না, ঠাট্টা করো না, সত্যি আছে…
ভালোই তো হবে তাহলে। কখনও তো সত্যিকারের ভূত দেখনি। এবারে দেখা হয়ে যাবে।
তারমানে আমাকে পিরামিডে চড়িয়েই ছাড়বে!
তুমি তো আর একা উঠবে না। প্রয়োজন হলে আমরাও তোমার সঙ্গে থাকবো।
গুম হয়ে গেল মুসা। বুঝতে পারলো, ওরা তার কথা শুনবে না।
পরদিন সোমবার। সকালে নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। হোটেলের কাছেই একটা রেন্ট-আ-কার সার্ভিস রয়েছে। সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলো। একটা কনভারটিবল গাড়ি। টিওটিহুয়াকানে চললো।
দুপুরের দিকে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে নাম পড়লো মুসা, গ্রোটো রেস্টুরেন্ট। হুঁ, খাবার-দাবার ভালোই হবে মনে হচ্ছে। চলো, ঢুকে পড়া যাক।
রেস্টুরেন্টটা কোনো বাড়ির মধ্যে নয়। পাহাড়ের একটা গুহার ভেতরে। একসময় প্রাচীন ইনডিয়ানদের একটা গোত্র বাস করতো এখানে।
গাড়ি সরিয়ে এনে রাস্তার পাশে পার্ক করলো কিশোর। তিনজনে মিলে ঢুকে পড়লো গুহার ভেতর। মুসার অনুমান ভূল হয়নি। খাবার সত্যিই চমৎকার। একবার খেয়ে আরেক প্রস্থ খাবারের অর্ডার দিলো মুসা। তাকে সাবধান করলো কিশোর, বুঝেশুনে খেও। অনেক ওপরে উঠতে হবে আমাদের। পেট বোঝাই থাকলে অসুবিধে হতে পারে।
সে দেখা যাবে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লো মুসা।
অবশেষে পিরামিডের কাছে পৌঁছলো তিন গোয়েন্দা। মিশরীয় পিরামিডের মতো তিনটে দেয়াল নয় মেকসিকান পিরামিডের, দেয়ালগুলো সমানও নয়। চারটে দেয়াল, এবং ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে ক্রমশ সরু হয়ে। যতোই ওপরে উঠেছে, চেপে এসেছে দুই পাশ, ফলে চূড়াটা হয়ে গেছে একেবারে চোখা। শত শত ধাপ সিঁড়ি। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো ওরা। দর্শকের যেমন অভাব নেই, প্রত্নতাত্ত্বিকদেরও কমতি নেই। অসংখ্য জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। মুসার আশঙ্কা হতে লাগলো, এভাবে চলতে থাকলে কোনোদিন ধসিয়েই দেবে পিরামিডটা। তবে তার আশঙ্কা অমূলক। কোনো কিছু নষ্ট না করে কিভাবে খুঁড়তে হয় জানা আছে আরকিওলজিস্টদের।
কি সর্বনাশ! মুসার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো রবিন। এসেছিলাম একটা ভূতুড়ে শহর দেখতে। কিন্তু এ-যে বাজার বানিয়ে ফেলেছে।
রবিনের কথায় কান নেই মুসার। তাকিয়ে রয়েছে চুড়ার দিকে। আরিব্বাপরে, কি উঁচু। সূর্যের পিরামিড নামটা ভুল রাখেনি। মনে হয় একেবারে সূর্য ছুঁতে চাইছে। ওখানে উঠতে হবে আমাকে?
ভয় পাচ্ছাে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
ভূতের ভয় আর পাচ্ছি না এখন। এতো লোকের সামনে ভূত আসবে না। উচ্চতার ভয়ই পাচ্ছি। এতো উঁচুতে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরেই না পড়ে যাই!
পড়বে না, কিশোর বললো। যদি ইনডিয়ান কায়দায় ওঠো। ওরা কক্ষণাে সিড়ির দিকে মুখ করে উঠতো না। পাশ থেকে উঠতো। নামার সময়ও একই ভাবে নামতো।
ছাগল ছিলো আর কি, মুসা বললো। পাশ থেকে ওঠা তো আরও কঠিন।
হয়তো। কিন্তু তাতে পড়ার সম্ভাবনা নেই। সিড়িগুলো কি সরু দেখছো না?
