সবই তুমি আমাকে দেখালে।
ছুরিটা জ্যাক বেলাকে দিয়েছিল। তাই আমার বুক কেঁপ উঠল ভয়ে, ছুরিতে নিশ্চয়ই বেলার হাতের ছাপ রয়েছে। সেই মুহূর্তে আমি কর্তব্য স্থির করে ফেললাম, যেভাবে হোক ছুরিটা সরিয়ে ফেলতে হবে।
এরপর অভিনয়ের আশ্রয় না নিয়ে আমার উপায় ছিল না।…আমার জন্য তুমি জল আনতে গেলে, সেই সুযোগে ছুরিটা হস্তগত করলাম। তারপর ইংলন্ড ফেরার পথে ছুরিটা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
ছুরিটার কথা বেলাকে জানালাম। অদ্ভুতভাবে সে হেসে উঠল শুনে। আমার ভয় হল প্রচণ্ড মানসিক চাপে ও পাগল না হয়ে যায়। তার মন খানিকটা হাল্কা হবে এই ভরসায় তাকে নিয়ে আমি থিয়েটারে কাজের চুক্তি করে ফেললাম।
কিন্তু বন্ধু, তারপরও আমরা নিষ্কৃতি পেলাম না। দেখলাম তুমি আর তোমার বন্ধু আমাদের ওপর নজর রাখছ। বুঝতে পারছিলাম না আমাদের সন্দেহ করছ কিনা। সত্যি ব্যাপারটা জানবার জন্য আমি বেপরোয়া হয়ে তোমাকে অনুসরণ করলাম। তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, বেলাকে নয়, তুমি সন্দেহ করছ আমাকেই। ছুরিটা চুরি করেছিলাম আমি, তাই আমাকে বেলা বলে ভুল করা অস্বাভাবিক ছিল না।
প্রিয়তম, আমাকে অভয় দিয়ে বলেছিলে তুমি রক্ষা করবে আমাকে। জানি না, বেলাকে রক্ষা করবে কিনা। তবে আমার বিশ্বাস, আমাকে ক্ষমা করবে।
আমি আর বেলা যমজ বোন। বেলার জন্য আমাকে তাই ঝুঁকি নিতে হয়েছিল, তোমাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। বেলার জন্য না ভেবে যে আমি পারি না। যদি কখনো সুযোগ পাই…তোমার মনে বিশ্বাস ফেরাবার চেষ্টা আমাকে করতেই হবে।
খবরের কাগজে জ্যাক রেনাল্ডের গ্রেপ্তারের খবর দেবার পরই বেলার মতিগতি পাল্টে যায়। আমি বুঝতে পারি তাকে আর রোখা যাবে না…জ্যাকের কি হয় দেখার জন্য সে অপেক্ষা করে থাকবে না। জানি না কি হয়। বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর লিখতে পারছি না।
— তোমার
ডুলসি ডুবিন
পোয়ারো কাছেই ছিল। চিঠি পড়া শেষ করে বুঝতে পারি সর্বাঙ্গে শিথিলতা। শান্ত চোখে পোয়ারোর দিকে তাকালাম।
চিঠিটা আমার হাতে ফেরত দিয়ে পোয়ারো বলল, আমি আগেই জানতাম।
–সে অন্য মেয়ে জেনেও আমাকে বলনি কেন?
–এরকম একটা ভুল তুমি করবে আমি ভাবতে পারিনি। ফটোটা তুমি হাতে নিয়ে দেখেছিলে। যমজ বোন হলেও তাদের আলাদা ভাবে চেনা অসম্ভব ছিল না।
-সেই সুন্দর চুল
-নাচগানের সময় ওরকম পরচুল তাদের ব্যবহার করতে হয়। দুই বোনের চুল দুই রঙের। একজনের কালো, অন্য জনের হালকা রং। তাছাড়া কভেন্ট্রির হোটেলে এমন নাটকীয় পরিস্থিতি ছিল যে তোমাকে বলার সুযোগ ছিল না।
অবশ্য, এটাও স্বীকার করছি, তোমাদের প্রেম কতটা সত্য তা জানার ইচ্ছাও আমার ছিল। তবে বন্ধু, তোমাকে আমি ভুলের মধ্যে ফেলে রাখিনি।
পোয়ারোর গলায় আন্তরিকতার সুর, এক ঝটকায় যেন তার সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে দিল। আমার সত্যিকার বান্ধব সে।
তুমি কি মনে করো, সে আমার কথা ভাবে?
