এক সময় একটা শহর ছিলো বটে! অবাক হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে রবিন। আর এসব মন্দির এতো কষ্ট করে তৈরি হয়েছে শুধু মানুষ খুনের জন্যে! ভাবতে কেমন লাগে না? এখানে এনে বলি দেয়া হতো মানুষকে।
বইয়ে পড়েছি, হাত তুলে দূরের একটা জায়গা দেখিয়ে মুসা বললো। একসময় ওখানে নাকি লক্ষ লোকের বাস ছিলো। ওটাই পিরামিড অভ দি মুন। চাঁদের পিরামিড, তাই না?
মাথা ঝাঁকালো কিশোর আর রবিন।
যেটাতে দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে অবিকল একই রকম ওই পিরামিডটাও, কেবল আকারে ছোট।
একটা মন্দির দেখিয়ে কিশোর বললো, ওটা তৈরি হয়েছিলো একজন বিদেশীর সম্মানে।
কী! মুসা বললো। আমি তো জানতাম, হাজার বছর আগেই তৈরি হয়েছে ওটা। স্প্যানিয়ার্ডরা এখানে আসার আগে।
তা-ই হয়েছিলো। কেন, কিংবদন্তীটা শোনননি? শাদা চামড়া, নীল চোখ, লম্বা দাড়িওয়ালা একজন মানুষ এসে হাজির হয়েছিলো সাত সাগরের ওপার থেকে, পালকে ঢাকা সাপের পিঠে চড়ে? সেজন্যেই সাপ ছিলো প্রাচীন মেকসিকানদের কাছে পবিত্র। ওই মানুষটার নাম দিয়েছিলো ওরা কোয়েজাল-কোয়াটল। তখনকার ইনডিয়ানদের চেয়ে অনেক অনেক জ্ঞানী ছিলো সেই লোক। তাদেরকে শিখিয়েছিলো কি করে বিল্ডিং তৈরি করতে হয়, ফসল ফলাতে হয়, পাথর কুঁদে শিল্প সৃষ্টি করতে হয়।
এই গল্প খুব ভালো লাগছে মুসার। অ্যাজটেকদের সঙ্গে বাস করতো সেই লোক?
না। ওরা আসার অনেক আগে থেকেই সেই লোক ছিলো সেখানে। তার মৃত্যুর পর তাকে দেবতা বানিয়ে ফেললো ইনডিয়ানরা। কোয়েঞ্জালকোয়াটল ইনডিয়ানদের অনেক দেবতার একজন।
দেখা হয়েছে। আবার নামতে লাগলো তিন গোয়েন্দা। অর্ধেক নামার পর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো রবিন, এই দেখ দেখ! ওই যে! ছবির লোকটার মতো লাগছে?
সিনর স্টেফানো! মুসা বললো।
হতে পারে, বললো রবিন। তবে নামার গতি বাড়ানোর কোনো চেষ্টা করলো না। এতো ওপর থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে মরতে চায় না।
গোড়ায় নেমে আর লোকটাকে দেখতে পেলো না ওরা। ভাবলো, আরেক পাশে চলে গেছে। দ্রুত হেঁটে আরেক পাশে চলে এলো তিনজনে। নেই লোকটা। প্রায় দৌড়াতে শুরু করলো তিনজনে। পুরো পিরামিডের চারপাশে এক চক্কর দিয়ে এলো। আশ্চর্য! কোথাও দেখা গেল না লোকটাকে। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
ধপ্ করে মাটিতে বসে পড়লো মুসা। পাগল হয়ে গেছি আমরা! কি সব কাণ্ড করে বেড়াচ্ছি! এসবের কোনো মানে হয়? পুরো মেকসিকো শহর ঘুরে এলেও এতো কষ্ট লাগতো না।
তিনজনের মধ্যে মুসাই সব চেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করতে পারে। তারই যখন এই অবস্থা, কিশোর আর রবিনের অবস্থা অনুমানই করা যায়। এক জায়গায় সামান্য ঘাস দেখে তার ওপর শুয়েই পড়লো রবিন। ওই অ্যাজটেক ব্যাটাদের ফুসফুসের ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ!
