সিনর স্টেফানো?
বুঝতে পারছি না। রিপোর্ট পেয়েছি, একজন লোক নাকি শহরে এসে ঢুকেছে। বলে বেড়াচ্ছে খবরটা। তাকে ধরে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। বললো, আরকিওলজিস্ট নাকি তার পরিচয় ছড়াতে নারাজ। সেজন্যেই মনে হচ্ছে আমার, তিনি সিনর স্টেফানো।
তাহলে আর দেরি করবো না, কিশোর বললো। এখুনি বেরিয়ে পড়বো। দেখি তাঁকে ধরতে পারি কিনা। তা আবিষ্কারটা কি করেছেন?
লোকটা বলতে চাইলো না। অনেক চেষ্টা করলাম, একটু থামলেন মারকাস। তারপর বললেন, এখুনি যাবে? মনটি অ্যালবানের রাস্তা কিন্তু ভালো না। আমি অবশ্য কখনও যাইনি। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হয়। অনেক দূর। আজকে না গিয়ে কাল সকালেই যাও।
আচ্ছা। লাইন কেটে গেল।
রবিন আর মুসাকে খবরটা জানালো কিশোর। তারপর ম্যাপ খুলে বসলো। মেকসিকোর উত্তরপুবে প্রায় সাড়ে তিনশো মাইল দূরে ছোট একটা শহর আছে। নাম অকজাকা। যেতে হবে ওই শহরের ভেতর দিয়ে।
রবিন বললো, একদিনে মনটি অ্যালবানে যাওয়া সম্ভব না। এক কাজ করবো। অকজাকায় গিয়ে হোটেলে উঠবো। ওখান থেকে আবার রওনা হওয়া যাবে।
পরদিন খুব সকালে রওনা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। প্যান-আমেরিকান হাইওয়ে ধরে যেতে হয়। প্রচন্ড ভিড়। দুই ঘণ্টা লেগে গেল পর্বতের কাছাকাছি আসতেই। ভিড় না থাকলে আরও অনেক আগেই চলে আসতে পারতো। সরু একটা শাখা পথ ঢুকে গেছে পর্বতের ভেতরে। সেই পথ ধরে চললো ওরা। একটু পর পরই তীক্ষ্ণ মোড়। ওপাশ থেকে সাড়া না দিয়ে গাড়ি এলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মোড় ঘোরার সময় তাই বার বার হর্ন দিতে লাগলো কিশোর। তার পরেও আরেকটু হলেই অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাচ্ছিলো একবার। ওপাশ থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে এলো একটা গাড়ি। এরকম মোড়েও গতি কমায়নি। শাই শাই করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পর্বতের দেয়ালের সঙ্গে প্রায় সেঁটে গেল কিশোর। অন্য গাড়িটা পড়ে যাচ্ছিলো পাশের গভীর খাদে, নিতান্ত কপাল জোর আর ড্রাইভারের দক্ষতার কারণে বেঁচে গেল।
অপূর্ব দৃশ্য পর্বতের। দেয়াল কোথাও খাড়া, কোথাও ঢালু। বেরিয়ে রয়েছে গ্রানাইটের বিচিত্র স্তর। ছোটবড় চূড়ার কোনো কোনোটাতে রোদ পড়ে জ্বলছে। যেন কড়া লাল রঙে রাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। ছবির মতন।
ঢালে জন্মে রয়েছে নানা জাতের ক্যাকটাস। চিউলিপ ফুলের মতো দেখতে খাটো ম্যাগুই ক্যাকটাস থেকে শুরু করে দৈত্যাকার ক্যানডেল ক্যাকটাস, সবই আছে। যেমন বিচিত্র চেহারা, তেমনি রঙ।
ছড়ানো, সমতল একটা জায়গায় পৌঁছলো ওরা। জায়গাটা পর্বতের ওপরেই। ক্যাকটাসের এক ঘন ঝাড় হয়ে আছে ওখানে।