–চিঠির প্রতিটি ছত্রে তোমাকে নিয়ে তার ভাবনার কথা প্রকাশ পেয়েছে। তুমি কি তা বুঝতে পারনি?
–কিন্তু চিঠিতে তো কোনো ঠিকানা নেই…তাকে আমি পাব কোথায়?
–তার জন্য অধীর হবার কিছু নেই। তোমার পোয়ারো রয়েছে..
.
জেল থেকে ছাড়া পেল জ্যাক রেনাল্ড। মারলিনভিলে ফিরে যাবার আগে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এল। স্টোনর তার সঙ্গে ছিল।
–মাঁসিয়ে পোয়ারো, মেয়েটিকে আড়াল করার চেষ্টা কোনো কাজে এলো না। এভাবে সে উপস্থিত হবে ভাবতে পারিনি। বিষণ্ণ হেসে বলল জ্যাক।
-তার না এসে উপায় ছিল না, বলল স্টোনর, আপনাকে সে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে দিতে পারে না ।
কিন্তু জিরয়েড লোকটা যে এতবড় গর্দভ জানা ছিল না। বলল জ্যাক, বেলার জীবনে এখন কি ঘটতে চলেছে ঈশ্বর জানেন।
–বেলার ব্যাপারে ভাবিত হবার কিছু নেই, সহজ গলায় বলল পোয়ারো, ফরাসি আদালত যুবতী ও সুন্দরীদের ব্যাপারে যথেষ্ট সহৃদয়।
–কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, বাবার খুনের ব্যাপারে নৈতিকভাবে আমি দায় এড়াতে পারি না। বেলার ব্যাপারে আমার জড়িয়ে পড়ার জন্যই তাকে অকালে এভাবে চলে যেতে হল। এই বেদনা আমাকে আজীবন বয়ে চলতে হবে।
একটু থেমে সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে জ্যাক আবার বলল, বেলা বাবাকে খুন করেছে, কথা মনে হলেই শরীর শিহরিত হয়। মার্থার সঙ্গে জড়িত হবার পর বেলার মানসিকতা বুঝতে আমি ভুল করেছিলাম। তাকে আমার নির্লজ্জ বলেই বোধ হয়েছিল। চিঠি লিখে তাকে যে অক্ষমতা জানাবো সে সাহসও পাইনি। ব্যাপারটা মাথার কানে যাবার ভয় ছিল। এখন বুঝতে পারছি, কাজটা কাপুরুষের মতো হয়ে গিয়েছিল। অথচ সে কোনো পেছুটান না রেখেই আমাকে বাঁচানোর জন্য সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে। আমি বেঁচে থাকব ঠিকই কিন্তু অহরহ বুকে একটা হাহাকার আমাকে দগ্ধে মারবে।
দু-একটা বিষয় কিন্তু এখনো আমার কাছে পরিষ্কার হল না মঁসিয়ে পোয়ারো, সেই লোকদুটি যখন মায়ের ঘরে প্রবেশ করে তখন রাত দুটো বাজে বলে কেন যে মায়ের ভুল হল বুঝতে পারছি না। আমি মায়ের ঘরে প্রবেশ করেছিলাম, একথা মা ভাবতেও পারেননি। আর হল, সে-রাতে বাবার পোশাক আর আমার ওভারকোট নিয়ে আপনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
–ওসব নিয়ে আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই মঁসিয়ে, বলল পোয়ারো, আপনাকে পরে আমি সব বুঝিয়ে বলব। এখন সে-রাতের কথাটা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
-বলার মতো বিশেষ কিছু নেই মঁসিয়ে পোয়ারো। আগেও বলেছি মার্থার সঙ্গে দেখা করার জন্য চেরবুর্গ থেকে ফিরে আসি। ট্রেন লেটে পৌঁছেছিল। পথ কমাবার জন্য গলফ লিঙ্কের পথ ধরেছিলাম।
বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছাই, কেমন একটা দমফাটা চিৎকার আমার কানে এলো। তাড়াতাড়ি একটা ঝোপের আড়াল নিলাম। আকাশে চাঁদ ছিল। চাঁদের আলোয় কবরটা চোখে পড়ল। বাবা সেখানে দাঁড়িয়ে। একটা ছায়ামূর্তি, হাতে ছুরি। বাবাকে পেছন থেকে ছুরিবিদ্ধ করার জন্য উদ্যত হয়েছে। সেই মুহূর্তে আমাকে দেখতে পেয়ে সে আঁৎকে উঠেছিল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি ভেবে, সে আমার বাবাকে খুন করেছে।
চিৎকার করে কেঁদে উঠে সেই মুহূর্তে সে ছুটে পালিয়ে যায়।
-তারপর? জানতে চায় পোয়ারো।
–বিদ্যুৎ চমকের মতো আমার মাথায় খেলে যায় এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। এখনি আমাকে পালাতে হবে। নইলে মেয়েটির বিরুদ্ধে আমাকে সাক্ষী দিতে ডাকবে ওরা। আমাকে যে তারা সন্দেহ করতে পারে সেকথা তখন মনে হয়নি। আমি হাঁটাপথে বেউভয়াসে পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে চেরবুর্গে ফিরে যাই।
এই সময় হোটেলের বয় স্টোনরের হাতে একটা তারবার্তা দিয়ে গেলো। মারলিনভিল থেকে আসা তারবার্তায় জানানো হয়েছিল মাদাম রেনাল্ডের জ্ঞান ফিরে এসেছে।
–অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। চলুন, তাহলে সকলে মিলে মারলিনভিলে যাওয়া যাক।
বেলা ডুবিনের কেসের তদারক করবার জন্য জ্যাক স্টোনরকে থাকতে বলল। তারপর আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে মারলিনভিলে রওনা হল।
.
ভিলা মারগুয়েরিটের কাছে জ্যাক গাড়ি থেকে নেমে গেল মার্থাকে তবে খালাস পাবার শুভসংবাদটা দেওয়ার জন্য। আর মাদাম রেনাল্ডকে তার ছেলের মুক্তির সংবাদ দেওয়ার জন্য আমরা চললাম ভিলা জেনেভিয়েভের উদ্দেশ্যে।
ভিলায় পৌঁছে আমরা দেখা করতে চাই জানিয়ে ফ্রাঙ্কেইসকে দিয়ে ওপরে খবর পাঠিয়ে দিল পোয়ারো।
আমরা নিচে যখন অপেক্ষা করছি তখন দেখা গেল জ্যাক আর মার্থা ভিলায় ঢুকছে। পোয়ারো ঝট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হল।
-মঁসিয়ে রেনাল্ড, আপনারা এখন ভেতরে ঢুকবেন না। আপনার মা খুবই মুষড়ে পড়েছেন। দ্রুত বলে গেল পোয়ারো।
-কিন্তু আমাদের যে তার কাছে এখনই যেতে হবে। বলল জ্যাক রেনাল্ড।
-তাহলে আপনি বরং একা যান। মাদমোয়াজেলকে এখন নেবেন না। আমার পরামর্শ শুনুন
এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালাম সকলে। লিওনির হাতে ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন মাদাম রেনাল্ড।
–আপনার সহযোগিতার জন্য অশেষ ধন্যবাদ সঁসিয়ে পোয়ারো
।–মা—
ওপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো জ্যাক।
সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে কঠিন স্বরে বলে উঠলেন মাদাম রেনাল্ড, আমাকে তুমি আর মা বলে ডাকবে না। তুমি আর আমার ছেলে নও। এই মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম।
-মা—
করুণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল জ্যাক। তার দৃষ্টি স্থির।
পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে মাদামকে কিছু বোঝাতে চায়। তাকে বাধা দিয়ে মাদাম রেনাল্ড জ্যাকের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, তোমার হাতে তোমার বাবার রক্ত লেগে রয়েছে। তুমিই তোমার বাবার মৃত্যুর কারণ।
এই মেয়েটির জন্য তুমি তোমার বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেছ। আর একটি মেয়েকেও তুমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চলেছ। তোমার মুখ আমি দেখতে চাই না। এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।
তোমার বাবার এক কপর্দকও যাতে তুমি স্পর্শ করতে না পার, কালই আমি সেই ব্যবস্থা করব। যে মেয়েটির জন্য তোমার বাবাকে মরতে হল, তাকে সঙ্গে নিয়ে এবারে নিজের পথ খুঁজে নাও গে।
কথা শেষ করে তিনি ধীরে ধীরে ওপরে চলে গেলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতবাক স্তব্ধ। কারোর মুখে টু শব্দ নেই। জ্যাক আর সইতে পারছিল না। তার শরীর টলতে লাগল। আমি আর পোয়ারো ছুটে গিয়ে তাকে ধরলাম।
-এত মানসিক চাপ উনি সইতে পারছেন না, মার্থাকে বলল পোয়ারো, ওকে এখন কোথায় নেওয়া যায় বলুন তো?
-আমার প্রিয় জ্যাক। আমাদের ভিলাতেই সে থাকবে। আমি আর আমার মা তার শুশ্রূষা করব।
জ্যাক রেনাল্ডকে ধরাধরি করে আমরা ভিলা মারগুয়েরিটে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করলেন। তিনি জানালেন, মানসিক চাপে শরীর বইতে পারছে না। পূর্ণ বিশ্রাম আর ভালো শুশ্রূষা পেলে সুস্থ হয়ে উঠবেন।
সেদিন শেষ পর্যন্ত মার্থার হাতেই জ্যাকের দায়িত্ব দিয়ে আমরা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। দুটো ঘর ভাড়া নেওয়া হল।
হোটেল ম্যানেজার পোয়ারোকে জানাল, ইংলিস লেডি মিস রবিনসন আপনাদের জন্য সেলুনে অপেক্ষা করছেন মঁসিয়ে।
পোয়ারো এবার আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো। পরে চোখ নাচিয়ে বলল, শোন হেস্টিংস, আমি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছি।
–কিন্তু
–কিন্তুর কিছু নেই। মারলিনভিলে আনার জন্য ডুবিনকে ওই নামের পোশাকটা পরাতে হয়েছে। পুলিস গন্ধ পেলে
আসলে ডুবিন নয়–আমার সিনডেরেলা। সেলুনে ছুটে গিয়ে আমি তাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে টেনে নিলাম।
পোয়ারো এগিয়ে এসে বলল, মাদমোয়াজেল, আমাদের কাজ এখনো অনেক বাকি। আপাততঃ তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। হেস্টিংস আর আমাকে এখনি বেরতে হবে। কাল আবার তোমাদের দেখা হবে।
-এখুনি কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?
–ব্যস্ত হয়ো না, কালই সব জানতে পাবে।
–আমি আপনাদের সঙ্গে যাব–কোনো কথা শুনব না। জেদ ধরল সিনডেরেলা।
পোয়ারো কথা বাড়াল না। বুঝতে পারল লাভ হবে না। বলল, তাহলে এসো সঙ্গে।
.
ভিলা জেনেভিয়েভ রাতের অন্ধকারে ডুবে আছে। কোনো ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি মাদাম রেনাল্ডের শোওয়ার ঘরের নিচে। জানালা খোলা ছিল। পোয়ারো সেদিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।
পোয়ারোর উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাই তাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে আমরা এখন কি করছি?