কিশোরও বসে হাঁপাচ্ছে। সে ভাবছে লোকটার কথা। বললো, হয়তো অন্য পিরামিডটার কাছে চলে গেছে সে। দেরি করলে আর পাওয়া না-ও যেতে পারে। তাড়াতাড়ি এসে গাড়িতে উঠলো তিন গোয়েন্দা। ছুটলো চাঁদের পিরামিডের দিকে। সেখানেও পাওয়া গেল না লোকটাকে। এর পর গেল ওরা কোয়েঞ্জালকোয়াটলের মন্দিরের কাছে। এটাকেও ছোটখাটো আরেকটা পিরামিডই বলা চলে। চারপাশে চক্কর দিল এলো একবার।
ভ্রূকুটি করলো কিশোর। লোকটা কে, কে জানে! সিনর স্টেফানো না-ও হতে পারে। আমাদের দেখলে পালাবেন কেন ডক্টর?
তা-ও তো কথা, বললো মুসা। কিন্তু তিনি যদি স্টেফানোই হন, আর আমাদের দেখে এভাবে পালাতে থাকেন, তাহলে তার সঙ্গে কথা বলবো কিভাবে? রবিন, ঠিক দেখেছো তো?
দেখলাম তো আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে, রবিনের কণ্ঠে সন্দেহ। তবে সিনর স্টেফানোই কিনা, শিওর নই। মনে হলো তারই মতো।
হু। সব মেকসিকানের তো একই চেহারা! অন্তত আমার আলাদা মনে হয় না।
আবার মন্দির দেখায় মন দিলো ছেলেরা। পাথর কুঁদে দারুণ সব দৃশ্য আর কল্পিত জীবজন্তুর মূর্তি আঁকা হয়েছে। ফণা তুলে রেখেছে মস্ত এক সাপ। হাঁ করা। ভয়ংকর দাঁতগুলো বেরিয়ে রয়েছে। কয়েকটা সাপ রয়েছে ওরকম। ওগুলোর মাঝে দেখা গেল একজন মানুষকে। বোধহয় ওই লোকই কোয়েঞ্জাল-কোয়াটল। সেই প্রাচীনকালে এরকম শিল্প সৃষ্টি কি করে সম্ভব হয়েছিলো, যখন পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ছিলো না, ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার কিশোর। বিড়বিড় করে বললো, এর সামনেই ছবি তুলেছিলেন মিস্টার রেডফোর্ড। এখানে অ্যাজটেক যোদ্ধার কোনো সূত্র লুকিয়ে নেই তো?
বিশাল, মন্দিরটার দিকে তাকিয়ে রবিন বললো, এখানে চিঠি কিংবা দলিল লুকানো আছে ভাবছো? এক মাস লেগে যাবে খুঁজে বের করতে।
তবে আপাতত সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না ওরা। যে কোনো সময় ফিরে আসতে পারবে কোয়েঞ্জালকোয়াটলের মন্দিরে। এখন জরুরী কাজ হলো সিনর স্টেফানোকে খুঁজে বের করা। এখানে যখন নেই, অন্য কোনো ধ্বংসস্তুপে রয়েছেন হয়তো।
আবার গাড়িতে এসে উঠলো ওরা। হোটেলে ফিরে চললো।
৯
হোটেলে ফিরে কাপড় ছেড়েও সারতে পারলো না কিশোর। টেলিফোন বাজলো। পুলিশ চীফ মারকাস ফোন করেছেন। বললেন, এক ঘণ্টা যাবৎ তোমাদেরকে ধরার চেষ্টা করছি। কোথায় গিয়েছিলে?
টিওটিহুয়াকানে। কেন?
একটু আগে খবর পেলাম, একটা গুজব নাকি ছড়িয়ে পড়েছে; মনটি অ্যালবানে একজন আরকিওলজিস্ট একটা বিরাট আবিষ্কার করেছেন। তিনিই তোমাদের লোক নন তো?