এই, দাঁড়াও তো! কিশোরের কাঁধে হাত রাখলো মুসা।
গাড়ি থামালো কিশোর। গরুর গাড়ির চাকার মতো সমব্রেরো হ্যাঁট পরা একজন মানুষ মাটিতে ঝুঁকে বসে কি যেন করছে একটা ম্যাগুই কাকটাসের গোঁড়ায়। তার কাছে এগিয়ে গেল মুসা। বুঝতে পারলো কি করছে লোকটা। ক্যাকটাসের ভেতরে এক ধরনের রস হয়। পানির বিকল্প হিসেবে সেটাকে খাওয়া যায়। তা-ই বের করছে লোকটা।
এদিকে অনেক টুরিস্ট আসে। এখানকার লোকেরা তাই ইংরেজি বোঝে, বলতেও পারে কিছু কিছু। এই লোকটাও পারে। সহজেই তার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললো মুসা।
রবিন আর কিশোরও নেমে এলো। খিদে পেয়েছে তিনজনেরই। গাড়িতে লাঞ্চ প্যাকেট আর পানির বোতল রয়েছে। নামিয়ে আনা হলো। ক্যাকটাসের ছায়ায় খেতে বসলো তিনজনে। লোকটাকে আমন্ত্রণ জানাতেই রাজি হয়ে গেল সে।
লেখাপড়া মোটামুটি জানে লোকটা। তার নাম ডিউগো। মেকসিকো সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারলো সে। অনেক মজার মজার গল্প, ইতিহাস।
ইনডিয়ানদের সামাজিকতা, দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলির কাহিনী, এসব অনেক কিছুই জানে সে। বলে গেল গড়গড় করে। আর বলতেও পারে বেশ গুছিয়ে, সুন্দর করে। শুনতে ভালোই লাগে।
একসময় পিন্টো আলভারোর কথা জিজ্ঞেস করে বসলো কিশোর।
না, চিনি না, মাথা নাড়লো ডিউগো।
অজাকায় থাকে?
জানি না, পকেট থেকে ছবি বের করে দেখালো কিশোর। এই আরেকজন লোক, সিনর স্টেফানো। আরকিওলজিস্ট। নাম শুনেছেন?
সি, সি. দ্রুত জবাব দিলো লোকটা। দেখিনি কখনও। তবে শুনেছি, সিনর স্টেফানো নামে একজন লোক এখানকার ধ্বংসস্তূপগুলোতে খুঁড়তে আসে। বহুবার এসেছে।
মনটি অ্যালবানে যায়?
তা বলতে পারবো না।
লোকটাকে আরও কিছু প্রশ্ন করে, ধন্যবাদ এবং গুডবাই জানিয়ে উঠে এলো তিন গোয়েন্দা। গাড়িতে উঠলো। এবার ড্রাইভিং সীটে বসলো মুসা।
নাহ, একবিন্দু এগোতে পারছি না, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কিশোর। লাভের মধ্যে শুধু বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, রহস্যের কিছুই করা যাচ্ছে না!
অকজাকাতে একটা হোটেলে উঠলো ওরা। ম্যানেজারের সঙ্গেও আলাপ করে দেখলো কিশোর। কিছুই জানতে পারলো না। মনটি অ্যালবানে যে একটা বড় আবিষ্কার হয়েছে, এই খবরটা জানে না পর্যন্ত ওই লোক।
রবিন জিজ্ঞেস করলো, আজই যাবে?
ঘড়ি দেখলো কিশোর। ছটা বাজে। এখুনি খেয়ে নিলে যাওয়া যায়।
তাহলে দেরি করছি কেন? ভুরু নাচালো মুসা। বসে গেলেই হয়।
খেয়েদেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। এবারের গন্তব্য মনটি অ্যালবানের ধ্বংসস্তূপ, যেখানে সিনর স্টেফানো যুগান্তকর এক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার করেছেন বলে গুজব ছড়িয়েছে।