–সজাগ থাক। বলল পোয়ারো। ঘণ্টা দুয়েক হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
পোয়ারোর কথা শেষ হতে পেল না, একটা আর্ত চিৎকার রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দিল।
বাঁচাওবাঁচাও–আমাকে বাঁচাও
দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল। চিৎকারের শব্দটাও সেদিক থেকে আসছে। চোখে পড়ল জানালার কাছাকাছি দুটি অস্পষ্ট মূর্তি লড়াই করছে।
–মাদাম নিশ্চয়ই তার ঘর বদল করে থাকবেন।
বলতে বলতে ছুটে গিয়ে পোয়ারো সামনের দরজায় করাঘাত করতে লাগল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। শিগগিরই খোলার সম্ভাবনা ছিল না। ওদিকে সমানে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার উঠছে।
পোয়ারো অস্থির ভাবে ছুটে এসে বললো, কি করা যায় বলো তো?
সেই মুহূর্তে আমাকে হতবাক করে দিয়ে সিনডেরেলা কাঠবিড়ালির মতো দেয়াল বেয়ে ওপরে সেই ঘরের জানালার দিকে উঠে যেতে লাগল।
–হ্যায় কপাল। ও যে পড়ে যাবে।
আমি অসহায় ভাবে চিৎকার করে উঠলাম।
–ঘাবড়িও না হেস্টিংস। ওটাই ওর পেশা। ও এসে দেখছি ভালোই হল।
এক মিনিটের মধ্যেই জানলা টপকে ঘরের ভেতরে লাফিয়ে পড়ল সিনডেরেলা। পরক্ষণেই তার চিৎকার ভেসে এলো, সরে দাঁড়ান আপনি। আমার কব্জি দুটো সাধারণ মনে করবেন না। লোহার মতো কঠিন।
ঠিক এমনি সময় ফ্রাঙ্কেইস বাড়ির দরজা খুলে দিল। আমরা ছুটে ওপরে উঠে গেলাম।
ঘরের ভেতর থেকে ধস্তাধস্তির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল। একটু পরেই দরজা খুলে দিল সিনডেরেলা।
–মাদাম নিরাপদ তো? জানতে চাইল পোয়ারো।
–হ্যাঁ, তবে খুবই বিধ্বস্ত। আমার আসতে একমুহূর্ত দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।
বিছানার ওপরে কাত হয়ে পড়েছিলেন মাদাম রেনাল্ড। ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছিলেন।
-গলা টিপে ধরেছিল আমার। দম টানতে টানতে বললেন তিনি।
সিনডেরেলা উবু হয়ে মেঝের ওপর থেকে একটা দড়ি পাকানো মই তুলে পোয়ারোর হাতে দিল।
–এটা ব্যবহার করেই ওপরে উঠে এসেছিল, বলল পোয়ারো, কিন্তু কোথায় সে?
আঙুল তুলে ঘরের এক কোণায় নির্দেশ করল সিনডেরেলা। মুখটা কাপড়ে ঢাকা।
–মরে গেছে নাকি? পোয়ারো জানতে চাইল।
–মনে হয়। পাথরে মাথা ঠুকে গিয়ে থাকবে।
–কিন্তু ওটা কে? জানতে চাইলাম আমি।
–মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনী। মাদাম রেনাল্ডকে সে খুন করতে চেয়েছিল।
আমি হাঁটু মুড়ে বসে মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিলাম। বিস্ময়ে কথা হারিয়ে গেল আমার। একটা সুন্দর মুখ আমাকে যেন ব্যঙ্গ করল। সে মুখ মার্থা উওব্রেয়ুইলের।
সেই রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল।
এমন একটা নাটকীয় ফাঁদ পাতার পর আমরা আবিষ্কার করলাম মাদাম রেনাল্ডের ঘরে মাথা ডওব্রেয়ুইলের মৃতদেহ।
পোয়ারো বলল, মাদামের ঘরে তাকে আবিষ্কার করা হলেও মঁসিয়ে রেনান্ডের প্রকৃত খুনী সেই।
কিন্তু বেলা ডুবিনই তো তাকে খুন করেছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তি করল। বললাম আমি।
–সে খুনী বলে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তা ঠিক নয় হেস্টিংস। সে খুন করেনি।
–তাহলে এরকম স্বীকারোক্তি করার স্বার্থ কি তার?
