হুঁ, মাথা দোলালো মুসা, কেন এসেছিলেন এখানে বোঝা যায়। ধ্বংসস্তূপ এখানেও আছে।
বেশ কিছু কুঁড়ে পেরিয়ে এলো গাড়ি। তারপর শেষ হয়ে গেল পথ।
গাড়ি থামিয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো মুসা। এবার?
ম্যাপ দেখতে লাগলো কিশোর। আন্দাজ করলো, যে জায়গা থেকে পড়ে গেছেন স্টেফানো, বলা হয়েছে, সেটা আরও ওপরে। গাড়ি রেখে যেতে হবে।
সবার যাওয়া কি ঠিক হবে? মুসা বললো। লোকগুলো বেপরোয়া। লুকিয়ে রেখে এখন আমাদের ওপর নজর রেখেছে কিনা তাই বা কে জানে। এক কাজ করো, তোমরা দুজন যাও। আমি গাড়ির কাছে থেকে পাহারা দিই। বলা যায় না, তোমাদের পেছনে যাওয়ার আগে গাড়িটাও এসে নষ্ট করে দিয়ে যেতে পারে।
ঠিকই বলেছে মুসা। একমত হলো কিশোর। বললো, থাকো। যদি কোনো বিপদে পড়ি, জোরে জোরে শিস দেবো দুবার। যদি মনে করো, একা আমাদেরকে উদ্ধার করতে পারবে না, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে থানায় চলে যাবে।
আচ্ছা। ঢাল ওখান থেকে বেশ খাঁড়া। এবড়োখেবড়ো। পাথরে বোঝাই। সে-জন্যে আরও ওপরে রাস্তা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। উঠে চললো কিশোর আর রবিন। সন্দেহ হতে শুরু করেছে, সত্যিই এরকম একটা জায়গায় এসেছিলেন কিনা সিনর স্টেফাননা। কোনো ফাঁদে গিয়ে পা দিচ্ছে না তো! আরও কিছুটা উঠে থেমে আলোচনা করতে লাগলো দুজনে। ঠিক করলো, এতোটাই যখন এসেছে, একেবারে চূড়ায় না উঠে ফেরত যাবে না।
আরিব্বাবা! কি ঠান্ডা! চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে রবিন বললো।
চূড়ায় পৌঁছলো দুজনে। সাধারণত পাহাড়ের চূড়া যেমন হয় তেমন নয় এটা। কয়েকশো গজ জুড়ে একেবারে সমতল। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে এলো। নিচে চোখে পড়লো গিরিখাত। হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে ওদের নিচ, দিয়ে। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে পাহাড়ী নদীর চকচকে জলস্রোত।
পড়লে একেবারে ভর্তা! নিচের পাথরস্তুপের দিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিলে কিশোরের। নিশ্চয় ওখানেই খুঁজেছে ওরা স্টেফানোকে। এখানে আসেনি।
দরকার মনে করেনি।
সমতল চূড়াটায় চষে বেড়ালো দুজনে। কোনো সূত্র চোখে পড়লো না। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো আরেক প্রান্তে, যেখান থেকে নেমে গেছে আরেকটা ঢাল। যেটা দিয়ে উঠেছে ওরা, তার চেয়ে কম খাড়া।
কিশোরের হাত খামচে ধরলো রবিন। আরেক হাত তুলে দেখালো। জুতোর ছাপ! অনেকগুলো!
ধস্তাধস্তি হয়েছে! কিশোর দেখে বললো।
ছাপগুলোর কাছে এসে দাঁড়ালো ওরা। চারপাশে ভালোমতো নজর করে তাকাতেই চোখে পড়লো ভারি জিনিস হিচড়ে নিয়ে যাওয়ার দাগ। পাশে জুতোর ছাপও রয়েছে, অন্তত দুই জোড়া। তিন জোড়াও হতে পারে, বোঝা গেল না ঠিক। তবে অনুসরণ করা সহজ।
একজায়গায় এসে হারিয়ে গেল দাগ। এর কারণ মাটি ওখানে নরম নয়। বেশি রকম পাথুরে। ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে লাগলো দুজুনে। আবার পেলো দাগ। একটা কাঁচা পায়েচলা পথে উঠে গেছে। কিছুদূর এগিয়ে আবার হারিয়ে গেল দাগটা। তবে জুতোর ছাপ ঠিকই রয়েছে।
সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো কিশোর। এখান থেকে নিশ্চয় বয়ে নেয়া হয়েছে স্টেফানোকে। তার মানে কাছেই কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।
আরও শখানেক গজ এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো দুজনেই। সামনেই পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কুঁড়ে। পাতার ছাউনি।
ওখানে! ফিসফিসিয়ে বললো রবিন। মাথা নাড়লো শুধু কিশোর, মুখে কিছু বললো না।
খুব সাবধানে, চারপাশে নজর রেখে, পা টিপে টিপে এগোলো দুজনে। চলে এলো কুঁড়েটার কাছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, আরেকবার চারদিকে দেখলো কাউকে দেখা যায় কিনা। নেই।
আস্তে দরজায় ঠেলা দিলো কিশোর। সরে গেল বাঁশের ঝাঁপ। ভেতরে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ। হাত-পা বাঁধা।
মুখ দেখা না গেলেও মানুষটা কে, বুঝতে অসুবিধে হলো না ওদের। দ্রুত এসে ভেতরে ঢুকলো দুজনে। বাঁধন খুলতে লাগলো রবিন। টেনে মুখে গোঁজা কাপড়টা বের করে আনলো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, আপনি সিনর এমিল ডা স্টেফানো, তাই না?
দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে বসলেন ছিপছিপে মানুষটা। মাথায় ধূসর চুল। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন। এতোই দুর্বল, কথা বলতেও বোধহয় কষ্ট হচ্ছে। দেয়ালে ঝোলানো একটা লাউয়ের খোল দেখে উঠে গিয়ে নামালো রবিন। এগুলোতে পানি রাখে পাহাড়ী অঞ্চলের মেকসিকানরা। এটাতেও পানি রয়েছে। বাড়িয়ে দিয়ে বললো, নিন। পানি খান। ভালো লাগবে।
খুব আগ্রহের সঙ্গে খোলটা নিয়ে পানি খেলেন স্টেফানো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আস্তে করে বললেন, অনেক ধন্যবাদ, তোমরা এসেছে।
ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইলো না কিশোর। কাজের কথায় চলে এলো। জিজ্ঞেস করলো, আপনার আরেক নাম কি অ্যাজটেক যোদ্ধা, সি স্টেফানো? মানে, অ্যাজটেক যোদ্ধা নামে ডাকা হয় আপনাকে?
অবাক হলেন আরকিওলজিস্ট। হ্যাঁ। তোমরা জানলে কিভাবে? কে তোমরা?
আমার নাম কিশোর পাশা। ও রবিন মিলফোর্ড। আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।
তাহলে কথা না বলে জলদি আমাকে নিয়ে চলো। ডাকাতগুলো ফিরে আসার আগেই।
প্রশ্ন করার জন্যে অস্থির হয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। তবে সেটা পরেও করা যাবে। আগে স্টেফানোকে এখান থেকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া দরকার। দুদিক থেকে তাকে ধরে তুললো ওরা। রবিন আর কিশোরের কাধে ভর রেখে বাইরে বেরোলেন আরকিওলজিস্ট। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন।