ঢাল বেয়ে যেখান দিয়ে নেমেছে ওরা, স্টেফানোকে নিয়ে সেখান দিয়ে ওঠা যাবে না। তার পক্ষে সম্ভব নয়। ঘুরে আরেক পাশে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাতে সময় লাগবে বেশি। লোকগুলোর সামনে পড়ারও ভয় আছে। কারণ ওরা এলে ওদিক দিয়েই আসবে। চূড়ায় উঠে আবার নামার কষ্ট করতে যাবে না। তবু ঝুঁকিটা নিতে বাধ্য হলো গোয়েন্দারা।
এমনই একটা জায়গা, স্টেফানোকে বয়ে নেয়াও কষ্টকর। অগত্যা হাঁটিয়েই নিয়ে যেতে হলো। তবে শরীরের ভর বেশির ভাগটাই কিশোর আর রবিনের কাঁধে দিয়ে রেখেছেন তিনি।
কিন্তু এতো চেষ্টা করেও পার পেলো না। ধরা পড়তেই হলো। বড় জোর একশো ফুটও যেতে পারলো না, বিশাল এক পাথরের চাঙরের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো একজন মানুষ। ওদের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল, এক মুহূর্তের জন্যে, তার পরেই পেছন ফিরে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো। বেরিয়ে এলো আরও দুজন।
কিছুই করার সময় পেলো না কিশোর আর রবিন। তিনটে ল্যাসো উড়ে এলো ওদের দিকে। এভাবে ল্যাসোর ফাঁস ছুড়ে ছুটন্ত বুনো জানোনায়ারকে বন্দী করে ফেলে মেকসিকানরা, আর ওরা তো দাঁড়ানো মানুষ। মাথা গলে কাঁধের ওপর দিয়ে নেমে এলো দড়ির ফাঁস। হ্যাঁচকা টান পড়লো দড়িতে। বুকের কাছাকাছি চেপে বসলো ফাঁস, এমন ভাবে, হাত নাড়ানোরও ক্ষমতা রইলো না কারো। আটকা পড়লো দুই গোয়েন্দা। আবার বন্দি হলেন সিনর স্টেফানো।
শিস দিতে গিয়েও দিলো না কিশোর। মুসা একা এসে কিছু করতে পারবে না তিনজনের বিরুদ্ধে। তাকেও আটকে ফেলবে। তার চেয়ে মুক্ত থাকুক। ওদেরকে পরে উদ্ধার করার একটা ব্যবস্থা করতে পারবে।
দড়ির ফাঁস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে জোরাজুরি করলো অবশ্য কিশোর আর রবিন। বৃথা। সামান্যতম ঢিলও করতে পারলো না।
খকখক করে হাসলো একজন লোক। স্প্যানিশ আর ভাঙা ভাঙা ইংরেজি মিলিয়ে বললো, খামোকা নড়ো, খোকা। ষাঁড় ছুটতে পারে না এই ফাঁস থেকে, আর তোমরা তো ছেলে মানুষ। ভ্যাকুয়ারোর হাতে পড়েছে তোমরা, ছোটার আশা বাদ দাও।
আমাদের কেন ধরেছেন? রাগ দেখিয়ে বললো কিশোর।
হেসে উঠলো লোকটা। তোমাদের দেশে তোমরা হলে কি করতে, যদি তোমাদের বন্দিকে কেউ ছিনিয়ে নিতে চাইতো?