জ্যাক রেনাল্ডকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচানো। তাকে সে আন্তরিকভাবে ভালোবাসত। মামলাটা খুবই জটিল হয়ে পড়েছিল। তবে গোড়া থেকেই আমার মনে হয়েছিল, কেসটা পূর্বপরিকল্পিত ঠান্ডা মাথার একটা খুন। পুলিসকে অন্ধকারে রাখার জন্য নিজেকে নিজে খুন করার যে অদ্ভুত পরিকল্পনা নিয়েছিলেন মঁসিয়ে রেনাল্ড, ঘটনাচক্রে সেই পরিকল্পনাই তার খুনী সুচতুরভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
–কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, মঁসিয়ে রেনান্ডের পরিকল্পনার কথা একমাত্র মাদাম রেনাল্ডই জানতেন।
–হ্যাঁ, তিনিই একমাত্র জানতেন। এবং তাকেই আমাদের সন্দেহ করার কথা। কিন্তু তার অপরাধ প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য ছিল না। স্বভাবতই ভাবনা হল, তাহলে আর কে খুনী হতে পারে?
মার্থা উওব্রেয়ুইলের স্বীকারোক্তি থেকেই সেই তথ্যের আভাস পাওয়া গেল। সে বলেছিল বাগানে সেই ভবঘুরে লোকটার সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের বচসার সময় সে আড়াল থেকে শুনেছিল। আমি অনুমান করলাম, তাহলে সে রেনাল্ড দম্পতির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও শুনে থাকতে পারে, অবশ্য যদি তারা বাগানের বেঞ্চিতে বসে আলোচনা করে থাকেন।
–যদি ধরে নিই তাদের আলোচনা সে শুনেছে, তবে মঁসিয়ে রেনাল্ডকে সে খুন করতে চাইবে? কি স্বার্থ উদ্ধার হবে তার?
–স্বার্থ খুবই সরল। তা হলো অর্থ। তাহলে এই দিকটা নতুন করে সাজিয়ে দিচ্ছি দেখ।
বলে পোয়ারো চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। পরে তার ব্যাখ্যা শুরু করল, মার্থা তরুণ রেনাল্ডকে ভালোবাসতো, তবে অন্তর থেকে নয়, তার অর্থের দিকে তাকিয়ে, বিত্তবান পিতার পুত্র হিসেবে সে জানত, বাবার মৃত্যুর পর জ্যাক তার ধনসম্পত্তির অর্ধেক পাবে, আর জ্যাকের স্ত্রী হিসেবে সেই টাকার সেও হবে একজন দাবিদার। এদিক থেকে মার্থার কার্যকলাপ তার মায়েরই মতো।
এর পরে আসে ছুরির প্রসঙ্গে। জ্যাক তিনটে ছুরি তৈরি করেছিল। একটা সে দিয়েছিল মাকে, একটা বেলা ডুবিনকে আর তৃতীয়টা, নিজের জন্য না রেখে দিয়েছিল মার্থাকে। সে কখনোই স্বীকার করেনি যে একটা ছুরি নিজের জন্য রেখেছে। তাহলে তৃতীয় ছুরিটা মার্থার কাছে থাকাই সম্ভব।
তাহলে মার্থার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কি দাঁড়াচ্ছে দেখ, প্রথমতঃ মঁসিয়ে রেনান্ডের পরিকল্পনার কথা মার্থা আড়াল থেকে শুনে থাকবে। দ্বিতীয়তঃ র্মসিয়ে রেনাল্ডের মৃত্যুতে তার আগ্রহ থাকার সঙ্গত কারণ রয়েছে।
তৃতীয়তঃ মার্থা হল এমন একজন কুখ্যাত অপরাধীর সন্তান, যে অন্ততঃ সরাসরি খুন না করে থাকলেও নৈতিক দিক থেকে সে তার স্বামীর খুনী। সেই খুনের সঙ্গে জর্জেস কনিউ-এর নামও অবশ্য জড়িত। সবশেষে সেই ছুরির প্রসঙ্গ।
একটু থামল পোয়ারো। পরে আগের প্রসঙ্গের জের টেনে বলল, বেলা ডুবিন স্বেচ্ছায় মঁসিয়ে রেনাল্ডকে খুন করার কথা স্বীকার করেছে। আপাতঃদৃষ্টিতে এখানেই মামলার যবনিকা পড়েছে। কিন্তু আমি এতে সন্তুষ্ট হতে পারিনি।
গোড়া থেকে সমস্ত ঘটনার পর্যালোচনা করার পর আমি আমার অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকি। আমার মনে হল, বেলা ডুবিনকে বাদ দিলে আর একজনকেই মঁসিয়ে রেনাল্ডের খুনী হিসেবে ভাবা যেতে পারে, আর সে হল, মার্থা ডওব্রেয়ুইল।
