যেতে নিশ্চয় রাত হবে না, কি বলো? দুই সহকারীর উদ্দেশ্যে বললো কিশোর।
হলেই বা কি? রবিন বললো। শুনেছি, রাতে ওসব প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ দেখার আলাদা মজা। আর চাঁদ থাকলে তো কথাই নেই।
ওরা যখন বেরোলো তখন সাতটা বাজে। অচেনা পথঘাট। শুরুতেই পথ হারালো। ব্যাপারটা ধরতে পারলো প্রথমে রবিন। ম্যাপ দেখে। ঠিক পথে এসে ওঠার জন্যে এবড়োখেবড়ো একটা কাঁচা রাস্তা ধরতে হলো।
প্যান প্যান শুরু করলো মুসা, এভাবে চললে ঘণ্টাখানেক পরেই আবার খিদে পাবে। নাহ, ঘোড়ার ডিমের অ্যাজটেক যোদ্ধাকে খুঁজে আর বের করা হলো না এযাত্রা!
গতি খুব ধীর। কিশোরও অধৈর্য হয়ে উঠেছে। নিজেকেই যেন সান্ত্বনা দিলো, আসল রাস্তায় উঠতে বেশিক্ষণ লাগবে না।
এঞ্জিনটা এখন বন্ধ না হলেই হয়, মুসা বললো।
কিংবা টায়ার পাংচার, পেছনের সীট থেকে বললো রবিন।
তবে এঞ্জিন বন্ধ কিংবা টায়ার পাংচার কোনোটাই হলো না। খোয়া বিছানো একটা পথে এসে উঠলো গাড়ি। গতি বাড়ালো মুসা। পাহাড়ী পথ ধরে দ্রুত ধ্বংসস্তুপের দিকে উঠে চললো। পথ ভুল করায় বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়েছে। সেটা পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করছে মুসা। কিন্তু তার পরেও দিনের আলো থাকতে থাকতে পর্বতের ওপরের চ্যাপ্টা সমতল জায়গাটায় পৌঁছতে পারলো না, যেখানে রয়েছে মনটি অ্যালবানের ধ্বংসস্তূপ। সূর্য ডুবে গেছে। চাঁদ উঠেছে।
টর্চ না নিয়ে নেমো না, সতর্ক করলো কিশোর, যতোই চাঁদ উঠুক। মুসা, ভূতের ভয় লাগছে না তো?
লাগলেই আর কি করবো?
হাসলো কিশোর। রবিন কিছু বললো না।
চাঁদের আলোয় কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছে মনুটি অ্যালবানের পিরামিড আকৃতির মন্দির, সমাধিস্তম্ভ, আর বাড়িঘরগুলোকে। গা ছমছমে পরিবেশ। বিশাল এক চত্বর দেখতে পেলো ওরা। চারপাশ ঘিরে তৈরি হয়েছে পাথরের বাড়ি। দুটো বাড়ির মাঝের ফাঁকে গাড়ি রাখলো মুসা। টর্চ হাতে নেমে পড়লো তিনজনে। জায়গাটার বিশালত্বের কাছে অনেক ক্ষুদ্র মনে হলো নিজেদেরকে। স্তব্ধ, নীরব। অথচ এককালে নিশ্চয় গমগম করতো লোকজনে।
ডানে বাঁয়ে তাকালো মুসা। রবিনকে জিজ্ঞেস করলো, মিস্টার বুক অভ নলেজ, এর ইতিহাস কিছু জানো নাকি?
কিছু কিছু। পনেরোশো শতকের গোড়ার দিকে গড়ে উঠেছিলো এই শহর। তারপর হাত বদল হলো। স্প্যানিশরা এসে দখল করে ফেললো। নতুন মনিবেরা অনেক কিছু রদবদল করে তৈরি করলো নতুন শহর। মূল জায়গা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে। আর পুরানো শহরটাকে ব্যবহার করতে লাগলো, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজে। তাদের বড় বড় নেতাকেও কবর দিলো এখানে।
তার মানে পুরোপুরিই ভূতুড়ে শহর!
একটা পাথরের দেয়ালের পাশে চলে এলো ওরা। নাচের দৃশ্য আঁকা হয়েছে খোদাই করে। খাইছে! প্রায় চিৎকার করে উঠলো মুসা। দেখ দেখ!
ঝট করে ঘুরে গেল অন্য দুটো টর্চের আলো। কিশোর জিজ্ঞেস করলো, কি?
জ্যান্ত! ওগুলো জ্যান্ত!
হাসতে শুরু করলো কিশোর আর রবিন। এই ভূতই তোমার সর্বনাশ করবে। মাথাটা একেবারেই খারাপ করে দিয়েছে! একটা মূর্তির গায়ে হাত বোলালো কিশোর। এই দেখ, একেবারে মরা! পাথর!
যতো যা-ই বলো, হাসিতে যোগ দিতে পারলো না মুসা। আমি কিছু নড়তে দেখেছি। মনে হচ্ছে চারপাশের কবর থেকে বেরিয়ে এসেছে সমস্ত প্রেতাত্মা! আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে!
বাদ দাও তো ওসব ফালতু কথা! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো কিশোর। কি কাজে এসেছি ভুলে গেছ? সিনর স্টেফানোকে খুঁজতে।
কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে না। অন্তত এই বেলা। ধ্বংসস্তুপে যদি কাজ করেনও রাতের বেলা এখন কি করতে আসবেন?
কোথায় ঘুমান, সেটা খুঁজে বের করবো, বললো বটে, কিন্তু জোর নেই কিশোরের গলায়। জায়গাটায় এসেই তার মনে হয়েছে, কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে। স্টেফানো এখানে সত্যি আছেন কিনা, এ-ব্যাপারেও সন্দেহ জাগতে আরম্ভ করেছে। হয়তো ইচ্ছে করেই গুজব ছড়িয়ে ওদেরকে টেনে আনা হয়েছে এখানে, কে জানে!
অ্যাই, দেখ! বলে উঠলো রবিন। হাত তুলে দেখালো।
সামনে পিরামিডের মাথায় একটা আলো মিটমিট করছে। লণ্ঠনের আলোর মতো।
পেয়েছি! উত্তেজিত কণ্ঠে আবার বললো ররিন। নিশ্চয় সিনর স্টেফানো! কাজ করছেন ওখানে!
সন্দেহ গেল না কিশোরের। কেন যেন মনে হতে লাগলো, পুরো ব্যাপারটাই একটা ফাঁকিবাজি। ধোকা! মনটি অ্যালবানেতে এসে ডা স্টেফানোর প্রত্নতাত্ত্বিক খোড়াখুঁড়ির গল্পটা ভুয়া। ওরকম কিছু হলে, আর এতো বড় একটা আবিষ্কার ঘটলে, হোটেলের ম্যানেজারের অন্তত না জানার কথা নয়। তার সন্দেহের কথাটা বললো দুই সহকারীকে।
কিন্তু কেন এই গল্প বানিয়ে বলতে যাবে? রবিনের প্রশ্ন।
শুধু আন্দাজ করতে পারি, জবাব দিলো কিশোর। নিশ্চিত হয়ে এখনও কিছু বলতে পারবো না। আমার বিশ্বাস, টোপ দেখিয়ে আমাদেরকে এখানে পাঠানোর উদ্দেশ্যেই একাজ করা হয়েছে। আমাদের শত্রুরা জানে, শুনলে তদন্ত করতে আসবোই আমরা। হয়তো কোনো কারণে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। কিংবা ভুল পথে ঠেলে দিয়ে সময় নষ্ট করাতে চেয়েছে। যা-ই হোক, আলোটার দিকে দেখালো সে। ওটা দেখতে যাবো। কিসের আলো জানা দরকার। খুব সাবধানে থাকবে।
ওই আলো দেখতে যাওয়ার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না মুসার। দশজন ষন্ডামার্কা লোকের সঙ্গে লাগতেও ভয় পায় না সে। কিন্তু রোগাটে একটামাত্র ভূত হলেও তার ধারেকাছে যেতে রাজি নয় সে। তবে কিছু করার নেই। কিশোর যখন যেতে বলেছে, যেতেই হবে।