কিন্তু এই মানুষটাকে আটকে রাখার কোনো অধিকার আপনাদের নেই, স্টেফানোকে দেখিয়ে রাগ করে বললো রবিন।
সেটা তোমরা ভাবছো, আমরা না, হেসে জবাব দিলো লোকটা। শুরুতে ভেবেছিলাম, ছোট মাছ ধরেছি। এখন বুঝতে পারছি, দুজনেই তোমরা বড় মাছ। তবে প্রজাপতি জাল দিয়ে না ধরে ধরেছি ল্যাসসা দিয়ে। পালাতে আর পারবে না! নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হেসে উঠলো সে। বেরিয়ে পড়লো নোংরা হলদেটে দাঁত।
অন্য দুজনও যোগ দিলো তার সঙ্গে।
ল্যাসোর দড়ি টানটান করে ধরে রেখে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করলো তিনজনে। নিচু স্বরে। কিছুই বুঝতে পারলো না ছেলেরা। মনে হলো, তর্ক করছে তিনজনে। কোনো একটা ব্যাপারে একমত হতে পারছে না। হাবভাবেই বোঝা যায়, কিশোরদের সঙ্গে যে কথা বলেছে, সে-ই দলপতি। অবশেষে একমত হলো তিনজনে। দলপতি বললো কিশোরদেরকে, আমরা ঠিক করলাম, তোমাদেরকে কুঁড়েতেই রেখে যাবো। আর বড় মাছটাকে নিয়ে যাবো সাথে করে।
বড় মাছ কে, বুঝতে অসুবিধে হলো না গোয়েন্দাদের। ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলো আরেকবার। বুঝতে পারলো এই ফাঁস গলায় আটকালে কতোটা কষ্ট পায় গরু।
শক্ত করে হাত-পা বাঁধা হলো কিশোর আর রবিনের। টেনেহিঁচড়ে এনে ওদেরকে কুঁড়ের মেঝেতে ফেললো লোকগুলো। কিছুক্ষণ আগে সিনর স্টেফানো যেখানে পড়েছিলেন। দুজনের মুখেই রুমাল গুঁজে দিয়ে আরকিওলজিস্টকে নিয়ে চলে গেল।
সাংঘাতিক অস্বস্তিকর অবস্থা। না পারছে নড়তে, না পারছে কথা বলতে। এমন বাঁধা-ই বেঁধেছে, সামান্যতম ঢিল করা যাচ্ছে না।
অনেক চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিলো ওরা। নাহ, হবে না। নিজে নিজে খুলতে পারবে না। একমাত্র ভরসা এখন মূসা। কোনো বোকামি করে সে-ও যদি ধরা পড়ে যায়, তাহলে সব আশা শেষ।
অপেক্ষা করতে লাগলো দুজনে। গড়িয়ে চললো সময়। এক মিনিট দুই মিনিট করতে করতে ঘণ্টা পেরোলো। কিন্তু মুসার আসার আর নাম নেই। তবে কি সে-ও ধরা পড়লো! বাইরে বেলা শেষ হয়ে এলো। ছায়া ফেলতে আরম্ভ করেছে গোধূলি।
ভয় পেয়ে গেল রবিন আর কিশোর। হলো কি মুসার?
আরেকবার মুক্তির চেষ্টা শুরু করলো দুজনে। দরদর করে ঘামছে, কিন্তু দড়ির বাঁধনকে পরাজিত করতে পারলো না। যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গেল ওগুলো। উপুড় হয়ে মাটিতে মুখ গুঁজে হাঁপাতে লাগলো ওরা।
হঠাৎ, একটা ছায়া দেখা গেল দরজায়। ফিরে তাকালো কিশোর।
মুসা।
রবিনও দেখেছে। ঢিপঢিপ করছে বুকের ভেতর। আনন্দে।
পাশে এসে বসে পড়লো মুসা। একটানে কিশোরের মুখের রুমাল খুলে দিলো। তারপর রবিনের।
এতো দেরি করলে! রবিন বললো। আমরা তো ভাবলাম তোমাকেও ধরেছে! বললো কিশোর।
দেখিইনি কাউকে, ছুরি বের করে বাঁধনে পোঁচ দিলো মুসা। ধরবে কি?
দেরি করলে কেন? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
আমি কি জানি নাকি তোমরা ধরা পড়েছো? বসে থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তোমরা বলে গেছ, বিপদ দেখলে শিস দেবে। আসসা না দেখে উল্টো তোমাদেরকেই বকাবকি শুরু করেছিলাম। রবিনের বাঁধন কাটা শেষ হয়ে গেল। উঠে বসলো সে। ডলে ডলে বাধনের জায়গাগুলোয় রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে লাগলো। কিশোরের দড়িতে পোচ দিতে দিতে মুসা বললো, শেষে আর থাকতে না পেরে বেরিয়ে পড়লাম, তোমরা কি করছে দেখতে। জুতোর ছাপ আর হিচড়ানোর দাগ চোখে পড়লো অনুসরণ করে চলে এলাম কুঁড়েটার কাছে।…তা কি হয়েছিলো, বলো তো?