কিন্তু তার বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার মতো প্রমাণ অনুপস্থিত। সে সন্দেহের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছে নিজেকে।
বাধ্য হয়েই আমাকে অন্য পথ ধরতে হল। তার বিরুদ্ধে আমার আগে বলা দ্বিতীয় তথ্যটাকেই আমি খুঁটি হিসেবে চালতে চাইলাম। মাথার ভেতরের মানুষটাকে বাইরে টেনে না আনা পর্যন্ত নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছিল না।
–তাহলে কি মাদাম রেনাল্ড
–হ্যাঁ, প্রিয় বন্ধু, মাদাম রেনাল্ড আমারই পরামর্শে প্রকাশ্যে ছেলে জ্যাককে ত্যাগ করার কথা সেই সঙ্গে নতুন করে উইল করে তার বাবার সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছিলেন।
ওই এক মোক্ষম খোঁচাতেই মার্থার ভেতর অবধি নাড়া খেয়ে গেল। তার সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ ছিল না–মাদাম রেনান্ডের উইল করার পথ বন্ধ করার জন্য।
জ্যাক তার বাবার ধনসম্পত্তির অর্ধেক থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে–যার দিকে লক্ষ্য রেখেই তার ভালোবাসার জাল বিস্তার, সেই সম্ভাবনা রোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল মার্থা। পরদিন মাদাম রেনাল্ড তার উইল পরিবর্তনের সঙ্কল্প কার্যকরী করার আগেই তাকে খুন করাতে বদ্ধ পরিকর হয়।
নির্বিঘ্নে কাজটা সম্পন্ন করতে পারলে মঁসিয়ে রেনাল্ডের ধনসম্পত্তির কেবল অর্ধেক নয়, সম্পূর্ণই হবে জ্যাকের অধীন। আর জ্যাক অর্থবিত্তের অধিকারী হওয়ার অর্থ তারই সবকিছুর মালিক হওয়া।
মার্থা এমনভাবে ছক কষেছিল যাতে মাদাম রেনান্ডের হত্যাটা আত্মহত্যার ঘটনা বলে প্রমাণ হয়। তার জন্য সব রকম প্রস্তুতিই তার সঙ্গে ছিল। ক্লোরোফর্মের বোতল আর বিষাক্ত হিপোডারমিক সিরিঞ্জ নিয়েই সে ঘরে ঢুকেছিল। তার হিসেব ছিল, প্রথমে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করে মাদাম রেনাল্ডকে অজ্ঞান করে ফেলবে। পরে বিষাক্ত সিরিঞ্জ দেহে ফুটিয়ে তাকে হত্যা করবে। সিরিঞ্জটা ফেলে রাখবে শয্যার পাশে।
পরদিন সকাল পর্যন্ত ক্লোরোফর্মের চিহ্ন উবে যাবে। মৃতদেহের পাশে সিরিঞ্জ পেয়ে পুলিস ধারণা করবে, মানসিক উত্তেজনার বশেই তিনি নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন।
মার্থার সম্ভাব্য এই পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্য আমিও প্রস্তুত হয়েছিলাম। আগেই মাদামকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যাতে তিনি আক্রমণের আগেই ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং তিনি তা করেছিলেন। এর পরের ঘটনা তো সবই তোমার জানা।
কাহিনী শেষ করে পোয়ারো সেই পরিচিত দৃষ্টি ক্ষেপণ করল আমার দিকে। যার অর্থ, আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে কি না।
পোয়ারোর ব্যাখ্যা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। তার বক্তব্য শেষ হলে বললাম, মার্থা যখন প্রকাশ করল সে বাগানে সেই ভবঘুরে লোকের সঙ্গে মঁসিয়ে রেনাল্ডের তর্কবিতর্ক শুনেছে, তুমি কি তখন থেকেই তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছ?