তাহলে উঠবেই?
হ্যাঁ। সবাই ওঠো। ডা স্টেফানোকে পাই আর না পাই, এতোদূরে এসে পিরামিডে চড়ার সুযোগ ছাড়বো না।
এগিয়ে গিয়ে উঠতে শুরু করলো কিশোর। দেখাদেখি রবিনও গেল। সবার শেষে মুসা। কিছুদূর উঠে আর পাশ থেকে ওঠার কথা মনে রইলো না তার। কিংবা পরোয়া করলো না। সামনের দিকে মুখ করে উঠতে আরম্ভ করলো। বড় জোর পাঁচ কি সাতটা ধাপ পেরিয়েছে, তার পরই পা পিছলালো। সোজা থাকার অনেক চেষ্টা করলো। পারলো না কিছুতেই। পড়ে গেল। গড়াতে শুরু করলো শরীরটা।
সরাসরি উঠতে গিয়ে সবার আগে চলে গিয়েছিলো সে। পেছনে পড়েছিলো কিশোর আর রবিন। কারণ ওরা তাড়াহুড়ো করেনি। মুসার পতন ঠেকাতে চেষ্টা করলো ওরা। পারলো তো না-ই, ওরাও পড়ে গেল।
গড়াতে গড়াতে নিচে পড়তে লাগলো তিনটে শরীর।
চেঁচামেচি শুনে একবার ফিরে তাকিয়েই আবার যার যার কাজে মন দিলো যারা মাটি খুঁড়ছিলো। গুরুত্বই দিলো না। বোঝা যায়, এভাবে গড়িয়ে পড়াটা এখানে নতুন নয়। দেখে দেখে গা সওয়া হয়ে গেছে ওদের।
৮
বিশাল পিরামিডের একেবারে গোড়ায় এসে বন্ধ হলো গড়ানো। হাঁসফাস করতে করতে উঠে বসলো তিনজনেই। হাঁটু আর কনুই ছড়ে গেছে। আরও কয়েক জায়গায় ব্যথা পেয়েছে, তবে হাড়টাড় ভাঙেনি।
বলেছিলাম না ভূত আছে! কোলাব্যাঙের স্বর বেরোলো মুসার কণ্ঠ দিয়ে। ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে!
তোমার মাথা! রেগে গেল কিশোর। কতোবার সাবধান করলাম ওভাবে উঠতে পারবে না! ইনডিয়ানদের শত শত বছরের অভিজ্ঞতাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে গিয়েই এই বিপদটা বাধালে। ভাগ্যিস বেশি ওপরে উঠে অকাজটা শুরু করোনি!
রবিন কাঁপছে। মুখ থেকে ধুলো আর মাটি মুছে বললো, মুখ-টুখ মোছো না। ভাঁড়ের মতো লাগছে তো।
কিশোর আর রবিনের মুখের অবস্থা দেখেই নিজেরটা কেমন হয়েছে আন্দাজ করে ফেললো মুসা। মুছতে মুছতে বললো, বাপরি বাপ! মনে হলো গত একহাজার বছর ধরে একটানা গড়াগড়ি খেয়েছি। জাহান্নামে যাক সূর্যের পিরামিড। আমি আর এর মধ্যে নেই, দুহাত নাড়লো সে।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। কিন্তু আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।
উঠতে শুরু করলো আবার সে। পিছু নিলো রবিন। পুরো আধ মিনিট সেদিকে তাকিয়ে বসে রইলো মুসা। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। ওরা দুজনে পারলে সে পারবে না কেন? উঠতে শুরু করলো সে-ও। তবে এবার আর তাড়াহুড়ো করলো না। নিয়মও লঙঘন করলো না। ধীরে ধীরে উঠে এলো ওরা চূড়ার কাছে চওড়া বেদিমতো জায়গাটায়।