-না বন্ধু, পোয়ারো বলল, তার অনেক আগে থেকেই। প্রথম যেদিন আমরা মারলিনভিলে আসি সেদিনের কথা তোমার নিশ্চয় মনে আছে। সেদিন এই সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে তুমি মুগ্ধ হয়েছিলে।
কিন্তু আমি মেয়েটির যা লক্ষ্য করেছিলাম তা তোমাকে বলেছিলাম, সেই প্রথম দিনই তার চোখে আমি উদ্বেগের ছায়া পড়তে দেখেছিলাম। তার সেই উদ্বেগই তাকে আমার সন্দেহের আওতায় নিয়ে এসেছিল।
কেন না, সেই সময় জ্যাকের জন্য উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণই তার ছিল না। জ্যাক যে মারলিনভিয়ে ফিরে এসেছে, তখন সে জানতোই না।
যাইহোক, জ্যাক সুস্থ হয়ে উঠল। সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে সে পাথর হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে পুলিস তাদের কাজ সম্পন্ন করেছে, কারার অন্তরালে ডুবিনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে মার্থা। তাকে বাঁচাবার সব পথ রুদ্ধ হয়েছে।
মাদাম রেনাল্ড আর জ্যাক-মাতাপুত্রের মধ্যে নতুন করে আবার মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
জ্যাক তার বাবার অতীত ইতিহাস জানতে পেরেছে। পোয়ারের পরামর্শেই মাদাম রেনাল্ড অনেক দুঃখের সঙ্গে তাকে সব কথা জানিয়েছেন। সত্যকে গোপন করে কখনোই ভালো ফল লাভ করা যায় না।
পোয়াবোর কাছ থেকেই জ্যাক রেনাল্ড তার বাবার প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে। জানতে পারে তার সর্বসহা মায়ের প্রতি কত অবিচার করা হয়েছে। পোয়ারো তাকে বলেছে, নানা খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে পুলিস হয়তো ধাঁধায় পড়বে, তবে তাদের সমস্যার সমাধান সহজেই আমি করে দেব।
সবচেয়ে বড় কথা হল, এ কেসে আমি সারাক্ষণ পুলিসের হয়ে কাজ করিনি। আমি কাজ করেছি আপনার বাবার হয়ে। আমি কেবল জানি, জর্জেস কনিউ আর আপনার বাবা–দুজন মানুষ নয়–একই ব্যক্তি।
.
আমাদের কাজ শেষ হয়েছিল। দিনকয়েক পরেই আমরা লন্ডন ফিরে যাই।
সপ্তাহখানেক পরেই জ্যাক রেনাল্ড এল আমাদের সঙ্গে দেখা করতে।
জ্যাক বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, দক্ষিণ আমেরিকায় বাবার বিরাট ব্যবসা রয়েছে। মাকে নিয়ে আমি সেখানেই চলে যাচ্ছি। তাই যাবার আগে আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম। বাবার সেক্রেটারি স্টোনরও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। নতুন করে আবার সব শুরু করতে চাই আমি।